ভাষার রাজনীতি, রাজনীতির ভাষা

ড. ফজলুল হক সৈকত প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২৪, ১২:৩১ পিএম

বাঙালির হাজার বছরের সংগ্রাম ও বিপ্লবের ইতিহাসে ১৯৫২ সাল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা প্রদানের দাবিতে যে অধিকারের সংগ্রাম, তা ছিল চেতনায় প্রোজ্জ্বল। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের দুটো চরিত্র আছে—একটি সাংস্কৃতিক, অন্যটি রাজনৈতিক। প্রথম দিকে এর সাংস্কৃতিক দিকটি বেশ স্পষ্ট প্রতীয়মান হলেও ধীরে ধীরে রাজনৈতিক প্রবাহটি সামনে এসেছে। বর্তমানে ‘বাংলা ভাষা চেতনা’ কেবল একটি রাজনৈতিক ‘খেলা’য় পরিণত হয়েছে। প্রায় সাত দশক সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পরও একুশের চেতনা একটি বিশেষ বোধের স্তরে পৌঁছাতে পারেনি; বরং জাতি বিস্ময়করভাবে বিচ্যুত হয়েছে।

তবে ভাষার রাজনীতিকীকরণের ফলে বাংলা ভাষার নাম ও পরিচিতি ছড়িয়েছে বিশ্বব্যাপী। ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে এর স্বীকৃতি নিশ্চয়ই বাঙালির জন্য বিরাট অর্জন। কিন্তু ভাষার চর্চা, ভাষা আন্দোলনের ভাব ও ঐশ্বর্যকে ধারণ এবং এর মূল স্রোতকে লালনের বিবেচনায় ভাষার রাজনীতি নেহাত রাজনীতির ভাষায় রূপ নিয়েছে। প্রথমত, আন্দোলনটি মাতৃভাষার জন্য ছিল না; ছিল রাষ্ট্রভাষার পক্ষে। মাতৃভাষা তো ছিলই; মানুষের মুখের ভাষা কেড়ে নেওয়া যায় না। রাষ্ট্রীয় কাজকর্ম যেন ওই ভাষায় চলে, সেটিই ছিল মূল কথা। ধীরে ধীরে রাজনৈতিক প্রভাবে সে সত্য থেকে আমরা দূরে সরে পড়েছি। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি (দিবস হিসেবে) পাওয়ার পর জাতিসংঘের মাধ্যমে বাংলা ভাষার চর্চাকে পৃথিবীর সব দেশের মানুষের কাছে সহজলভ্য করা যেতে পারতো—দূতাবাস কিংবা হাই কমিশনগুলোতে বাংলা ভাষার প্রশিক্ষক নিয়োগ দিয়ে সারা পৃথিবীর আগ্রহী লোককে বিনা মূল্যে বাংলা ভাষা শেখানোর মাধ্যমে এই আন্দোলনের সাংস্কৃতির রূপটিকে বাঁচিয়ে রাখা যেত। কিন্তু রাষ্ট্র কিংবা রাজনীতি সেভাবে ভেবে দেখেনি। ফলে এর আনুষ্ঠানিক চেহারাটি স্পষ্ট হলেও ভাব ও চেতনা প্রবাহটিতে মরিচা ধরেছে।

‘সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন’ একটি চমৎকার রাজনৈতিক এজেন্ডা। এই শব্দগুচ্ছ বক্তৃতার মঞ্চে, সাক্ষাৎকারে খুব কাজ দেয় বটে। লেখকের জন্যও এটি একটি উৎকৃষ্ট খোরাক। ইনিয়ে-বিনিয়ে অনেকবার, বহুবার এই কথাগুলো বলা যায়; বলে বলে নিজেকে ভাষার পক্ষের, দেশের পক্ষের শক্তি হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করা যায়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাবে, ফেব্রুয়ারি মাস ছাড়া সারা বছর সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রয়োগ নিয়ে কারও কোনো আগ্রহ থাকে না। শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা ভাষা এ দেশে এখনো উপেক্ষিত; বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে বাংলা ভাষায় রচিত বইয়ের অভাব রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সব বিষয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য’ শিরোনামে একটি আবশ্যিক কোর্স প্রবর্তনের জন্য বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন নির্দেশনা প্রদান করেছে বটে; কিন্তু  কয়েকটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এটি চালু করলেও কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এখন পর্যন্ত তা চালু করেনি। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হলো, ভাষা আন্দোলনের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এই কোর্সটি চালুর বিষয়ে কোনো উদ্যোগ বা ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। কোর্টে বিচারের রায় প্রকাশের ক্ষেত্রে আজও বাংলা ভাষার প্রয়োগ নিশ্চিত করা যায়নি।

