পাকিস্তানে কেন ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাল ইরান

শিল্পী নাজনীন প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৯, ২০২৪, ০১:৩২ পিএম

পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশের এক গ্রামে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান। এই হামলায় দুই শিশু নিহত হয়। আহত হন কয়েকজন। পাকিস্তান স্বভাবতই ‘কড়া ভাষায়’ এ হামলার নিন্দা জানিয়েছে এবং এ ঘটনাকে ‘বিনা উসকানিতে আকাশসীমা লঙ্ঘন’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। তেহরানকে গুরুতর পরিণামের হুঁশিয়ারি দিয়ে ইরানের রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করে পাকিস্তান। এ ছাড়া ইরান থেকেও নিজেদের রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করে নেয়।

এদিকে ইরান দাবি করেছে, তারা জাইশ-আল-আদিল নামের জঙ্গি সংগঠনের বিরুদ্ধে হামলা চালিয়েছে। ইরানের এই হামলার প্রতিক্রিয়ায় ১৮ জানুয়ারি ইরানে বিমান হামলা চালায় পাকিস্তান।

পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দপ্তরের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বৃহস্পতিবার সকালে ইরানের সিস্তান ও বেলুচিস্তান প্রদেশে সন্ত্রাসী আস্তানায় ‘মার্গবার সারমাচার’ নামের একটি অত্যন্ত সমন্বিত সামরিক আক্রমণ শুরু করা হয়েছে। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে পরিচালিত এই অভিযানে বেশ কয়েকজন সন্ত্রাসী নিহত হয়েছে।

ইরানের সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতাকে সম্মান করার কথা উল্লেখ করে বিবৃতিটিতে বলা হয়, আজকের পদক্ষেপের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানের নিজস্ব নিরাপত্তা এবং জাতীয় স্বার্থ সমুন্নত রাখা। এক্ষেত্রে কোনো আপস করা যাবে না।

এদিকে পাকিস্তানের দাবির পর, ইরানি গণমাধ্যমেও এই হামলার কথা এবং তাতে বেসামরিক হতাহতের কথা এসেছে।

মেহর বার্তা সংস্থাকে উদ্ধৃত করে বিবিসি ফার্সি জানিয়েছে, ইরানের সিস্তান ও বেলুচিস্তানের ডেপুটি সিকিউরিটি গভর্নর বলেছেন যে সারাওয়ানে বিস্ফোরণে তিন নারী ও চার শিশু নিহত হয়েছে।

পাকিস্তানের ভূখণ্ডে কেন হামলা চালাল ইরান? মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি আগে থেকেই উত্তপ্ত। এর মধ্য কী এমন ঘটল যে তেহরান প্রতিবেশী দেশের ওপর হামলা চালিয়ে বসল। আর তাতেই আগুনে ঘি ঢালতে পাকিস্তানও পাল্টা হামলা চালাল? তা ভাবতে গিয়ে কপালে ভাঁজ পড়তে শুরু করেছে বিশ্লেষকদের।

জানা যায়, ২০১২ সালে ‘জাইশ-আল-আদল’ নামক সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ইরানে কালো তালিকাভুক্ত একটি ‘সন্ত্রাসী’ সংগঠন। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ইরানের মাটিতে বেশ কয়েকটি হামলার পেছনে জাইশ-আল-আদলকে দায়ী করা হয়।

এ কারণেই গত কয়েক দিন ধরেই ইরাক ও সিরিয়ার ভূখণ্ডে হামলা চালাচ্ছে ইরান। তেহরানের দাবি, ‘ইরানবিরোধী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর’ বিরুদ্ধে এসব হামলা চালানো হচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, ইরাক ও সিরিয়ার পর একই কারণে পাকিস্তানের ভূখণ্ডেও ইরান এই হামলা চালিয়েছে।

ফলে ‘বিনা উসকানিতে আকাশসীমা লঙ্ঘনের’ ঘটনায় ক্ষোভ জানাতে ইসলামাবাদে নিযুক্ত ইরানের শীর্ষ কূটনীতিককে তলব করে তাকে বহিষ্কার করেছে পাকিস্তান সরকার। এমন হামলাকে ‘সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য’ বলেও প্রতিবাদ জানানো হয়েছিল তখন।

