২০২১ সালের দূর্গা উৎসবটাও বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক হামলার ইতিহাসে নতুন একটি তারিখ হিসেবে যুক্ত হয়ে গেল। এমন তারিখ, যদি রাতারাতি কোন জাদু না হয়, তাহলে ধারণা করা যায় আরো যুক্ত হবে সামনে। হতেই থাকবে। ভারত উপমহাদেশের এক অভিশাপের নাম সাম্প্রদায়িকতা। আর আশীর্বাদের নাম লালন কিংবা নজরুল। তবে এই আশীর্বাদ ধুয়েমুছে কোথায় চলে গেছে তার কোন সাকিন আজ আর পাওয়া যায় না। কারণ এদেশে এখন বাউল ভাস্কর্য যেমন মৌলবাদীদের হামলার শিকার হয়, তেমনি খোদ রাজধানীতে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবর অনাদর ও অবহেলায় পড়ে থাকে। ম্যুরাল বসালেও তা ভেঙে ফেলা হয়।
দুই একজন লেখক সাহিত্যিকের পক্ষে একটি জনগোষ্ঠীর ভেতর থেকে সাম্প্রদায়িকতা দূর করা সম্ভব নয়। সেখানে সরকারের বড় ভূমিকা রাখতে হয়। ভূমিকা রাখতে হয় গণমাধ্যমের। কিন্তু আশ্চর্যের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম এবারের ঘটনায় গণমাধ্যম যেন মূক ও বধির। ১৫ অক্টোবর যখন সারাদেশে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা দেবী বিসর্জনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন রাজধানীর বায়তুল মোকাররম মসজিদ থেকে হাজার হাজার মুসল্লী হুঙ্কার দিয়ে রাজপথে নেমে এল, সংঘর্ষে জড়াল এবং আহত হলো পাঁচ পুলিশ সদস্য। একইদিনে চট্টগ্রাম, নোয়াখালি, সিলেট সারাদেশের বিভিন্ন জায়গায় মন্দিরে হামলা হলো, মণ্ডপ ভেঙে দেয়া হলো, কোথাও কোথাও আগুন লাগান হল, হিন্দু বাড়িঘরে সমন্বিত আক্রমণ হলো, মারা গেল একজন।
ঘটনার শুরু বিজয়া দশমীর দুদিন আগে, কুমিল্লায়। অষ্টমীর দিন (১৩ অক্টোবর) সেখানে ভোরবেলা কে বা কারা মূল পূজামণ্ডপের বাইরে রাখা হনুমানের একটি মূর্তির কোলে মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআন শরীফ রেখে যায়। সেটা দেখে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। ছড়িয়ে দেয়া হয় মূর্তির পায়ে পবিত্রগ্রন্থ রেখে ধর্মের অবমাননা হয়েছে। সেটা শুনে দাবানলের মতো আগুন ছড়িয়ে পড়ে কুমিল্লায় ও কুমিল্লার বাইরে। এমনিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বেশ তৎপর থাকলেও এসব ঘটনায় তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়। যদিও এধরনের ঘটনা প্রতিবছরই বাংলাদেশে ঘটেই চলেছে।
যাহোক, কুমিল্লায় তো পূজা গুটিয়ে দেয়া হয়ই, তারই রেশ ধরে ওইদিন রাতেই চাঁদপুরে শুরু হয় জঙ্গী মিছিল। পুলিশ সেটা সামলাতে গিয়ে গুলি ছোড়ে, মারা যায় ৪ জন। এতে আরো বিক্ষুব্ধ হয় মুসল্লীরা। শুক্রবার জুমাবারকেই বেছে নেয়া হয় সারাদেশে হিন্দুদের উপাসনালয় ও আবাসস্থলে হামলার দিন হিসেবে। আশ্চর্যজনকভাবে লক্ষ্য করা গেলো এতকিছু ঘটে যাচ্ছে অথচ বাংলাদেশের বড় বড় টেলিভিশন ও পত্রিকা তারা সকলেই নিশ্চুপ। যেন