৭ মার্চ ও মুক্তিসংগ্রাম

দীপংকর গৌতম প্রকাশিত: মার্চ ৭, ২০২৪, ১২:৩৯ পিএম

১৯৪৭ সালে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে দেশভাগ হলে গঠিত হয় ভারত পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্র। তারপর পাকিস্তানিরা শাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। শুরু হয় শাসন ত্রাসন। সন্দেহ নেই যে পাকিস্তান তৈরির পেছনে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর যুক্তিতে সায় দিলেও পূর্ববঙ্গের মুসলিমরা কখনই তাদের বাঙালি জাতিসত্ত্বা এবং স্বাধীনভাবে নিজেদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করেনি। কিন্তু সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণে  দ্রুত কেন অস্থির হয়ে পড়েছিলো বাঙালিরা? কেন পাকিস্তান সৃষ্টির দুই দশক না যেতেই বাঙালি জাতিসত্ত্বা নিয়ে তাদের আবেগ, আকাঙ্ক্ষার বাঁধ ভেঙে পড়েছিল।

কারণ, এক কথায় বলতে গেলে, বৈষম্য ও শোষণ। পাকিস্তান আন্দোলনের শীর্ষ নেতারা যেহেতু দেশের পশ্চিমাংশে ঘাঁটি গাড়েন, শাসন ক্ষমতাও সেখানেই কুক্ষিগত হয়ে পড়ে; যদিও পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশ। সেই সাথে শুরু হয় রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, শিক্ষা, প্রশাসন, প্রতিরক্ষাসহ সমস্ত ক্ষেত্রে দেশের অন্য একটি অংশের নাগরিকদের প্রতি পদে পদে বৈষম্য। যেখানে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের দুই অংশে মাথাপিছু আয় ছিল সমান, ১৯৭১ সালে পশ্চিমের মানুষের আয় পূর্বের প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানে বিনিয়োগের অভাবে শত শত স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে, কিন্তু পশ্চিমে বেড়ে গেছে তিন গুণ। গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদে, সেনাবাহিনীর উঁচু পদে বাঙালিদের নিয়োগ পাওয়া খুব কঠিন ছিল। সেই সঙ্গে বিনিয়োগে অবহেলার কারণে পূর্ব পাকিস্তানে হয়ে উঠেছিল পশ্চিমের কল-কারখানার কাঁচামালের যোগানদাতা এবং তাদের উৎপাদিত পণ্যের প্রধান ক্রেতা।

যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সংস্থা ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ ব্রুস রিডেল তার ‘ডেডলি এমব্রেস‘ বইতে লিখেছেন, পাকিস্তান সৃষ্টির প্রথম থেকেই পাকিস্তানের কাছে বাংলার গুরুত্ব ছিল দ্বিতীয় এবং বাঙালিদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে দেখা হতো। মি. রিডেল, যিনি একসময় মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএর বিশ্লেষক হিসেবে কাজ করেছেন, তার বইতে লিখেছেন, প্রথম থেকেই পাকিস্তানের শাসনক্ষমতার ভরকেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ পাঞ্জাব রাজ্যের হাতে চলে যায় এবং সেই একচ্ছত্র প্রাধান্য ধরে রাখার চেষ্টা পাকিস্তানের জন্য কাল হয়ে যায়—“প্রথম থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানে পাঞ্জাব প্রদেশের একচ্ছত্র দৌরাত্ম্য ছিল। পাকিস্তানের ওই অংশে সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যা ছিল পাঞ্জাবে। সবচেয়ে বেশি উর্বর কৃষি জমি ছিল সেখানে। সবচেয়ে বড় কথা সেনাবাহিনীতে সবচেয়ে বেশি প্রতিনিধিত্ব ছিল পাঞ্জাবের। অনেক পাঞ্জাবি সেনা কর্মকর্তা মনে করতেন, পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছে তাদের স্বার্থ রক্ষায়। তাদের অনেকেই বাঙালিদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক মনে করতেন, মনে করতেন বাঙালিদের লড়াই করার ক্ষমতা নেই।“

মার্কিন ওই গবেষক আরও লিখেছেন, “সেনাবাহিনী এবং আমলাতন্ত্রে পাঞ্জাবিদের আধিপত্য কায়েম হওয়ায় কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমাংশের উন্নয়নের দিকে প্রধান নজর দিল। পূর্ব পাকিস্তানকে একরকম উপনিবেশ হিসাবে দেখা শুরু হয়।”

