স্বাগত নতুন মন্ত্রিসভা, এবার স্থিতিশীল হোক বাজার

ওমর ফারুক শামীম প্রকাশিত: জানুয়ারি ১১, ২০২৪, ০৮:০৯ পিএম
সংবাদ প্রকাশ গ্রাফিক্স

দ্বাদশ জাতীয় সংসদের নতুন মন্ত্রিসভাকে স্বাগত জানাই। আমরা আমজনতা। নিয়ম-অনিয়মের প্রশ্ন বাদ রেখে আমাদের প্রতিনিয়ত প্রস্তুত থাকতে হয় নিজেদের জন্য। ক্ষমতায় যারাই আসীন হবেন, তারাই আমাদের সরকার। তবে দেশের একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল এ নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় চায়ের টেবিলের সমালোচনার ঝড় এখনও অব্যাহত আছে। তা থাকুক, সেটা তাদের ব্যাপার।

গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জাতীয় নির্বাচনগুলো যে বৈশ্বিক প্রভাবে প্রভাবিত হচ্ছে, তা রাজনীতি সচেতনরা দেখছেন এবং বুঝতে পারছেন। এক বিশ্ব যে এখন দুটি বলয়ে বিভক্ত, তা স্পষ্ট। আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ ও দেশে দেশে পরাশক্তি কয়েকটি দেশের একচ্ছত্র প্রবেশ, সেসব দেশে ক্ষমতা নির্ধারণের কাঠামোকে কৌশলে সক্ষম করে তুলেছে। প্রতিপক্ষের দুর্বল রাজনীতি এসব মিত্র শক্তিকে আরও শক্তিশালী করেছে। তাই সম্ভব হচ্ছে অনেক কিছু। এখন অন্য কোথাও যা হচ্ছে, তা আমাদের দেশেও হচ্ছে। অনেক ভালোর মধ্যে কিছু মন্দ আমাদের মেনে নিতেই হবে। এটাই এখনকার সময়ের স্বাভাবিক বিষয়।

এবার আসি আমজনতার আসল কথায়। আর তা হলো দু-মুঠো খেয়ে পরে বেঁচে থাকা। দেশে গত দুই বছর ধরে নিত্যপণ্যের বাজারে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে নানা রকমের নাটকীয় অস্থিরতা চলছে। বাজার বিশেষজ্ঞদের পর্যালোচনায় দেখা গেছে, কেউ যেন পরিকল্পিতভাবে ধাপে ধাপে নিত্যপণ্যে মূল্যবৃদ্ধির কারসাজি করছে। যা এখনো চলছে।

দেশে একের পর এক উন্নয়নের নতুন নতুন মাইলফলক যে ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়েছে সাধারণের মনে, তা নিমিষেই ম্লান হয়েছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে। ২০২২ সাল থেকে শুরু হয়ে ২০২৩ সালে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রেকর্ড ছাড়িয়ে বিস্ময়কর সূচকে ওঠে। কাঁচামরিচের কেজি ১ হাজার টাকা, পেঁয়াজের কেজি, ২শ টাকা থেকে সাড়ে ৩শ, ৫শ টাকার গরুর মাংস হয়েছে ১২শ টাকা, ডিম আর ব্রয়লার মুরগির মাংস ছক্কা হাঁকিয়েছে ফাঁকে ফাঁকে। ২০ টাকার আলু এখনো ৮০ টাকা। আদা রসুন তো দ্বিগুণ-তিনগুণ। বৈশ্বিক সমস্যার অজুহাতে মসলার বাজারে সাড়ে তিনশ টাকার জিরা এক লাফে উঠেছে নয়শ টাকায়। এছাড়া চাল চিনি তেল তো নিয়ম করেই বেড়েছে- তিন মাস, ছয়মাস আর বছরান্তে। অন্যান্য পণ্যের কথা না-ই বললাম। দ্রব্যমূল্যের এমন লাগামহীন ঊর্ধ্বগতির রাশ টানতে পারেননি খোদ সরকারও। নিম্নবিত্ত আর মধ্যবিত্তদের ত্রাহি-ত্রাহি অবস্থায় কেটেছে গত দুটি বছর। পরিবারের অভিভাবকদের মুখ পুড়েছে ঘরে, আর বুক পুড়েছে বাজারে। এই যন্ত্রণা বোঝার যেন কেউ ছিল না।

