এখন তীব্র প্রতিযোগিতার সময়। খেলাধুলায় যেমন, তেমনি চাকরিতেও। রাজনীতিতে যেমন, তেমনি ব্যবসায়েও। আবার বিনোদনে যেমন, তেমনি পড়াশোনায়ও। বিশেষ করে পড়াশোনার প্রতিযোগিতাটা এখন ভয়াল রূপ ধারণ করেছে। এরমধ্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই প্রতিযোগিতার মনোভাব তৈরি করছেন খোদ অভিভাবক ও সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা। তারা মনে করেন—মেধাবী শিক্ষার্থীর প্রমাণ তার পরীক্ষার ফল ভালো করায়। তাদের বদ্ধমূল ধারণা—শ্রেণিতে যার ক্রমিকনম্বর এক, সে-ই সবচেয়ে বেশি মেধাবী শিক্ষার্থী। তাই অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের মনে সারাক্ষণ এই ধারণা সঞ্চারমান রাখেন, নিজেকে মেধাবী প্রমাণ করতে হলে স্ব-স্ব শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করতেই হবে।
অভিভাবকদের পাশাপাশি শিক্ষকরাও প্রথম স্থান অধিকারী শিক্ষার্থীর প্রতি অতিরিক্ত স্নেহ-মমতা দেখান। আর এই একপেশে স্নেহ-মমতার আতিশয্যে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকার করতে না পারা শিক্ষার্থীরা প্রায় হীনমন্যতায় ভোগে। শিক্ষাঙ্গনে যেমন জড়তা নিয়ে থাকে, তেমনি বাসা-বাড়িতেও স্পষ্টবাদী হয়ে উঠতে পারে না। তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের প্রবল অভাব ঘটে। এই আত্মবিশ্বাসহীনতায় তারা পড়াশোনা যত বেশিই করুক, পুরোটা ধারণ করতে পারে না। ফলে দিন শেষে পরীক্ষায়ও ভালো ফল করে দেখাতে পারে না। পরীক্ষার ফল শিক্ষক-অভিভাবকদের আশানুরূপ না হওয়ায় এই শিক্ষার্থীরা শিক্ষাঙ্গন ও বাসা-বাড়িতে সমানহারে সসংকোচে চলতে বাধ্য হয়। অথচ ‘পরীক্ষায় ভালো ফল’কে মেধার মাপকাঠি হিসেবে গণ্য না করে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের উদ্ভাবনী শক্তি, কল্পনাশক্তি, বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তি ও সাংস্কৃতিক শক্তিকে শিক্ষক ও অভিভাবকরা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করলে শ্রেয়তর ফল পাওয়া যেতো।
কিন্তু অভিভাবক বা শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক দিকে গুরুত্ব না দিয়ে পরীক্ষায় ভালো ফল করার ওপর বেশি গুরুত্ব দেন। এরও কয়েকটি কারণ রয়েছে।
১। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রে ভালো ফলের অগ্রাধিকার
২। ভালো চাকরির উদ্দেশ্যে পড়াশোনা করা
২। সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে ভালো ফলের গুরুত্ব
৩। সমাজে ভালো ফলপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীর মর্যাদা বেশি
দেশের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজগুলোয় ভর্তির ক্ষেত্রে ভালো ফলকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। এসএসসি ও এসএইচসির ভালো ফলকে মেধার মানদণ্ড ধরা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাই সাধারণ কলেজ ও মেডিকেলগুলোতেও মেধাবীদের অগ্রাধিকার থাকে। এ কারণে অভিভাবকরাও চান, তাদের সন্তানরা প্রাথমিক থেকে নিম্নমাধ্যমিক, নিম্নমাধ্যমিক থেকে মাধ্যমিক, মাধ্যমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিকে যেন ভালো ফল করে। তাহলেই তারা পরবর্তী ধাপে ধাপে পরবর্তী শ্রেণীগুলোতে ভর্তি হওয়ার প্রতিযোগিতায় অগ্রাধিকার পাবে। এই মনোভাব থেকেই শিক্ষার্থীদের কৈশোরেই ভালো ফল