বিসর্জন: দেবী না দেশের?

আলম খোরশেদ প্রকাশিত: অক্টোবর ১৬, ২০২১, ০৩:০৬ পিএম

গত ১৫ই অক্টোবর, বিজয়া দশমীর দিনে অভূতপূর্ব এবং একইসঙ্গে অভাবিতপূর্ব এক মাতৃবিসর্জনের দৃশ্য প্রত্যক্ষ করলাম আমরা। অপমানিত, ক্ষতবিক্ষত এবং আক্ষরিক অর্থেই রক্তাক্ত দেহে ও মনে করুণতম এক বিসর্জনে গেলেন এবার দেবীদুর্গা; আর তাঁর সঙ্গে বিসর্জনে গেল গোটা বাংলাদেশ: তার আত্মা, আদর্শ, ইতিহাস, অর্জন, স্বপ্ন, সাধনা, সংবিধান সমস্তকিছু।

অনেকদিন ধরেই সেই পথে হাঁটছিল বাংলাদেশ, কিন্তু তা যে এমন বীভৎস ও নারকীয় চেহারায় আত্মপ্রকাশ করবে তার জন্য হয়তো বা আমরা কেউই প্রস্তুত ছিলাম না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশকে এমন অকল্পনীয় একটি ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে, অসহায়ের মতো চেয়ে চেয়ে দেখতে হয়েছে মানবিকতা, সম্প্রীতি, শুভ ও সুন্দরের চরম নিগ্রহ, তার ভূলুণ্ঠিত হওয়ার দৃশ্য। তা-ও কোন দিনটিতে? বাংদেশের অস্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ, এর যা কিছু গর্বের ও গৌরবের, অহংকার ও অর্জন তার সমান অংশীদার, লড়াই সংগ্রাম, হাসিকান্না ও সুখদুঃখের সাথী, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় আচার ও উৎসব বাৎসরিক দূর্গাপূজার সমাপনী তথা দশমীর দিনটিতে। এইদিনটিতে আসন্ন বিসর্জনের বেদনায় এমনিতেই ভক্তদের হৃদয়মন অন্তর্লীন বিষাদে ছেয়ে থাকে, এবার তার সঙ্গে যুক্ত হলো সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী, ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর সহিংস আক্রমণের তাণ্ডব, যার হাত থেকে খোদ দুর্গামাতাকেই রক্ষা করতে পারেননি তাঁরা, ‍নিজেদের জানমালের সুরক্ষা তো দূরের কথা।

এই নিয়ে এখন সংখ্যাগুরু, সংখ্যালঘু উভয় সমাজের সদস্যদের মধ্যেই, বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে চলছে আক্ষেপ, আহাজারি, ক্ষোভ, দুঃখ, অভিমান, আক্রোশ, সর্বোপরি প্রচ্ছন্ন কিংবা প্রত্যক্ষভাবে পারস্পরিক দোষারোপের পালা। পাশাপাশি এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান ও তার চুলচেরা ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ, আলোচনা, পর্যালোচনা তো রয়েছেই। সেটা স্বাভাবিক ও এক অর্থে স্বাস্থ্যকরও বটে, কেননা এর মাধ্যমে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হয়তো তার বেদনার ভার কিছুটা হালকা করার সুযোগ পাবে, তার ক্রোধের কিছুটা প্রশমণ ঘটবে; অন্যদিকে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের কিছু মানুষও যদি এতে আত্মসমালোচনায় ব্রতী হয় এবং তা থেকে এক ধরনের আত্মা-অনুসন্ধানের তাগিদ অনুভব করে তাতেও লাভ বৈ ক্ষতি নেই।

কিন্তু এই ঘটনায় সত্যিকার আত্মসমালোচনা ও আত্মা-অনুসন্ধান যদি করতে হয় কাউকে, সেটা এই সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্রকেই করতে হবে সবার আগে। এবং সেটা খুব প্রবল ও নির্মোহভাবেই করতে হবে। প্রথমত এই সহজ প্রশ্নটা করতে হবে তার নিজেকে যে, পূজা শুরুর আগে থেকেই এত এত লক্ষণ, ইঙ্গিত, হুমকি এবং বাস্তবেও বেশকিছু ঘটনা ঘটার পরও, বিশেষ করে কুমিল্লার সুপরিকল্পিত, ষড়যন্ত্রমূলক ঘটনাটি ও তার জের ধরে ঘটে যাওয়া তাণ্ডবের পরও কেন প্রশাসন সাবধান হতে এবং আঁটঘাট বেঁধে দেশের সর্বত্র যথাযথ, নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিতে পারলো না? শুধু তা-ই নয়, পরদিন চাঁদপুর ও তার পরদিন নোয়াখালিতেও যখন আক্রমণের পুনরাবৃত্তি হলো, তখনও কেন প্রশাসন তার সর্বোচ্চশক্তি প্রয়োগ করে তাকে অঙ্কুরেই থামিয়ে দিতে পারলো না; হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগের ঘটনা পর্যন্ত গড়াতে দিল? 