পাকিস্তানের স্বাধীনতার পরের ২৫ বছর সেই প্রভুসুলভ মনোভাবের প্রতিফলন দেখা গেছে পদে পদে। সেইসঙ্গে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে বাঙালি জনগোষ্ঠীর দূরত্ব ক্রমাগত বেড়েছে এবং বাঙালিদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী মনোভাব চাঙ্গা হয়েছ। ১৯৭১ সালে এসে পূর্ব পাকিস্তানে ২৪ বছরের আগের তুলনায় প্রাইমারি স্কুলের সংখ্যা কমে যায়। অথচ পশ্চিমে ১৯৬০ এর দশকে এসেই প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যা তিনগুণ বেশি হয়ে যায়। এতো গেল বৈষম্যের এক রূপ, এরপরই আসে ভাষা আগ্রাসনের বিষয়। পাকিস্তান জন্ম হওয়ার পর থেকেই তার ৫৬ ভাগ বাঙালির ভাষা রুদ্ধ করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। যার বদৌলতে ১৯৪৮ সাল থেকেই রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে লড়াই শুরু হয়। বাঙালিদের ন্যায্য আন্দোলনের দাবি থামাতে মিছিলে গুলি বর্ষণ হয়। ১৯৫২ সাল হয়ে ওঠে বাঙালির স্বাধীনতার প্রথম সোপান। এরপরই ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনে শরিফ কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে ভয়াবহ আন্দোলনে তেঁতে ওঠে বাঙালি। শরীফ কমিশনের রিপোর্ট ছাত্ররা অস্বীকার করেন। 

তারপর ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান থেকে ১৯৭০ সালের নির্বাচনী প্রেক্ষাপট সবারই জানা। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সংখ্যা গরিষ্ঠ আসন লাভ করে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টিতেই জয়ী হয় দলটি। এই নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ ১৯৭১ জাতীয় পরিষদ অধিবেশন বসার ঘোষণা দেন। কিন্তু পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং পাকিস্তানের সামরিক শক্তি আওয়ামী লীগের হাতে ন্যায্য রাষ্ট্রক্ষমতা ছেড়ে না দেওয়ার জন্য নানা ষড়যন্ত্র করতে থাকে। পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতির এদিন জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেওয়ার কথা ছিল। সমগ্র জাতি উৎসুক হয়ে চোখ-কান খোলা রেখেছিল টিভি ও রেডিওর দিকে। কিন্তু ইয়াহিয়া খানের বদলে আরেকজন মুখপাত্র ঘোষণা দিলেন, ‘প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পরবর্তী ঘোষণার আগ পর্যন্ত জাতীয় অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেছেন, পাকিস্তান এখন গভীর রাজনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে রয়েছে।’

এই ঘোষণা বঙ্গবন্ধুকে ভীষণ ক্ষুব্ধ করে। তিনি বাঙালির স্বাধীনতার ডাক দেন। সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেন, কোনো রাজনৈতিক সঙ্কট নয়, বরং পাকিস্তানি শাসকরা একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার ষড়যন্ত্র করছে। তিনি ২ ও ৩ মার্চ দেশব্যাপী হরতালের ডাক দেন। পরবর্তীকালে বাঙালিরা প্রথমবারের মতো স্বাধীনতার স্লোগান দিতে থাকে: ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ প্রভৃতি। স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়।

এক দিকে হরতাল, মিছিল আর অন্যদিকে কারফিউ, সব মিলিয়ে ঢাকা শহর চরম উত্তপ্ত ছিল এ দিন। ভোর থেকেই মিছিলের পর মিছিল নিয়ে মুক্তিকামী মানুষেরা জড়ো হতে থাকেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছাত্রদের এ রকম সমাবেশ এর আগে আর দেখা যায়নি। নিউ মার্কেট থেকে নীলক্ষেত হয়ে পাবলিক লাইব্রেরি পর্যন্ত ছড়িয়ে যায় ভিড়।

ছাত্রলীগের নেতৃত্বাধীন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওড়ায়। লাঠি ও রড হাতে সারা ঢাকায় চলতে থাকে বিশাল মিছিল।এ দিন এই ভূখণ্ডে বাঙালির অভিধান থেকে ‘পাকিস্তান’ শব্দটি মিলিয়ে যেতে শুরু করে। সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বারবার জোর দিয়ে ‘বাংলাদেশ’ উচ্চারণ করতে থাকেন।

