ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের বই ছেঁড়া নিয়ে কিছু কথা

শিল্পী নাজনীন প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৬, ২০২৪, ০১:২৮ পিএম

সম্প্রতি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক, যিনি নিজেকে আবার ‘দার্শনিক’ বলেও দাবি করেছেন, তিনি সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের একটি অধ্যায় ‘মানুষে মানুষে সাদৃশ্য ও ভিন্নতা’ এর একটি অংশ ‘শরীফ থেকে শরীফার গল্প’ ছিঁড়ে ফেলছেন, এমন একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। আমাদের এই পশ্চাৎপদ সমাজে শিক্ষকরা হলেন প্রদীপসম। যারা সমাজের অন্ধকার দূর করে আলো জ্বালতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন, সমাজকে করেন কুসংস্কারমুক্ত, আলোকোজ্জ্বল। তাই একজন শিক্ষকের কার্যক্রম হয় অনুসরণীয় ও অনুকরণীয়। এবং এ কারণেই একজন শিক্ষককে তার আচরণে ও কথায় হতে হয় সংযত ও সংহত। কিন্তু ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের তথাকথিত ওই শিক্ষক এবং দার্শনিক ব্যক্তিটি কোন বার্তা ছড়ালেন আমাদের এই অন্ধকারতম সমাজে? কোন আলো জ্বালালেন আমাদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনে ও মননে? স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নটি সামনে এসে যায়। এবং এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের জানা প্রয়োজন হয় যে ঠিক কী ছিল পাঠ্যবইয়ের ছিঁড়ে ফেলা ওই অংশটিতে, যার কারণে অমন অসহিষ্ণু আচরণ করলেন ওই শিক্ষক। 

ছিঁড়ে ফেলা অংশটি পাঠ করলে দেখা যায়, সেখানে সমাজের অবহেলিত ও প্রায় পরিত্যাজ্য জনগোষ্ঠী ‘হিজড়া’ তথা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে নিয়ে লেখা হয়েছে। আমাদের সমাজে এই জনগোষ্ঠীটি অত্যন্ত অবহেলিত এবং ক্ষেত্রবিশেষে প্রায় অচ্ছুত হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। আমরা সাধারণ জনগণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হিজড়াদের দেখি ভয় ও ঘৃণার চোখে। হিজড়া মানেই পথে-ঘাটে যখন তখন টাকা চেয়ে বসবে, অশ্লীল আচরণ ও অঙ্গভঙ্গি করবে, এমন ধারণা ও অভিজ্ঞতার সঙ্গেই সচরাচর পরিচিত আমরা। কোনো পরিবারে হিজড়া সন্তান জন্ম নেওয়া মানেই সীমাহীন লজ্জা ও গ্লানি, তাকে সমাজ থেকে লুকিয়ে রাখা, তার পরিচয় গোপন করে নারী বা পুরুষ হিসেবে বড় করা কিংবা তাকে পরিবার থেকে আলাদা করে হিজড়া সম্প্রদায়ের হাতে তুলে দেওয়া, এমনটাই ঘটে আসছে আমাদের সমাজে, এবং এই অত্যন্ত অমানবিক ও যন্ত্রণাদায়ক বিষয়টি নিয়ে সমাজের কোনো মাথাব্যথাও নেই। 

সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ক পাঠ্যবইয়ের আলোচ্য অংশটুকুতে এই বিষয়টি নিয়েই আলোচনা করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে যে, তারা জন্মগতভাবেই আলাদা, নারী বা পুরুষ নয়, তারা ‘তৃতীয় লিঙ্গ’। তারা জন্মগতভাবেই একধরণের ক্রোমোজোনাল ত্রুটি নিয়ে জন্মায়, ফলে তারা নারী বা পুরুষ হিসেবে পরিচিত না হয়ে সমাজে পরিচিত হয় হিজড়া হিসেবে এবং এটি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক একটি বিষয়, এখানে তাদের বা অন্য কারো কোনো হাত নেই। সুতরাং তাদের সমাজ থেকে আলাদা করে, সামাজিক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে রাখাটা সম্পূর্ণ অনৈতিক ও অমানবিক। তারাও আমাদের মতোই পরিপূর্ণ মানুষ, তাদেরও সমাজে বাঁচার অধিকার আছে, আছে সামাজিক ও রাজনৈতিক সবরকম অধিকার ভোগের অধিকার, আছে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের অধিকার। সুতরাং তাদের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন না করে, সামাজিক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত না করে সমাজের সুস্থ, স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে বাঁচার সুযোগ দিতে হবে, সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে, তাহলেই হিজড়া জনগোষ্ঠী সম্পর্কে যে অকারণ ভীতি ও ঘৃণার প্রচলন আছে আমাদের সমাজে, তা সর্বাংশে দূর হবে। সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের আলোচ্য অংশে এ কথাটাই সহজ ও সুন্দরভাবে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে। আমরা এই বুড়ো বয়সে এসেও হিজড়া জনগোষ্ঠী তথা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ সম্পর্কে যে ভুল ধারণা পোষণ করি, আমাদের আগামী প্রজন্ম যেন তেমন না হয়, তারা যেন উদার ও মানবিক হয়, হয় নৈতিকতাবোধে উন্নত এক জনসমাজ তৈরিতে সক্ষম, তেমন লক্ষ্য সামনে রেখেই আলোচ্য অংশটুকু পাঠ্যসূচিতে সংযুক্ত করা হয়েছে। 