বাংলা ভাষার চেতনা লালনে ও চর্চায়, বিশেষ করে, যে বাংলা একাডেমি দায়িত্ব পালন করে থাকে। কিন্তু দিনে দিনে সে প্রতিষ্ঠানও নানান বিবেচনায় তার ঐতিহ্য, সৌন্দর্য ও মর্যাদা হারাতে বসেছে। ভাষানীতি, বানান প্রমিতকরণ, বিশ্ববাজারে বাংলা সাহিত্যের বাণিজ্য-বিস্তার, গবেষণা ও প্রচার-প্রচারণায় বাংলা একাডেমি, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে, একধরনের অথরিটি হিসেবে কাজ করে। কিন্তু পাঠ্যপুস্তক রচনা, পত্রপত্রিকা প্রকাশ, টেলিভিশন-রেডিও প্রভৃতিতে প্রমিত বাংলা ভাষার প্রয়োগে যথেষ্ট সমন্বয়হীনতা রয়েছে। আবার বাংলা একাডেমি অনেকাংশে গবেষণা-প্রতিষ্ঠানের চরিত্রের আড়ালে রাজনীতি কিংবা দলতোষণে বেশি আগ্রহী হয়ে পড়ায় সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনে বা প্রয়োগে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে ভাষার রাজনীতি ক্রমাগত রাজনীতির ভাষার দিকে ধাবিত হচ্ছে। আবার অমর একুশে গ্রন্থমেলা (যদিও ‘বাংলা একাডেমি বইমেলা’ নামেই পরিচিতি লাভ করেছে) গ্রন্থের মানের প্রশ্নে, লেখক-প্রকাশক সম্পর্কের প্রশ্নে, ব্যবস্থাপনা ও তদারকির প্রশ্নে নানানভাবে ঐতিহ্য-বিচ্যুতির অভিযোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে, যা জাতির মননকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। বাংলা একাডেমি যে ‘জাতির মননের প্রতীক’ স্লোগান ধারণ করে পথ চলছিল, তা-ও চেতনাগতভাবে এগোতে পারছে না।  

প্রভাতফেরি একুশের চেতনা ধারণ করত একসময়। রাত জেগে পাড়ায়-মহল্লায়, স্কুলে-কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে মানুষ তৈরি করত ফুলের মালা। ভোরে খালি পায়ে হেঁটে হেঁটে শহীদ মিনারে জানাত শ্রদ্ধা। কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে গেয়ে উঠত একুশের গান, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারে!’ কিন্তু কালে কালে প্রভাতফেরি ভেতরের তাগিদের আনন্দ হারিয়েছে। এখন যেন এটি একটি বাধ্যতামূলক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী যেখানে আগে আনন্দে আনন্দে যোগ দিত, আজ যেন তারা বাধ্য না হলে শহীদ মিনারে যেতে চায় না। পাড়ায়-মহল্লায় এই চর্চা প্রায় নেই বললেই চলে। সম্ভবত মূল্যবোধের অবক্ষয়, দুর্নীতিগ্রন্ত সমাজ এবং সংস্কৃতির বিকাশে নানান বাধা ও মানবিক বিপন্নতার কারণে এমনটি হয়েছে। প্রসঙ্গত, একুশের এই গানটির রচয়িতা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী আমৃত্যু, দীর্ঘদিন প্রবাস যাপন করেছেন। ‘কেন দেশে থাকেন না, কেন আপনাকে এ দেশের মানুষ প্রভাতফেরিতে দেখতে পায় না’, এ রকম প্রশ্ন করলে তিনি উত্তরে বর্তমান নিবন্ধকারকে বলেছিলেন—‘কী করো তুমি?’  ভাষার রাজনীতি করা এই লোকটি রাজনীতির ভাষায় কথা বলেছিলেন সেদিন।

ভারতের বাংলা, বাংলাদেশের বাংলা, বিশ্ব বাংলা—এই তিন রকমের বাংলার মধ্যে কোন বাংলা প্রাধান্য পাবে? কোনটি হবে অথরিটি। বিশেষ করে ভাষা-প্রযুক্তি ও বাংলা ভাষার বিশ্বায়নে কাকে বিবেচনায় নিতে হবে—সে প্রশ্ন এখন প্রাসঙ্গিক। ইউনিকোডে আমরা যে বাংলা ব্যবহার করি, তা নিয়ন্ত্রণ করবে ঢাকা না দিল্লি? এ-সংক্রান্ত পরামর্শ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহযোগিতার জন্য ২০১৮ সালে ঢাকায় বাংলাদেশ সরকারের ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় একটি আন্তঃদেশীয় সভার আয়োজন করেছিল; সে সভায় পশ্চিমবঙ্গের প্রতিনিধি থাকলেও আসাম এবং ত্রিপুরার কোনো প্রতিনিধিত্ব ছিল না। ওই সভায় প্রস্তাব করা হয় যে, বাংলা ভাষার বিশ্বায়নের কোডিংয়ে অথরিটি হবে বাংলাদেশ; কেননা, বাংলা কেবল বাংলাদেশেরই রাষ্ট্রভাষা। এবং সত্যি, বাংলা এখন রাজনৈতিক ভাষা— কেবল মাতৃভাষা নয়।

ঢাকায় অবস্থিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট ঠিক কী ধরনের কাজ করে, তা সাধারণের কাছে বোধগম্য নয়। এই প্রতিষ্ঠান বাংলা ভাষাসহ পৃথিবীর অন্যান্য মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় কোনো কাজ করে কি না, রাষ্ট্রভাষা বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির কী ভূমিকা—সেসব জানা যেমন দরকারি, তেমনই ‘সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন’ সম্বন্ধে এর দায়িত্ব বিষয়ে গবেষকগণ আরেকটু আগ্রহী হতে পারেন। ভাষার প্রমিত রূপের প্রয়োগের কৌশল আবিষ্কার গবেষণার বিষয়। এবং এই রাজনৈতিকে স্লোগানটির বাস্তবে রূপ লাভ না করার পেছনেও অন্য কোনো রাজনীতি রয়েছে কি না, তা-ও ভেবে দেখার সময় হয়েছে।

আমরা জানি, মিডিয়া যেকোনো রাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে; ভাষা, ইতিহাস, চেতনা— এসব বিষয় মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচার পায়। কিন্তু বাংলাদেশে মিডিয়ার রাজনীতিকরণ বিশেষ করে দলীয়করণের ফলে জাতির চেতনার চর্চা সেখানে রাজনৈতিক এজেন্ডা হয়েছে। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে নেমেছে প্রায় সকল স্তরের প্রচারমাধ্যম। ফলে জাতির কাছে তথ্য ও ভাবনা প্রাচারের জায়গাটি বিস্তৃত হতে পারছে না।

ভাষার প্রমিতকরণ নিয়ে বিতর্ক আছে। সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন নিয়ে হতাশা আছে। বাংলার চেয়ে ইংরেজি ভাষার প্রতি বাঙালির আকর্ষণ ও মোহ এখনও কাটেনি। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসচর্চা নিয়ে আমাদের অনাগ্রহ আছে; সঠিক ইতিহাস রচনা ও প্রচারে প্রতিবন্ধকতা ও অস্পষ্ট আছে। আর আছে ভাষা নিয়ে রাজনীতি। যে-ভাষা একদিন রাজনীতিকে নাড়িয়ে দিয়েছিল, সে-ই ভাষাই আজ রাজনীতির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তবে, সকল বিপন্নতার মধ্যেও থাকে সম্ভাবনা, হয়তো অদূর ভবিষ্যতে বাঙালি তার ভাষার মর্যাদাকে সমুন্নত করতে আগ্রহী হয়ে উঠবেন। হয়তো রাষ্ট্রভাষা বাংলা নতুন দিনে, নতুন প্রত্যয়ে আলো ছড়াবে দুনিয়াজুড়ে।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর, বাংলাদেশ