করার প্রতিযোগিতার প্রতি তারা আগ্রহী করে তোলেন। অভিভাবকদের সেই আগ্রহের প্রতি সমর্থন জানিয়ে শিক্ষকরাও কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একই রকম আচরণ করেন। অর্থাৎ অভিভাবক থেকে শুরু করে শিক্ষক; উভয়পক্ষই কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ওপর ভালো ফল করার প্রতিযোগিতার সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেন। ফলে শিক্ষার্থীদের মনের ওপর এক ধরনের চাপ তৈরি হয়। তারা দিনরাত পাঠ্যবইকেন্দ্রিক সময় অতিবাহিত করে। তাদের লক্ষ্য একটাই থাকে, পরীক্ষায় ভালো ফল করে অভিভাবকদের স্বপ্ন পূরণ করবে এবং শিক্ষকদের সন্তুষ্টি অর্জন করবে।
মাধ্যমিক পর্যায় থেকেই শিক্ষার্থীদের মনে অভিভাবকরা এই ধারণার বীজ বপন করে দেন যে, পড়াশোনার মূল উদ্দেশ্য ভালো চাকরি পাওয়া। ভালো বেতনের চাকরি পেতে হলে পরীক্ষায়ও ভালো ফল করতে হবে। অভিভাবকদের এই চাওয়ার প্রতি আনুগত্য দেখাতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা উদয়াস্ত ভালো ফলের পেছনেই ছোটে।
আরেকটা বিষয় এখানে উল্লেখ্য। সেটি হলো, সরকারি-বেসরকারি যে-কোনো চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানে মেধা ও যোগ্যতার মাপকাঠি হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক পরীক্ষার ভালো ফলকেই ধরা হয়। ফলে যাদের প্রাতিষ্ঠানিক পরীক্ষার ফল ভালো, তারা আবেদন করার ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকছে। বাকিরা অনেক সময় আবেদনই করার সুযোগ পাচ্ছে না। ফলে সরকারি-বেসরকারি চাকরি পাওয়ার জন্যও শিক্ষাজীবনে শিক্ষার্থীরা ভালো ফলের জন্যই পরিশ্রম করে।
সবশেষ কারণ, শ্রেণীকক্ষে যারা ক্রমিক এক থেকে তিনের মধ্যে, তাকেই সেরা শিক্ষার্থী, মেধাবী শিক্ষার্থী হিসেবে সমাজে গণ্য করা হয়। বাকিদের সাধারণত তুচ্ছতাচ্ছিল্যের চোখে দেখা হয়। কেবল পাঠ্যবইকেন্দ্রিক বিদ্যার্জন ও পাঠ্যবইকেন্দ্রিক প্রশ্নের উত্তর পরীক্ষার খাতায় হুবহু লিখে যে শিক্ষার্থী ভালো ফল অর্জন করতে পারে তার প্রতি শিক্ষকদের যেমন স্নেহ থাকে, তেমনি অভিভাবকদেরও অতিরিক্ত আদরযত্ন তারা পায়। পাশাপাশি পাড়াপ্রতিবেশী থেকে শুরু করে সমাজের দশজনের কাছেও তারা আলাদা স্নেহ-মমতা পেয়ে থাকে।
উল্লিখিত সব কারণই পরীক্ষায় ভালো ফলধারী শিক্ষার্থীদের মেধাবী হিসেবে হিসেবে শনাক্ত করার পক্ষে নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। এই মেধাবীদের দেখে অন্যান্য অভিভাবকরাও তাদের সন্তানদের ভালো ফল করার জন্য মানসিক চাপ দিতে থাকেন। তাদের পড়াশোনার সময় বাড়িয়ে দেন। কখনো কখনো মেধাবী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের তুলনা করে মৃদু থেকে কড়া তিরস্কারও করেন। এতে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা রোবটের মতো কেবল পাঠ্যবই মুখস্থ করতে বাধ্য হয়। তারাও সর্বান্তকরণে বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়, ভালো ও মেধাবী শিক্ষার্থীর অর্থই হলো পরীক্ষায় ভালো ফল করা। আর ভালো ফলের জন্য একমাত্র কাজই হলো পাঠ্যবই পড়া। পড়াশোনার বাইরে খেলাধুলা করা, সংগীতচর্চা করা, শরীরচর্চা করা, সামাজিক রক্ষার স্বার্থে বিভিন্ন সভা-সেমিনারে যাওয়াকে তারা সময়ের অপচয় মনে করে। কেননা তেমন ধারণাই তাদের মনে বদ্ধমূল করে দেন অভিভাবক ও শিক্ষকরাই।