এসব সংকট নিয়ে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সভা-সেমিনারে অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, একশ্রেণির মানুষের হাতে পর্যাপ্ত টাকা আছে-যারা বেশি দাম দিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে পণ্য কিনতে পারেন। তাই বিক্রেতার জন্য এই শ্রেণিটি দাম বাড়ানোর হাতিয়ারে পরিণত হয়। বাজারে এভাবে উচ্চমূল্যের গ্রাহক পেয়ে ব্যবসায়ীদের লোভে গড়ে ওঠে সিন্ডিকেট। যে সিন্ডিকেটে অনায়াসে জড়িত হয়ে পড়ে ব্যবসায়ীদের উচ্চমহল। সাধারণ ভুক্তভোগীরা বলছেন, সরকারের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে ব্যবসায়ীরা স্থান পাওয়ায় এই সিন্ডিকেট আরও শক্তিশালী হয়েছে। যে কারণে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে দফায় দফায় নেওয়া সরকারের কোনো উদ্যোগই কাজে আসেনি। উচ্চমূল্য নিয়ন্ত্রণে কোনো অভিযানই ফলপ্রসূ হয়নি। আবার অনেকেই বলেন, মন্ত্রিসভায় ব্যবসায়ী এসেই আজ বাজার পরিস্থিতির এই বেহাল অবস্থা। যে কারণে সরকারও এখন নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।

দেশে গত দুই বছরে যেসব নিত্যপণ্যের রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে, সেসব পণ্য চাহিদামাফিক উৎপাদন হয়েছে। ঘাটতি ছিল না। তবু বারবার কেন মূল্যবৃদ্ধি? সংশ্লিষ্টদের নজরদারির অভাব, মজুত আর ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটকেই এজন্য দায়ী করছেন সাধারণ ক্রেতা ও বিশ্লেষকরা।

সামাজিক মাধ্যমে নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্য নিয়ে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের আহাজারি যতটা দেখা গেছে, তা দেশের গণমাধ্যমে উঠে আসেনি সেল্ফ সেন্সরশিপের কারণে। অতিমাত্রার আনুকুল্যের লোভে দেশের অনেক গণমাধ্যমে সাধারণের এসব আহাজারির খবর আসছে না বলে তাদের অভিমত। নিম্ন আয়ের অনেক মানুষ সামাজিক মাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন- আমাদের এসব দুর্ভোগের খবর প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছে না। পৌঁছানোর সব মাধ্যম বন্ধ হয়ে গেছে। চারদিকে শুধু উন্নয়নের ডামাঢোল বাজছে। এর নিচে চাপা পড়ছে আমাদের আর্তনাদ। উচ্চমূল্যের বাজারে এই দুর্ভোগ শুধু নিম্ন আয়ের মানুষদের নয়। নিম্নমধ্যবিত্তরাও ধুঁকছে উচ্চমূল্যের এই বাড়তি ব্যয়ে।

বাংলাদেশের উচ্চমূল্যের বাজার পরিস্থিতির প্রতিকার ও করণীয় নিয়ে কানাডা প্রবাসী ব্যাংকার নিরঞ্জন রায় দেশের একটি গণমাধ্যমে কলাম লিখেছেন। ওই কলামে তিনি বলেছেন, আমদানি নির্ভর ব্যবসাগুলো গুটিকয়েক ব্যক্তির হাতে কুক্ষিগত হয়ে আছে। কৃষিপণ্যের উৎপাদন পর্যাপ্ত বাড়ালেও এর সুফল জনগণ পাচ্ছে না স্টোরেজ সিস্টেম না থাকার কারণে। আগে বড় ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও আমদানি করতো। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের প্রতি ব্যাংকগুলোর বিমাতাসুলভ আচরণের কারণে সেসব আমদানিও বন্ধ হয়ে গেছে। এখন সময় এসেছে ক্ষুদ্র সেসব ব্যবসায়ীদের আমদানিতে যুক্ত করা।

এছাড়া শিক্ষিত বেকার যুবকদের থেকে আগ্রহী এবং যোগ্যদের মনোনীত করে টিসিবি বা অন্যকোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে সফল ব্যক্তিদের একটি সনদ প্রদান বা নিবন্ধনের মধ্যে নিয়ে আসা। এসব নিবন্ধিত এবং সনদপ্রাপ্ত আমদানিকারকরা অনায়াসে এবং সহজশর্তে ব্যাংক থেকে এলসি খোলাসহ যাতে প্রয়োজনীয় ব্যাংকিং-সুবিধা পেতে পারে, তার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। তাদের আমদানি কাজ এবং আমদানি পণ্য বাজারজাত করার ক্ষেত্রে যাতে বৃহৎ ব্যবসায়ীরা কোনোরকম বিঘ্ন সৃষ্টি করতে না পারে এবং কোনোরকম ভয়ভীতি দেখাতে না পারে সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে সরকারকেই। এই উদ্যোগ সফল করতে পারলে যুগপৎ দুটো লাভ হবে।