সরকারের লেলিয়ে দেওয়া গুণ্ডারা আন্দোলনরত সাধারণ মানুষের ওপর আক্রমণ করে। আহত অন্তত ৫০ জনকে ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তেজগাঁও পলিটেকনিক কলেজের ছাত্র আজিদ মোরশেদ ও মামুন গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করানোর পর মারা যান। পরবর্তী ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭টা থেকে ভোর ৭টা পর্যন্ত কারফিউ ঘোষণা করে সামরিক সরকার। নিরীহ মানুষকে হতাহত করায় বঙ্গবন্ধু সন্ধ্যার সংবাদ সম্মেলনে সরকারের কঠোর সমালোচনা করেন। ৩ মার্চ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত দেশব্যাপী ধর্মঘটের ডাক দেন তিনি। পরের দিন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে সভা শেষে পল্টনে র‌্যালি করার কর্মসূচি ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু।

নিহতদের স্মরণে শোক দিবস পালন করা হয়। ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগের সঙ্গে সভায়, প্রধান অতিথি হিসেবে বঙ্গবন্ধু দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন, “আমি থাকি কিংবা না থাকি, বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম থামবে না। বাঙালির রক্ত বৃথা যাবে না। আমি না থাকলে, আমার সহকর্মীরা নেতৃত্ব দেবে। যদি তাদেরও মেরে ফেলা হয়, তাহলে যারা বেঁচে থাকবে, তারা নেতৃত্ব দেবে। যেকোনো মূল্যেই সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।”

বঙ্গবন্ধু জানান, ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের ভাষণে তিনি পরবর্তী নির্দেশনা দেবেন। অন্যদিকে দেশে তখন তপ্ত আগুনের মতো জ্বলছে। কারফিউ ভেঙে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন। চরম উত্তপ্ত হয়ে ওঠে দেশ। স্বাধীনতার স্বপ্ন আরও তীব্র হয়ে ওঠে। খুলনায় বাঙালি-অবাঙালিদের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে। লাগাতার হরতাল ও ধর্মঘটে পুরো জাতি একাট্টা হয়ে ওঠে। পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদের নেত্রী কবি সুফিয়া কামাল ও মালেকা বেগম যৌথ বিবৃতিতে ৬ মার্চ বায়তুল মোকাররম এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল করার ঘোষণা দেন। ‘রেডিও পাকিস্তান ঢাকা’র নাম বদলে ‘ঢাকা বেতার কেন্দ্র’ রাখা হয়। ৬ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান টেলিফোনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলেন। শাসকদের পক্ষে ঘোষণা করা হয়, জাতীয় পরিষদ অধিবেশন বসবে ২৫ মার্চ, ঢাকায়। এ রকম পরিস্থিতিতে কোণঠাসা হয়ে পড়া পূর্ব পাকিস্তান মিলিটারির সদস্যরা ৭ মার্চের ভাষণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা না করার জন্য বিভিন্ন রকমের বার্তা বঙ্গবন্ধুকে দেওয়ার চেষ্টা করেন। ৭ মার্চের র‌্যালি মাথায় রেখে রাস্তায় সামরিক ট্যাংক প্রস্তুত রাখে পাকিস্তানি শাসকরা। মেজর সিদ্দিক সাদিক তার বইয়ে লিখেছেন, “এদিন বঙ্গবন্ধুকে ইস্ট পাকিস্তানের জিওসি স্পষ্টই হুমকি দিয়েছিলেন, পাকিস্তানের অখণ্ডতার বিরুদ্ধে যদি কিছু বলা হয়, সামরিক বাহিনী কঠোর জবাব দেবে। দেশদ্রোহীদের (বাঙালিদের) উড়িয়ে দেওয়ার জন্য ট্যাংক, কামান, মেশিনগান—সব প্রস্তুত আছে। দরকার হলে পুরো ঢাকা শহরকে ধূলিতে মিশিয়ে দেওয়া হবে। সব পরিস্থিতিকে সামনে রেখেই একটি জাতি জন্মের জন্য তৈরি থাকলো। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের বক্তৃতার ইতিহাস তো আলাদাই, তাকে মানুষ কীভাবে একটি বক্তৃতার মধ্য দিয়ে উজ্জীবিত হয়, কীভাবে হাজার বছরের সংগ্রামের আকাঙ্ক্ষা স্বাধীনতার জন্য উদ্বেলিত হয় তা এ বক্তৃতা ছাড়া বোঝা অসম্ভব। একটি বক্তৃতা একটি জাতীয় মুক্তির সংগ্রামকে কীভাবে ত্বরান্বিত করতে পারে ৭ মার্চের বক্তৃতা যার উদাহরণ।