সারাদেশে আনন্দের সাথে পূজা পালন হচ্ছে। কোথাও কোন সমস্যা নেই। সবাই হঠাৎ করে একযোগে বিটিভি হয়ে গেল। উটপাখির মতো এমন আচরণে দেশের জনগণ যারপরনাই বিস্মিত বোধ করেছে। কিসের ভয় তাদের? এটা কি সরকারের সম্মান রক্ষার চেষ্টা? প্রচার না করলেই কি হামলা বন্ধ হয়ে যাবে? হয়েছে? অষ্টমীর দিন যে ঘটনা ঘটলো সেদিনের খবরও তো হত্যা করেছিল এসব গণমাধ্যম। দশমীর দিন দেশজুড়ে সংঘবদ্ধ হামলা কি তাতে ঠেকানো গেছে। উল্টো মানুষ প্রথমসারির গণমাধ্যমে খবর না পেয়ে বিভ্রান্ত হয়েছে। এই সুযোগে গুজবেরও ডালপালা ছড়িয়েছে। প্রযুক্তির এই যুগে কেউ খবরকে চাপা রাখতে পারে না।
নেটফ্লিক্সে ‘ব্ল্যাক মিরর’ সিরিজের একটি পর্ব ‘দ্য ন্যাশনাল অ্যান্থামে’ও গণমাধ্যমের এমন ত্রিশঙ্কু অবস্থা দেখা যায়। ব্রিটিশ রাজপরিবারের একজনকে অপহরণ করা হয়েছে এবং তাকে জীবন্ত ফিরে পেতে প্রধানমন্ত্রীকে একটি জঘন্য কাজ প্রকাশ্যে করতে হবে। বিষয়টি আবার ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে ইউটিউবে। গণমাধ্যম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের চাপে পড়ে খবরটি আর ‘হত্যা’ করতে পারেনি। কিন্তু বাংলাদেশের গণমাধ্যম সফলভাবেই এত বড় সাম্প্রদায়িক ঘটনার খবরকে ‘হত্যা’ করেই চলেছে। ভাগ্যিস বাংলাদেশে কয়েকটি হাতে গোনা ভালো অনলাইন নিউজ পোর্টাল আছে। তারা দায়িত্বের সঙ্গে যাচাইবাছাই শুধু নয়, কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে, তাদের বক্তব্যসহ খবরটি প্রকাশ করেছে। নিজেদের প্রতিবেদককে পাঠিয়ে দিয়েছে ঘটনাস্থলে। বড় বড় গণমাধ্যমের জন্য এসব ছোট ছোট নিউ মিডিয়া ভবিষ্যতে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে, যদি তারা এভাবে নিজেদের উটপাখিতে রূপান্তর করতে থাকে।
এবার যদি ঘটনাটিকে ভিন্নদিক থেকে দেখি, তাহলে দেখব এসব সাম্প্রদায়িক হামলায় যারা অংশ নিয়েছে তাদের অধিকাংশই তরুণ। তাদের ভেতর কোন না কোনভাবে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপিত করা হয়েছে। আর একারণেই এক ডাকেই তারা জড়ো হয়ে যায় হামলার জন্য। অসাম্প্রদায়িক আচরণ যেমন চর্চার বিষয়, তেমনি সাম্প্রদায়িকতাও এক চর্চার বিষয়। যে চর্চায় বিদ্বেষ থাকে, থাকে প্রতিবেশীর প্রতি বিষ ধারণ। সামাজিকভাবে শুধু নয়, রাজনৈতিকভাবে নির্বিষ প্রক্রিয়া শুরু না হলে সাম্প্রদায়িকতার আগুনে শুধু সংখ্যালঘু নয়, সংখ্যাগুরুরাও ছাই হয়ে যাবে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, এই অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক দাঙার একটি বড় ফায়দা ঘরে তোলে রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা। ভোটের রাজনীতি, জাতীয়তাবাদী রাজনীতি, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান দখল, জায়গাজমি কবজা করে নেয়া এগুলোই মূলত পেছনের