যেমন, বেকার সমস্যার সমাধান হবে এবং তেমনি আমদানি ব্যবসা গুটিকয়েক আমদানিকারকের হাতে আর কুক্ষিগত থাকবে না। দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়বে এটি, ফলে সিন্ডিকেট বা কোনোরকম যোগসাজশে বাজার নিয়ন্ত্রণ করার কাজটি কঠিন হয়ে যাবে। উন্নত বিশ্বের বাজারও একসময় বৃহৎ রিটেইল কোম্পানির ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে উঠেছিল। তখন কমিউনিটি-ভিত্তিক অসংখ্য ছোট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে উৎসাহিত করে বাজারে একটা ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। আমাদের দেশে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণ। কৃষির সফলতাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে হলে আধুনিক স্টোরেজ সিস্টেম এবং সুশৃঙ্খল বাজার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। উন্নত বিশ্বে, এমনকি অনেক উন্নয়নশীল বিশ্বেও এখন আর যে বছরের উৎপাদন সেই বছর ভোগ করা হচ্ছে না, বরং সুন্দর এবং মানসম্পন্ন স্টোরেজে রেখে দেওয়া হয় আগামী বছর বিক্রির জন্য। এমন ইরেডিয়েশন পদ্ধতি ব্যবহার করে আধুনিক স্টোরেজ সিস্টেমের প্রচলন শুরু হয়েছে বেশ আগে থেকেই।

এই পদ্ধতিতে চলতি বছর বিক্রি করা হবে গত বছরের উৎপাদিত পণ্য, যা বিশেষ স্টোরেজ ব্যবস্থায় সংরক্ষণে রাখা ছিল। এভাবে বিক্রি করে স্টোরেজ খালি করা হবে চলতি বছরের উৎপাদিত পণ্য পুনরায় স্টোরে রাখার জন্য। এসব স্টোরেজ কোম্পানির মালিক হবে স্থানীয় কৃষক, যারা একদিকে স্টোরেজ কোম্পানির কাছে নির্ধারিত মূল্যে উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করে তাদের ন্যায্যমূল্য পাবে, অন্যদিকে বছর শেষে স্টোরেজ কোম্পানির লভ্যাংশ পেয়েও আর্থিকভাবে কিছুটা লাভবান হবে। এরকম আধুনিক স্টোরেজ সিস্টেম প্রত্যেক উপজেলা এবং সম্ভব হলে পর্যায়ক্রমে প্রত্যেক গ্রামে গড়ে তোলা যেতে পারে। এই পদ্ধতি কীভাবে কাজ করে তা ব্যাখ্যা করার জন্য বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন।

শ্রদ্ধেয় ব্যাংকার নিরঞ্জন রায়ের এই পরামর্শমূলক লেখনী আমাদের দেশের জন্য কতটা কার্যকরী হবে সে বিষয়ে আমার বিশদ জ্ঞান নেই। তবে তাঁর লেখায় সিন্ডিকেট গড়ে ওঠতে না পারার একটি পরিচ্ছন্ন ধারণা পাওয়া গেছে। সেটি হলো- সংরক্ষণাগারে নতুন ফসল রাখার জন্য পুরোনো ফসল অবশ্যই বিক্রি করতে হবে। তাই এখানে সিন্ডিকেট করা বা বেশি দাম চাওয়ার কোনো সুযোগ থাকবে না। চাহিদামাফিক উৎপাদন আর চাহিদামাফিক বিক্রির একটি স্বচ্ছ ধারণা এটি। এ দেশের বেশিরভাগ মানুষই চায় নিত্যপণ্যের স্বাভাবিক মূল্য। যেটি সাধারণের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকবে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদের নতুন মন্ত্রিসভার কাছে দেশবাসীর এখন এটিই প্রত্যাশা। নিত্যপণ্য সর্বসাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আসুক।

লেখক : বার্তা সম্পাদক, সংবাদ প্রকাশ