একটি মানবিক জাতি গঠনের লক্ষ্যে যে মানবিক ও নৈতিক শিক্ষা এবং আদর্শকে আগামী প্রজন্মের মধ্যে বপন করার প্রয়াস নেওয়া হয়েছে তার মধ্যে রজ্জুকে সর্পভ্রম করে আমাদের তথাকথিত শিক্ষকটি যে মহান কর্মটি করে ভাইরাল হলেন, তা একদিকে যেমন হাস্যকর অন্যদিকে সেটি অত্যন্ত দুঃখজনকও বটে। এই বই ছেঁড়ার মাধ্যমে যে ভুল বার্তাটি তিনি সমাজে মুহূর্তের মধ্যেই ছড়িয়ে দিলেন, তা কোনো সুফল বয়ে আনবে না এই জাতির জন্য। বরং তা অত্যন্ত নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে সমাজে। যার প্রমাণ ইতোমধ্যেই আমরা ফেসবুকে দেখতে পাচ্ছি। বহু ধর্মান্ধ মানুষ তাকে সমর্থন করছেন, তথাকথিত বহু শিক্ষিত মানুষও তার পেছনে দাঁড়িয়ে তার মুরিদ বনে গেছেন। এ থেকেই আমাদের শিক্ষার গলদটা চোখে পড়ে অত্যন্ত নগ্নভাবে। শুধু ডিগ্রি অর্জনের নামই যে শিক্ষিত হওয়া নয়, এ বিষয়টির মাধ্যমে সেটি আমাদের আরও একবার মনে পড়ে। 

সমাজে আরও বহু অনাচার আছে, অসংগতি আছে, সেগুলো বাদ দিয়ে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যখন হিজড়া জনগোষ্ঠীর প্রতি সহমর্মিতামূলক একটি অংশ নিয়ে এমন হিংস্র ও উন্মাদপ্রায় আচরণ করেন, তখন সেটি আমাদের হতাশ করে, বিভ্রান্ত করে। ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি অতিপ্রেম কারো থাকতেই পারে, সেটি সবক্ষেত্রে দোষণীয়ও নয়, কিন্তু ধর্মান্ধতা কখনোই সমর্থনযোগ্য নয়, বিশেষত একজন শিক্ষকের কাছে তা কখনোই কাম্য হতে পারে না। আর যে শিক্ষক নিজেকে ‘দার্শনিক’ হিসেবে দাবি করেন, তার এমন উন্মাদপ্রায় আচরণ স্বাভাবিকভাবেই এই প্রশ্নটি সামনে আনে যে, তিনি আদতে কোন দর্শনের চর্চা করেন? অমানবিকতার? ঘৃণার? নইলে হিজড়া জনগোষ্ঠীকে সমাজের মূলস্রোতে আনার মতো মানবিক একটি বিষয়ের প্রতি তার এত ক্ষোভ কেন? তিনি কী চান আসলে? হিজড়া জনগোষ্ঠী সমাজে এমনই অবহেলায় অচ্ছুত আর ঘৃণ্য হয়েই বেঁচে থাকুক? আর তিনি বা তার মতো ধর্মান্ধরা মহানন্দে সমাজে ঘৃণার বীজ ছড়ান? তিনি হিজড়া জনগোষ্ঠীকে ‘রূপান্তরকামী’ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে সমকামিতার অভিযোগ তুলে ‘গেল’ ‘গেল’ রব তুলে ভাইরাল হলেন, কিন্তু আমাদের দেশের মাদ্রাসাগুলোতে প্রতি মাসে বহুসংখ্যক শিশু মাদ্রাসাশিক্ষক কর্তৃক বলাৎকারের শিকার হয়, এমনকি মারাও যায়, সে ব্যাপারে আশ্চর্যজনকভাবে নীরব থাকলেন, ব্যাপারটা খুব ন্যক্কারজনক আর রহস্যময়। এক্ষেত্রে তার উদ্দেশ্য নিয়েই সন্দেহ তৈরি হয়। এ ব্যাপারে তার বক্তব্য পাওয়া গেলে একটা স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যেত।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় তথাকথিত সেই শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করে তাদের দায় চুকিয়েছে। কিন্তু একজন শিক্ষকের মাধ্যমে সমাজে সে ভুল বার্তাটি ছড়িয়ে পড়েছে অতি অল্প সময়ে তা কি এত অল্পেই শুধরে নেওয়া যাবে? তাছাড়া একটি দেশের পাঠ্যবইয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি বইকে এভাবে জনসম্মুখে ছিঁড়ে ফেলাটা কতটা যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য? এটি কি আইনের চোখেও অপরাধ নয়? একজন শিক্ষকের এমন অন্ধ ও উন্মাদপ্রায় আচরণ তাই মোটেই মেনে নেওয়ার মতো নয়। এ ব্যাপারে তার বিরুদ্ধে যৌক্তিক শাস্তির দাবিটিও তাই মোটেই অস্বাভাবিক নয়।

লেখক : কথাশিল্পী ও শিক্ষক