ঢাকা শহরের বাতাসে পোড়া লাশের গন্ধ, আর ফেসবুক-জুড়ে আহাজারি। শিক্ষার্থীরা জানাচ্ছেন যে কারও প্রিয় শিক্ষক মারা গেছেন, কারও ভাবি মারা গেছেন। কেউ স্মৃতিচারণা করছেন যে এই বিল্ডিংয়ে প্রতিটি ফ্লোরে বাচ্চাদের নিতে খেতে গেছেন, জন্মদিনে অনুষ্ঠান করেছেন। মানুষের সঙ্গে তার জায়গার সম্পর্ক নিবিড়। ফলে আজকের পোড়া বিল্ডিংটার সঙ্গে অনেকের অনেক কিছুই পুড়ে গেছে, সারা জীবনের মতো।
আপনাদের নিশ্চয়ই মনে পড়ে, গত এক দশকে ঢাকাতে খাবারের দোকানের একটি বিপুল পরিবর্তন ঘটেছে। রুফ-টপ রেস্টুরেন্ট, বাহারি দেশি-বিদেশি খাবারের দোকানে উপচে পড়তে থাকে মানুষ। উপচে পড়েছে শহরটাই। এত খাওয়া লাগে আমাদের? প্ল্যাটার আর বুফের অফারে নাগরিকরা খুঁজে পান বিনোদনের কেন্দ্র। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় শুরু হয় ভার্টিক্যাল সিস্টেমে একই বিল্ডিংয়ে নানান রকমের খাবারের দোকান। জনসংখ্যার চাপ আর বিনোদনের অভাবের দোহাই দিয়ে বাড়তে থাকে বিল্ডিংয়ের সংখ্যা। এই প্রবণতা ছড়িয়ে পড়ে পুরো দেশে। জেলা শহরগুলোতেও এর প্রমাণ মিলবে। ঠিক এই সময়টাতেই আমার মনে হতে শুরু করে যে একটা বিল্ডিংয়ের ওপর এত চাপ দেওয়া কি ঠিক হচ্ছে? বিল্ডিংগুলো কিন্তু ছোট ছোট ভার্টিক্যাল শহর। এই শহর কি নিরাপদ?
নাগরিক দাওয়াত রক্ষার তাগিদে আমি আর আমার বন্ধু নামছিলাম এমনি ভার্টিক্যাল বিল্ডিং থেকে। লিফট উপচে পড়ছিল বলে সিঁড়িই ভরসা। বারোতলা থেকে নিচে নামতে নামতে দেখছিলাম এই সিঁড়িঘরগুলোর এক একটা তলা দুর্গন্ধে ভরা, একপাশে ময়লার স্তূপ আর তার পাশেই এলপিজি বা গ্যাস সিলিন্ডারের সারি। ক্লান্ত কর্মীরা দু-দণ্ড বিশ্রামের জন্য সিগারেট ফুঁকছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের সুসজ্জিত পোশাক আর মুখ নিয়ে ফেরত যেতে হবে আর সুসজ্জিত রেস্টুরেন্টে।
এই দৃশ্যপটই পরিষ্কার করে দেয়, রেস্টুরেন্টগুলোর আসলে বিল্ডিংগুলোর দ্বৈত-চেহারাকে। কোনো বিশেষ পক্ষকে দোষ দেওয়ার আগে আমি বলতে চাই যে কাঠামোগতভাবেই এই পরস্পর বিরোধিতার ওপর দাঁড়িয়ে আছে ভার্টিক্যাল বিনোদন। মানে একদিকে বিরাট কিচেন, বিদেশি শেফ, দারুণ ইন্টেরিয়র, নতুন নতুন খাবারের মেনু; ঠিক তার পেছনেই আছে অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ, অনিরাপদ ব্যবস্থাপনা। প্রতি ফ্লোরে যদি আপনি সম্ভাব্য বোমার আয়োজন করে রাখেন, তাহলে কোনো না কোনো দিন বিস্ফোরণ হবেই। আরবান প্ল্যানাররা এসবকে নগরায়ণ বলেন কি না জানি না, তবে আমার কাছে এগুলোকে বস্তিই মনে হয়। না, বস্তিকে ছোট করছি না। ঢাকা শহরে যখন নিয়মিত পরিচিত বস্তিতে আগুন লেগে মানুষ মারা যায় তখন মধ্যবিত্তের কষ্ট