চালিকাশক্তি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে পূর্বের সাম্প্রদায়িক ঘটনাগুলোর বিশ্লেষণে। এখনো যে খুব একটা ভিন্ন কিছু ঘটছে তা নয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যে কোন সাম্প্রদায়িক হামলায় ডাক দিলেই এত লোক ঝাপিয়ে পড়ছে কেন? ঝাপিয়ে যেহেতু পড়ছে, বুঝতে হবে সামাজিকভাবে ও রাষ্ট্রীয়ভাবে মানুষের মনে অসাম্প্রদায়িক মনোভাব জাগাতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। বরং উল্টো, সাম্প্রদায়িক ভাবটাই জাগিয়ে রাখতে চেয়েছি আমরা। দুটো উদাহরণ দিলেই তা স্পষ্ট হবে।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এবং দেশটির সংবিধান শুরু হয় ওই একটি ধর্মের বাণী দিয়েই। অথচ রাষ্ট্র সকল ধর্ম, বর্ণ ও লিঙ্গের। যাক, এটি একটি উদাহরণ। আরেকটি উদাহরণ পাবেন আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায়। সেখানে দেখবেন ধর্মশিক্ষা বলে একটি বিষয় চালু রাখা আছে। এটি মূলত ‘আমরা ও তোমরা’ এই মন্ত্রই শেখায়। ধর্মের নামে বিভেদ শিক্ষা শুরু হয় শৈশবেই, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেই। শিক্ষকরাই বাচ্চাদের শেখান তোমার ধর্মটাই সেরা, অন্যরা গৌণ। এটা শিখতে শিখতেই তো বড় হই আমরা। তো আমাদের মনে সাম্প্রদায়িক মনোভাব থাকবে না তো অ্যামাজন জঙ্গলের বাচ্চাটার মনে থাকবে? কেন, একটি বইয়ের ভেতর নীতিনৈতিকতা ও সততা নিয়ে অধ্যায়ের পাশাপাশি বিভিন্ন ধর্ম ও দর্শন নিয়ে আলাদা আলাদা অধ্যায় থাকতে পারে না? সব শিক্ষার্থী এক বই থেকে সকল ধর্ম সম্পর্কে জানবে। এক বই থেকেই সকল ধর্মের মূল মর্ম শিখবে। তাতে শিক্ষার্থীরা অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শিখবে। ধর্ম সম্পর্কে তাদের নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠবে। শিখবে কি করে ভিন্ন মতের প্রতি সহিষ্ণু হতে হয়। আলাদা ক্লাসে বসে ‘আমরা-তোমরা’ শিখবে না!
একটি দেশ ও দেশের মানুষ যেন অসাম্প্রদায়িক হয়ে ওঠে, সেজন্য সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কোন বড় ধরনের পদক্ষেপ চোখে পড়ে কি এইদেশে? শুধু গুটি কয়েক মানুষ এসব নিয়ে কথা বলে। আজকাল কথা বলার গণতান্ত্রিক রীতিও রুদ্ধ প্রায়। যা-ও দুই একজন কথা বলত, তারাও কেমন চুপ হয়ে গেছেন। সব দেখি কল দেয়া পুতুল। গণমাধ্যম না হয় নিজেই নিজেকে কর্তন করে চুপ থেকেছে, কিন্তু বুদ্ধিজীবীদের কেন কোলের (অর্গানিক) বুদ্ধিজীবী হয়ে উঠতে হবে? তারাও দেখবেন কেমন মিনমিন করে ঘুরিয়ে কথা বলছেন। সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে তাদের কোথায় যেন ঠেকছে। সাম্প্রদায়িক হামলাকে তারা সাম্প্রদায়িক হামলা বলতে পারছেন না। এতোটা বাজে সময় বোধহয় বাংলাদেশে আর আসেনি। আমরা শঙ্কিত: আরো বাজে সময় বোধহয় সামনে আসছে।
লেখক: প্রধান নির্বাহী, সংবাদ প্রকাশ