হামলার পর থেকে বিষয়টি নিয়ে ইরান সরকার পুরোপুরি নিশ্চুপ। তবে ইরানের রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যম নুর জানিয়েছে, পাকিস্তানের ভূখণ্ডে হামলা চালিয়ে জঙ্গিগোষ্ঠী জাইশ-আল-আদলের সদর দপ্তর ধ্বংস করা হয়েছে। সংবাদমাধ্যমটি জানিয়েছে, সম্প্রতি ‘সন্ত্রাসীদের’ স্থাপনা ও তাদের ‘গোয়েন্দা সদর দপ্তরে’ হামলা চালাচ্ছে ইরান। এ জন্য সিরিয়া ও ইরাকের কুর্দিস্তানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানের ভূখণ্ডে হামলা চালানো হয়েছে। ইরানের এসব হামলা আগে থেকে উত্তপ্ত মধ্যপ্রাচ্যকে নানা সংকটের মুখোমুখি দাঁড় করাতে পারে। তিন মাসের বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনের গাজায় নির্বিচার হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী। অসহায় ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতিশীল ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা লোহিত সাগরে পশ্চিমা বাণিজ্যিক জাহাজে হামলা চালাচ্ছে। এর জেরে ইয়েমেনে পাল্টা হামলা চালাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য।

পাকিস্তান ও ইরানের মধ্যে প্রায় ৯০০ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকা রয়েছে। এর দুপাশের নিরাপত্তার বিষয়টি উভয় সরকারের জন্য দীর্ঘকাল ধরে উদ্বেগের বিষয় হয়ে আছে। ইরানি হামলাটি তাদের সীমান্ত থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার এবং নিকটতম শহর পাঞ্জগর থেকে নব্বই কিলোমিটার দূরে সবজ কোহ গ্রামে হয়েছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে।

স্থানীয় কর্মকর্তারা এলাকাটিকে গবাদিপশুর মালিক এমন বেলুচ উপজাতিদের একটি কম জনবহুল এলাকা হিসাবে বর্ণনা করেছেন। যেখানে ব্যাপকহারে পণ্য, মাদক এবং অস্ত্রের চোরাচালান হয়।

মার্কিন জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালকের কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, জাইশ-আল-আদল হলো ‘সবচেয়ে সক্রিয় এবং প্রভাবশালী’ সুন্নি জঙ্গি গোষ্ঠী যারা, সিস্তান-বেলুচিস্তানে কাজ করে। ওয়াশিংটন এবং তেহরান তাদের জঙ্গি গ্রুপ নামে আখ্যায়িত করেছে।

পাকিস্তানের নিরাপত্তা ভাষ্যকার আমির রানা বিবিসিকে বলেছেন, “এই কূটনৈতিক সংকট শান্ত হতে একটু সময় লাগবে। কিন্তু বিষয়টা এমনও যে পাকিস্তান এটা বাড়াতে চায় না”। তিনি আরও বলেন, অতীতে পাকিস্তান তাদের সীমান্তে ইরানের কর্মকাণ্ডের প্রতিক্রিয়া জানায়নি।

কিন্তু বুধবার ইসলামাবাদ ইরান থেকে তাদের রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করেছে এবং ইরানের রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করেছে। আর বৃহস্পতিবার ইরানের ভূখণ্ডে বিমান হামলা চালাল পাকিস্তান। এর ফলে এ অঞ্চলে সৃষ্ট উত্তেজনা দীর্ঘ সংঘাতের দিকে মোড় নেবে কিনা এমন আশঙ্কার পাশাপাশি এ অঞ্চলে বিরাজমান সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আরও বৃদ্ধি পাবে কি না সেটিও ভাবনার বিষয় হয়ে উঠছে।

কোনো সংঘাতই কাম্য নয়। পাকিস্তান এবং ইরানের মধ্যকার বিরাজমান উত্তেজনাকর পরিস্থিতিও তাদের কারো জন্যই মঙ্গলজনক ফল বয়ে আনবে না। মধ্যপ্রাচ্যের বিরাজমান উত্তপ্ত পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নিয়ে ইরান এবং পাকিস্তান উভয়েই নিজেদের মধ্যকার বিরাজমান সমস্যা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করবে এবং সংঘাতের পথ এড়িয়ে শান্তির পথে হাঁটবে, এটাই প্রত্যাশা বিশ্ববাসীর।

লেখক : কথাশিল্পী ও শিক্ষক