আর বেদনার মধ্যে একধরনের স্বস্তিও থাকে যে তারা হয়তো এর বাইরে, নিরাপদ বলয়ে। এমনটা দেখি গার্মেন্টসগুলোতে আগুনের ঘটনায় দগ্ধ কর্মীর অঙ্গার হওয়া লাশের ক্ষেত্রেও। আমার এক শিক্ষার্থী লিখেছেন, “কত্তগুলা জান বেঁচে যেত যদি তারা রেস্টুরেন্ট এর গেট বন্ধ না রাখত।” কারা গেট বন্ধ রাখেন? কেন রাখেন? কেন খোলা রাখার কথা মনে হয় না? আগুনে তো সব শ্রেণি পুড়ে একাকার হয়ে গেল।
আগুন আসলে ছড়িয়ে পড়েছে সব শ্রেণিতেই। বহুতল ভবনগুলোর মুখগুলো সুন্দর হলেও মেরুদণ্ডগুলো নোংরা, সারি সারি বোমা সাজানো, সিঁড়িগুলো আটকানো, অতিরিক্ত কাজের চাপে ক্লান্ত কম বেতনের সার্ভিস ব্যক্তিরা, বিল্ডিংয়ের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রায় নেই বললেই চলে। গ্যাসের লাইন, বিদ্যুতের লাইন, পানির লাইন, তার আর নানাবিধ বর্জ্য দিয়ে ভরা। মেইনটেনেন্স শব্দটি কোথাও অস্তিত্বশীল কি? কাদের জন্য এগুলো নিশ্চিত করার কথা? তারা কি পরিমাণ দুর্নীতি করেন? শহরের এই যে ভার্টিক্যাল ওঠার প্রবণতা সেটাকে বোঝা যেতে পারে এভাবে-ক্রমাগতভাবে উঁচু থেকে উঁচুতে উঠবেন আর বর্জ্য, অব্যস্থাপনাগুলো নিচে ফেলে আসবেন বলে যারা ভাবছেন তারা নিচের মাটি, মানুষ, প্রাণ-প্রকৃতিকে ধ্বংস করার কথাই ভাবছেন আসলে। নিচে ভাগার তৈরি হলে উঁচু বিল্ডিংয়ে মুক্তি নেই। মুক্তি হলোও না। আগুন ধরে ফেলল এতগুলো মানুষকে। ফায়ার ব্রিগেডের উদ্ধারকর্মীদের অশেষ ধন্যবাদ তাদের তৎপরতায় অনেককেই বাঁচানো হয়তো গেল কিন্তু যারা খুন হলেন? ছুটির আগের দিনে যেই নাগরিকরা পরিবার নিয়ে কিংবা একা একটু খেতে গিয়েছিলেন, আড্ডা দিতে গিয়েছিলে তারা আর ফিরে এলেন না। ওনাদের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি। যদিও এটিও নিশ্চিত যে ওনাদের আত্মীয়স্বজন যারা বেঁচে রইলেন, তারা সারা জীবন জ্বলবেন। এইখানে আমি আপনি যে কেউই হতে পারতাম। এঁদের আমরা নাগরিক হিসেবে কি সান্ত্বনা দেব, সেটির ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না।
এই শহরে বসবাস করা একটি সারাক্ষণের নিরাপত্তাহীনতা। সুনাগরিক হওয়ার নানান উপদেশ যেমন আপনারা পেতে থাকেন এবার আপনাদের মনে হয় উচিত পাল্টা প্রশ্নগুলো করার। এই বিল্ডিং কি নিরাপদ? এই সড়ক কি নিরাপদ? কেন নয়? কারা দায়িত্বে আছেন? কি করছেন দায়িত্বে থেকে? আর একই সঙ্গে নতুন যেকোনো ট্রেন্ড, বিনোদনকেন্দ্র এসব দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়বেন না। নতুন কিছূ দেখলেই উত্তেজিত হয়ে উঠবেন না। সামনের কয়েকটা দিন পত্রিকায় কিছু লেখালেখি আর কিছু কমিটি গঠন করে হয়তো বিষটা থেমে যাবে এবং আপনারা আবার হারিয়ে যাবেন নতুন ট্রেন্ডে। তাতে বিপদ বাড়তেই থাকবে। আপনার অসচেতনতা, অতৎপরতা পরবর্তী বিপদের জন্য পথ তৈরি করবে।
