মীনা কার্টুনে ভাই বোনের খাবার ভাগাভাগির কথা মনে আছে? রাজু ছেলে বলে বেশি খাবার পাচ্ছে। আর মীনা মেয়ে, তাকে বাবা-মা কম খাবার দিচ্ছে।
ভার্সিটির ক্লাসে আমার এক শিক্ষক বলেছিলেন, তিনি কখনো তার বোনেদের মাছ বা মাংস খেতে দেখেননি। তিনি নিজেই শুধু খেতেন, কিন্তু ওই বয়সে বোনদেরও এসব খেতে বলতেন না। বোনেদের ভালোবাসার নজির হিসেবেই এসব উদাহরণ তিনি আমাদের সামনে উপস্থাপন করতেন, কোনো অনুশোচনা থেকে নয়!
দেখবেন, মায়েরা মাছ মাংসের বড় টুকরো নিজেরা খান না। নিজে রান্না করলেও, নিজে খান না। পরিবারের পুরুষদের জন্য তুলে রাখেন। পুরুষেরা তৃপ্তিসহকারে খান, কিন্তু ঘরের নারী হাড্ডিগুড্ডি আর মাছের কাঁটা চিবিয়েই খুশি থাকছে কিনা, সে খবর কবে কে নিয়েছে?
মেয়েদের এক সময় স্কুলে পাঠানো হতো না। মনে করা হতো, মেয়ের শিক্ষার জন্য টাকা খরচ মানে লস প্রজেক্ট। কিছুদিন পরে যেহেতু মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিতে হবে! পরে স্কুলে উপবৃত্তি চালু হলে শুধু ওই টাকার জন্যই মেয়েদের স্কুলে পাঠানো হতো, শিক্ষার উদ্দেশ্যে নয়। টাকাটা দরকার, মেয়ের বিয়ের যৌতুকের জন্য।
এখনো নারীর উচ্চশিক্ষার জন্য পরিবার থেকেই অনীহা। বিয়ের পর মেয়ে অন্য পরিবারের হয়ে যাবে, তাই তার পেছনে যত কম অর্থ খরচ করা যাবে, ততই ভালো।
পুত্র ও কন্যা উভয় সন্তানের জন্যই একই রকম অর্থ বিনিয়োগ করা হলেও, অনেক সময় শুধু কন্যাটিকেই কথাটি বারবার পরিবার থেকে মনে করিয়ে দেওয়া হয়। কেন না, কন্যা সন্তানের জন্য বিনিয়োগ করার কথা তো ছিল না!
খাদ্য, শিক্ষার পর আরেক মৌলিক চাহিদা, চিকিৎসা। নারীদের চিকিৎসা মানে চিকিৎসার খরচ দিতে পরিবারের পুরুষের আরেক উদাসীনতার চিত্র দেখা যাবে। যেখানে বাংলার প্রবাদ রয়েছে, ‘দুর্ভাগার গরু মরে, আর ভাগ্যবানের মরে বউ’, সেখানে বিনা চিকিৎসায় স্ত্রী মারা গেলে নতুন বিয়ের সম্ভাবনা পুরুষ কেন হারাতে চাইবে? নারীরা দিনের পর দিন রোগে ভুগে কষ্ট পেলেও পরিবারের পুরুষদের উদাসীনতার কারণে চিকিৎসা পান না। বিশেষ করে জরায়ু বা স্তন ক্যানসারের মতো সংবেদনশীল রোগের বেলায় নারীদের অবস্থা এখনো ‘বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না’। পৃথিবীর সব লজ্জা, ভয়, সংকোচের ভার থাকতে হবে শুধু নারীরই। পুরুষ যৌন হয়রানি করে এলেও রাস্তার মাঝখান দিয়ে বুক ফুলিয়ে নির্লজ্জের মতো চলবে, এটাই নিয়ম।
ধান ধানতে একটু শিবের গীত গেয়ে ফেললাম। থাক, তার চেয়ে বরং মূল প্রসঙ্গে ফিরে যাই। এ বছরের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে, ‘নারীর জন্য বিনিয়োগ, উন্নয়নের নিয়ামক।’ জীবনের মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রেই নারীর জন্য পরিবার থেকে অর্থ বিনিয়োগে কত অবহেলা, অনীহা, অনিচ্ছা। নিজ পরিবারেই দেখবেন, নারীকে উত্তরাধিকার বুঝিয়ে দিতে কত উদাসীনতা। নারী সম্পত্তির ভাগ যেন না পায়, সেজন্য ‘সম্পত্তি বেহাত হয়ে যাওয়া নিয়ে’ কতই না মনগড়া কথা! এমন অবস্থায় নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে বড় বড় কথা হাস্যকরই বটে। তারচেয়ে নারীবাদ ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, উভয়তন্ত্রই ব্যস্ত থাকুক নারীর পোশাক, নারীর সিগারেট খাওয়া সংক্রান্ত গরম গরম ইস্যু নিয়ে।
লেখক : শিক্ষক ও লেখক