এর দুটো উত্তর হতে পারে। এক. রাষ্ট্রের প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কার্যত দুর্বল ও অক্ষম, এতটাই যে, দেশের সবচেয়ে বড় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসবের সময়ও তাদের নিরাপত্তা প্রদানে অপারগ এবং দুই.সর্ষের মধ্যেই ভূত ঢুকে বসে আছে, অর্থাৎ সমস্যাটিকে তারা দেখেও না দেখার, এবং এর গুরুত্বটুকু ‍বুঝেও না বোঝার ভান করছে, ফলত তাদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত দায়িত্বপালনে আমরা প্রভূত শৈথিল্য ও ব্যর্থতা দেখতেই পেয়েছি কেবল। এর একটাও যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্রকে এখনই গা ঝাড়া দিয়ে বসতে হবে এবং নিজের ঘর গোছানোর কাজটাই সবার আগে শুরু করতে হবে। এবং এটি তাকে তার নিজের অস্তিত্ব রক্ষার খাতিরেই করতে হবে।

কেননা তার তো এটা না বোঝার কথা নয় যে, কুমিল্লার ঘটনাটি স্পষ্টতই একটি সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের ফসল যার মূলে রয়েছে সরকারবিরোধী, রাষ্ট্রবিরোধী সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী একটি সুসংগঠিত ও শক্তিশালী অশুভচক্র, যারা তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সবচেয়ে সহজ ও দুর্বলতম লক্ষ্যবস্তু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কেই বেছে নিয়েছে, সেই সঙ্গে একটি অনগ্রসর, অশিক্ষিত ও পশ্চাতপদ সমাজের সবচেয়ে সহজ ও কার্যকর যে অস্ত্র, সেই ধর্মকেই ব্যবহার করেছে এবং ভবিষ্যতেও করে যাবে। সরকারকে এই ঘটনাটি থেকে অন্তত শেষবারের মতো শিক্ষাগ্রহণ করে শক্তহাতে এই অপশক্তিকে মোকাবিলা করতে হবে এবং তাকে চিরতরে নির্মূলের জন্য যা যা করণীয় তা-ই করতে হবে।

এই কাজে আর বিন্দুমাত্র বিলম্ব, দ্বিধা কিংবা শিথিলতা শুধু তার জন্য নয়, গোটা জাতির জন্যই ভয়ংকর পরিণাম ডেকে আনবে। এইজন্য সরকারকে স্বল্পমেয়াদে ও  দীর্ঘমেয়াদে অনেকগুলো কাজই করতে হবে। আপাতত কয়েকটি আশু করণীয় বিষয়ে তার মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্যই মূলত এই লেখার অবতারণা।

এক. কুমিল্লা, চাঁদপুর, নোয়াখালি, চট্টগ্রাম ও দেশের অন্যত্র যে সহিংস সন্ত্রাসের ঘটনাগুলো ঘটেছে তার সুষ্ঠু তদন্তশেষে অতি দ্রুত সমস্ত অপরাধীকে চিহ্নিত ও আটক করে, প্রয়োজনে দ্রুতবিচার আইনে, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা।

দুই. এইসব ঘটনায় নিহত, আহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করে প্রত্যেককে প্রয়োজনীয় ক্ষতিপূরণ ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করা। শুধু তা-ই নয়, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদেরকে স্ব স্ব এলাকায় দিয়ে প্রতিটি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সঙ্গে দেখা করে সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা ও ভবিষ্যতে তাদের সার্বিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা প্রদান করা।

তিন. নিজদলে এবং প্রশাসনের মধ্যে অবিলম্বে একটি সাংগঠনিক শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করা, যাতে করে সেখানে অনুপ্রবেশকারী স্বাধীনতাবিরোধী, দেশবিরোধী, সাম্প্রদায়িক শক্তির প্রতিনিধিকারীদের শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়।

চার. দলের অঙ্গসংগঠনগুলোতে বিশেষ করে ছাত্র, যুব ও নারী সংগঠনের সদস্যদেরকে নিয়মিত প্রাজনৈতিক শিক্ষা ও দেশনার ক্লাস পরিচালনা করা, যাতে করে তারা দেশের প্রকৃত ইতিহাস-ঐতিহ্য, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সাংস্কৃতিক বোধ, সর্বোপরি দেশপ্রেম ও মানবিক মূল্যবোধে বলীয়ান হয়ে উঠতে পারে।

পাঁচ. সম্প্রতি সরকারের একজন মন্ত্রী ও অরেক প্রতিমন্ত্রী যেরকম বলেছেন, বাহাত্তরের সংবিধানের চার মূল স্তম্ভ, বিশেষ করে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ বাস্তবায়নের উদ্যোগ ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতির মূলোৎপাটন করার পদক্ষেপ নেওয়া, সংসদের এই মেয়াদেই। এবং তারও আগে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রদ করে দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদেরকে নিজদেশে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের গ্লানিবোধ থেকে চিরতরে পরিত্রাণ দিয়ে তাদের মধ্যে এক ধরনের আস্থা ও ভরসার বোধ জাগিয়ে তোলা।

সবশেষে আমাদের নিজেদের তথা বৃহত্তর নাগরিক সমাজের প্রতি একটি আহ্বান: আসুন সবকিছু রাষ্ট্র ও সরকারের হাতে ছেড়ে না দিয়ে আমরাও আমাদের দায়িত্বটুকু পালন করি। দেশবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিটি যেমন তিলতিল করে সংগঠিত হয়ে, শক্তি সঞ্চয় করে নিজেদের বাণিজ্যপ্রতিষ্ঠান, প্রচারমাধ্যম, তথ্যপ্রযুক্তি ও সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে আজকে আমাদের রাষ্ট্রের খোদ ভিত্তিটিকেই চ্যালেঞ্জ করছে, আসুন আমরা প্রগতিশীল, ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীটিও তদ্রূপ সংগঠিত, সোচ্চার ও সক্রিয় হয়ে সমাজকে প্রকৃত শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিশ্বমানবিকতার আলোকে আলোকিত করে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করি। কেননা আমাদের প্রিয় রূপসী বাংলার কবির কাছ থেকেই তো আমরা জেনেছি, ’এই পথে আলো জ্বেলে- এ-পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে’।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক