শুরুটা মিয়ানমারের একটি প্রবাদ দিয়েই করা যাক—কোনো কিছু তড়িঘড়ি করতে গেলে তা শেষ হয় দেরিতে। যদিও প্রবাদের আসল রসটি অনুবাদ করলে হারিয়ে যায়, কিন্তু মিয়ানমারের এই প্রবাদটি অন্তত তাদের চলমান গৃহদাহের প্রেক্ষাপটে বাস্তবিক বলেই মনে হয়। জান্তা সরকারের সঙ্গে মিয়ানমারের বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠীর সংঘাত-সংঘর্ষ ক্রমেই বাঁকবদল করছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী অর্থাৎ তাতমাদাওদের পরাজয় এখন সময়ের ব্যাপার। অন্তত এমনটাই ধারণা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। কিন্তু জান্তা সরকারের অনুপস্থিতিতে ক্ষমতা সম্পর্কিত যে শূন্যতা সৃষ্টি হবে, তা শুধু দেশটিই নয়, দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের জন্যও উদ্বেগের।
গত বছরের অক্টোবরে কুকি, চিন, কারেন এবং রাখাইনদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় জান্তা সরকার মিয়ানমারের বহু অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। সংকট জান্তা সরকারের জন্য এখানেই শেষ নয়। তাতমাদাও সদস্যদের মধ্যে জান্তা প্রধান মিং অং হ্লাইনের নেতৃত্ব নিয়ে সন্দেহপ্রবণতা বাড়ছে। অনিশ্চিত এই অবস্থায় অনেকেই সেনাবাহিনীতে নিজের পদ থেকে সরে গেছেন বলে জানা যাচ্ছে। আবার যুদ্ধক্ষেত্র থেকেও অনেকে পালিয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে মিয়ানমারে অবস্থিত বিদেশি দূতাবাসগুলোকে নতুন নেতৃত্বকে স্বাগতম জানানো কিংবা গুটিয়ে নেওয়ার বিষয়েও ভাবতে হচ্ছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কিছু হিসাব তো সব দেশকেই করতে হয়। রোহিঙ্গা সংকট এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের হিসেবে আমাদেরও এক্ষেত্রে নজরদারি বাড়ানো জরুরি। মিয়ানমার সংকট বিষয়ে আমাদের অনেক ভাবনা রয়েছে। মিয়ানমারের গৃহদাহের প্রেক্ষাপটে আমাদের রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন পিছিয়ে পড়তে পারে কি-না এ নিয়েও শঙ্কা দেখা দিয়েছে। তারপরও আমরা যেহেতু নিরপেক্ষ অবস্থান রেখেছি তাই কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানোর বিষয়েই আমাদের ভাবতে হবে। মিয়ানমারে জান্তা সরকারের পতনের পর দেশটি কেমন কাঠামোর রাজনৈতিক পদ্ধতি অবলম্বন করবে সেটি নিয়ে ভাবতেই হবে।
মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি কেমন হবে তা তাদের বিষয়। তবে আমাদেরও কিছু ভাবনা রয়েছে। দেশটির সঙ্গে আমাদের সীমান্ত রয়েছে। নিরাপত্তাজনিত কিছু সংকট রয়ে গেছে। মিয়ানমার থেকে আর কেউ যেন বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে না পারে এ ব্যাপারে আরও সতর্ক এবং কঠোর অবস্থান নেওয়া বাঞ্ছনীয়। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি এবং এর পাশাপাশি ক্যাম্পে অবস্থানরত বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠীদের শনাক্তকরণ ও তাদের শেকড় উৎপাটনের ব্যবস্থা নেওয়াও জরুরি। আমরা দেখছি, টেকনাফ-উখিয়ার ক্যাম্পগুলোয় খুনখারাবির ঘটনা ক্রমাগত ঘটছে এবং মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠীর শেকড়বাকড়ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জনপদে রয়েছে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ, বাংলাদেশে অবস্থিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর অপতৎপরতার খবর, টেকনাফ-উখিয়া অঞ্চলে মিয়ানমারের বিদ্রোহীদের আস্তানার সন্ধান এবং তাদের আস্তানা থেকে আগ্নেয়াস্ত্র-গোলাবারুদ উদ্ধারসহ আরসার কয়েক সদস্য আটক এসব ঘটনা সর্বসাম্প্রতিক এবং উদ্বেগজনক বার্তা। আমাদের ক্ষেত্রে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা একান্তই জরুরি। এদিকে আন্তর্জাতিক মহলে রোহিঙ্গা ইস্যুটিকে উপস্থাপন করার আলাদা কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালু রাখতে হবে।
কিন্তু আপাতত মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিতে কেন নজর রাখা জরুরি তা বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা দরকার। জান্তা সরকারের পতন ঘটলে দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা থাকবে। দেশটির অভ্যন্তরে বিভিন্ন অঞ্চল বিভিন্ন বাহিনীর নেতৃত্বে থাকায় একে অপরের সঙ্গে সংঘাত-সংঘর্ষের আশঙ্কাও অমূলক নয়। যদি তারা রাজনৈতিকভাবে সংকট সমাধানের চেষ্টা করে তাহলে তা অবশ্যই ভালো। তবে বিদ্যমান বাস্তবতায় এমনটির সম্ভাবনা কম। মিয়ানমারে আরেকটি গৃহযুদ্ধের আশঙ্কাই ঘুরেফিরে আসছে। সামরিক জান্তার নিয়ন্ত্রণাধীন মিয়ানমারে ধর্মগত ভাবনাও রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। বার্মার অধিকাংশ মানুষই সামরিক প্রশাসনের বৈষম্যের শিকার হয়েছে। ফলে যারা জান্তা সরকারকে সমর্থন করেছে তারা কিছুটা হলেও উদ্বেগে রয়েছে। এ ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণভাবে আলোচনার প্রেক্ষাপট চলছে কি না, সেটিও ভাবনায় রাখতে হচ্ছে। অর্থাৎ অভ্যন্তরীণভাবে প্রতিটি গোষ্ঠীর মধ্যেই আলোচনা চলছে। মিয়ানমারে জাতিগত ধারণার ভিত্তিতে গঠিত সশস্ত্র গোষ্ঠীদের নিজস্ব বৈষম্যের অভিজ্ঞতা রয়েছে। রয়েছে নিজস্ব দাবি। তাই শান্তি বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো কিছুটা জটিল। তা ছাড়া মিয়ানমারের ইতিহাসে সহযোগিতার ক্ষেত্রে বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাসও নতুন নয়। এসব নানা সমীকরণ সেখানেও রয়েছে। ফলে মিয়ানমারে শান্তির আলোচনা শুরু হওয়ার বিষয়টিও জটিল।
মিয়ানমারে বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠীদের কাছে অত্যাধুনিক অস্ত্র আছে। তাই ক্ষমতার দ্বন্দ্বে তাদের দাবি জোরালোভাবে উপস্থাপনের ক্ষেত্রেও কিছু সংঘাত বেঁধে যেতে পারে। এসব বিষয়ে আমাদেরও নজর রাখতে হবে। মিয়ানমারে সৃষ্ট অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে জান্তা সরকারের পতনের পর দ্রুত কোনো পদক্ষেপের ক্ষেত্রে মিয়ানমারের ওই প্রবাদটিই যেন সত্য হয়ে উঠতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমাদেরও এটি ভাবনায় রাখতে হবে।
লেখক : সংবাদকর্মী