আমি মনে করি ঢাকা শহরে এখনো অনেক পার্ক রয়েছে, যা জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। আমি হাতিরঝিলের উদাহরণ দিয়ে বলতে পারি, অনেক সুন্দর করেই এটি সাজানো। এই পার্কগুলো রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের, এগুলোকে সুন্দর ও নিরাপদ রাখার জন্য আমাদের আরও তৎপর হওয়া দরকার। মাঠ রক্ষা করার জন্য তৎপর থাকাও। ভার্টিক্যালে আমার ততটা বিশ্বাস নেই, যতটা আছে হরাইজন্টালে, তাই বরং চন্দ্রিমা উদ্যান, বোটানিক্যাল গার্ডেন আমার খুব প্রিয়। এগুলোর প্রতি যে বিরক্তি ও অনিরাপত্তার বোধ তৈরি করা হয়েছে সেগুলোকে প্রতিরোধ করতে হবে। বিল্ডিংয়ের ওপর আমি নির্ভর করতে নারাজ। বইমেলা হোক, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা হোক, পাবলিক টয়লেট হোক সবখানেই আপনাদের তৎপরতা লাগবে। এগুলো আপনার নাগরিক অধিকার। নিজেদের অধিকার নিয়ে কথা বলতে হবে। নাগরিকদের নিরাপত্তা, দালানগুলোর নিরাপত্তা, নাগরিকদের নিরাপত্তা আপনাদের মূল ইস্যু হওয়া দরকার। ঢাকা শহরে যে কনডোমেনিয়াম আর বহুতল ভবনের চল শুরু হয়েছে সেখানে ভার্টক্যাল সবকিছু নিয়েই প্রশ্ন তোলা দরকার। একদিনে ঢাকার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটবে না। একদিনে সব পরিবর্তন হবে না। আমাদের একই সঙ্গে হরাইজনটাল সবকিছুকে রক্ষা করা দরকার, বিস্তৃতি ঘটনো দরকার। আর দরকার আপনাদের আচরণ পরিবর্তন। কাঠামোগত পরিবর্তন চাইবেন কিন্তু আচরণ পরিবর্তন করবেন না, এমনটা হয় না। আপনারা যদি পার্কগুলোকে গুরুত্ব দেন, দেখবেন যে পার্কগুলো নিরাপদ হয়ে উঠছে, আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। আপনারা যদি ঝাকানাকা বিনোদনে ঝাঁপ না দেন, ক্রমাগত নিরাপত্ত নিয়ে প্রশ্ন করতে শুরু করেন দেখবেন যে যত্রতত্র বিল্ডিং বানিয়ে অনিরাপদ রাখার সাহস কেউ করছেন না।
ঢাকা শহরের প্রতিটি অংশ এক একটি মাইনফিল্ডে পরিণত হয়েছে। সেটিকে বসবাসযোগ্য করার জন্য আপনার আমার সবারই তৎপরতা দরকার। এই শহর কেবল ধনীদের শহর নয়, মধ্যবিত্তের শহর নয়, সবার শহর। যেসব দুর্নীতিবাজ মহা উল্লাসে বিদেশের নিরাপদ শহরে বাড়ি করছেন তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো তুলনা নেই। আমরা অদুর্নীতিবাজ অধিকাংশ। অতৎপর আর অসচেতন হলে পোড়া লাশ, থেঁতলানো দেহ নিয়ে আহাজারি করতে হবে আমাদের অধিকাংশকেই; কারণ এই আমরাই বিদেশের নিরাপদ শহরে পালিয়ে যেতে পারব না; আর যাবই-বা কেন?
লেখক : নৃবিজ্ঞানী ও সহকারী অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়