আমাদের সমাজে বদ্ধমূল ধারণাই এমন যে, ইঞ্জিনিয়ারিং ও মেডিকেলে যারা পড়ে, তারা মেধাবী। বাকিরা মেধাহীন। অর্থাৎ মেধাবীদের মধ্যে কেবল চিকিৎসক ও প্রকৌশলীদের গণ্য করা হয়। বাদ বাকি পেশা যেমন বিচারক-আইনজীবী-সামরিক বাহিনীর সদস্য, পুলিশ বাহিনীর সদস্য, সরকারি-বেসরকারি অন্যান্য চাকরিজীবী, শিক্ষক, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তাদের মেধাহীন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই বিবেচনার মধ্যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা হয়তো আছে, কিন্তু বৈজ্ঞানিক কিংবা যৌক্তিক কোনো কারণ নেই।
বিষয়টি নিয়ে গত ১৭ মার্চ (রোববার) সকালে গোপালগঞ্জে জাতির পিতার সমাধি সৌধ প্রাঙ্গণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও কথা বলেছেন। লেখাপড়ার নামে শিক্ষার্থীদের ওপর অতিরিক্ত চাপ না দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে অভিভাবক ও শিক্ষকদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘খেলাধুলা ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা যেন শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। লেখাপড়া খুবই দরকার কিন্তু এই লেখাপড়ার নামে তাদের ওপর কোনো চাপ সৃষ্টি করবেন না।’
আমাদের মনে রাখতে হবে—প্রধানমন্ত্রীর এই আহ্বান নিছক সরকার প্রধানের আহ্বান নয়। তিনি একজন প্রবীণ নাগরিকও। ফলে তার প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারও সমৃদ্ধ। তিনি প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতার আলোকেই শিক্ষাবিষয়ক এই আহ্বান জানিয়েছেন। ফলে আমাদের অভিভাবক ও শিক্ষকদের এখন থেকে ভাবতে হবে—শিক্ষা কেবল গ্রন্থগত বিদ্যার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা উচিত নয়। প্রকৃত বিদ্যা তথা জ্ঞানার্জনের জন্য শিক্ষার্থীদের মানসিক সুস্বাস্থ্য ও শারীরিক সুস্বাস্থ্যের দিকে অভিভাবক ও শিক্ষকদের মনোযোগী হতে হবে। শারীরিক-মানসিক সুস্বাস্থ্যের জন্য কেবল পুষ্টিকর খাবারই যথেষ্ট নয়, এর সঙ্গে জরুরি খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ততা বাড়ানো। বিভিন্ন পারিবারিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে শিক্ষার্থীদের যুক্ত করার মাধ্যমে তাদের মনে শৈশব-কৈশোর থেকেই দায়িত্ববোধ জাগিয়ে তুলতে হবে। একইসঙ্গে মেধা সংক্রান্ত বদ্ধমূল ধারণার অহংবোধকে ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিতে হবে। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হলেই কেবল মেধাবী হয় না, সমাজের আরও যে দশ পেশা-শ্রেণি রয়েছে, তারাও সমান মেধাবী।
তাদের বোঝাতে হবে প্রত্যেক পেশার মানুষের কাজ আলাদা আলাদা। যেমন কৃষকের কাজ কৃষক করবেন, তার কাজ চিকিৎসক করলে তিনি অকৃতকার্য হবেন। আবার মৎস্যজীবীর কাজ মৎস্যচাষ ও ধরা, সেই কাজ প্রকৌশলী করতে গেলে তিনিও সফল হবেন না। সুতরাং আমাদের মনে রাখতে হবে স্ব-স্ব পেশার প্রত্যেক সফল মানুষই মেধাবী। বিশেষ কোনো পেশার মানুষ কম বা বেশি মেধাবী কিংবা মেধাহীন হতে পারেন না। অতএব পাঠ্যবই পাঠের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে শিক্ষার্থীদের যুক্ত করেই তাদের বিদ্যার্জনকে পরিপূর্ণতা দেওয়া হোক। তবেই পুরো জাতি মেধাবী ও মানবিক জাতিতে পরিণত হবে, জনগণ হয়ে উঠবে মানবসম্পদ।
লেখক: কবি-গবেষক-সাংবাদিক