শরণার্থী শিবির পারমাণবিক বোমার মতো

মাহফুজুর রহমান প্রকাশিত: অক্টোবর ৮, ২০২১, ০৩:০৫ পিএম

রোহিঙ্গা নেতা মহিবুল্লাহকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মন্তব্য করেছেন যে মিয়ানমার মূল ভূখণ্ডে ফিরে যাওয়ার পক্ষে কথা বলার কারণে তাকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যার তদন্ত এখনো হয়নি। স্থানীয় পুলিশ কাউকে কাউকে আটক করেছে, জিজ্ঞাসাবাদও করছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম মহিবুল্লাহর ছোট ভাইয়ের বরাত দিয়ে কয়েকজন হত্যাকারীর নাম উল্লেখ করেছে। ছোট ভাই দাবি করেছেন, তিনি হত্যাকারীদের দেখেছেন, তাদের কথা শুনেছেন এবং তাদের শনাক্তও করতে পারবেন। মহিবুল্লাহর ভাই ছাড়াও আরও কয়েকজন শরণার্থী একই রকম সাক্ষ্য দিয়েছে।

খুনি হিসেবে যে নামগুলো এসেছে তাদের আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি–আরসার সদস্য বলে দাবি করা হয়েছে। আরসা গোপন, জঙ্গি ও সন্ত্রাসী সংগঠন। মিয়ানমারের অভ্যন্তরে তারা সক্রিয় ছিল এবং ২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে একাধিক সহিংস অভিযানে যুক্ত ছিল। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ আরসার সহিংস কার্যকলাপের বিবরণ আন্তর্জাতিক ফোরামে ঢালাওভাবে প্রচার করেছে এবং সে কারণে রাখাইন এলাকায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অভিযানকে ন্যায্য বলে দাবি করেছে।

যেহেতু গোপন সংগঠন এবং বর্তমানে বিদেশ অর্থাৎ বাংলাদেশের মাটিতে তাদের কার্যকলাপ চালাচ্ছে সে জন্য স্বাভাবিকভাবে তাদের কার্যকলাপের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। অনুমান করা হয় যে এ রকম অনেকগুলো সশস্ত্র সংগঠন কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে সক্রিয়। সংগঠন না বলে এইগুলোকে বিচ্ছিন্ন দলও বলা যায়, অনেকটা মাফিয়ার মতো। সশস্ত্র হওয়ার কারণে এরা সহজে সাধারণভাবে ওই এলাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে, চাঁদাবাজি করে, ব্যবসায়ী বা অবস্থাপন্নদের জিম্মি করে, মুক্তিপণ আদায় করে। পাশাপাশি মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে স্থলপথে চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করে যার মধ্যে অস্ত্র ও মাদকও রয়েছে।

মহিবুল্লাহকে হত্যা করেছে কারা সে এক প্রশ্ন। কারা এতে লাভবান হবে, সে-ও এক প্রশ্ন। আর তার চেয়েও বড় প্রশ্ন হলো স্থানীয় রাজনীতি, শরণার্থী সমস্যা ও আঞ্চলিক কৌশলগত অবস্থানে এর প্রভাব কী হবে।

প্রথম দুটি প্রশ্নের উত্তরের চেয়ে আমার কাছে তৃতীয় প্রশ্নটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে। এ রকম শরণার্থী শিবিরে হত্যা বা সহিংসতার জন্য কাউকে খুব বেশি ভাবতে হয় না। সে জন্য লাভ লোকসানের চুলচেরা বিশ্লেষণ ছাড়া মহিবুল্লাহ নিতান্ত তুচ্ছ কারণেও প্রাণনাশের শিকার হয়ে থাকতে পারেন। তিনি শান্তিবাদী ও পরিশ্রমী ছিলেন। রোহিঙ্গাদের সম্মানজনক জীবনের জন্য উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত ও সম্মানজনক করতে, এবং প্রত্যাবাসনে রোহিঙ্গাদের উজ্জীবিত করতে তিনি সক্রিয় ছিলেন বলে জানা গেছে। সশস্ত্র সহিংস গোষ্ঠী বিশেষ করে মাদক ও অস্ত্র ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তাঁর সংঘাত ছিল। পাশাপাশি ২০১৭ এবং এর আগেপরে রোহিঙ্গাদের ওপর যে গণহত্যা চালানো হয়েছে, তিনি তার তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করছিলেন। সুতরাং তার প্রাণনাশে অনেকেরই ফায়দা। তাই ফায়দা হতে পারে, এমন যে কারও দিকেই এখন আঙুল তোলা যায়।

কিন্তু মহিবুল্লাহর মৃত্যু কোনো উপসংহার না। এই শরণার্থী শিবিরে এ রকম হত্যাকাণ্ড আগেও হয়েছে। যত দিন শরণার্থীরা থাকবে তত দিন হত্যা বন্ধ করা অসম্ভব। কুতুপালংয়ে মাত্র তেরো বর্গমাইল এলাকার মধ্যে ছয় সাত লাখ শরণার্থীর বাস। সংখ্যা বিবেচনায় কেউ কেউ একে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির বলে থাকে। কুতুপালং, বালুখালী ও কক্সবাজারে অন্যত্র মিলে শরণার্থীর সংখ্যা দশ লাখের ওপর।

দশ লাখ শরণার্থী! মিয়ানমার সীমান্ত থেকে শরণার্থী শিবিরের দূরত্ব দুই কিলোমিটারের মতো। আশপাশে পাহাড় ও দুর্গম জঙ্গল। জাতীয় নিরাপত্তা ও কৌশলগত বিবেচনায় এই অঞ্চল বাংলাদেশের জন্য পারমাণবিক বোমার চেয়েও ভয়ংকর। বাংলাদেশ সরকার মানবিক বিবেচনায় যথেষ্ট উদারতা দেখিয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনী অবশ্যই নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতন। কিন্তু আন্তর্জাতিক সংস্থা, বিদেশি সাহায্য সংস্থা ও বেসরকারি সংস্থার উপস্থিতির কারণে এই অঞ্চলের চরিত্র যথেষ্ট বদলে গেছে। অন্যদিকে সশস্ত্র সহিংস জঙ্গি অনিয়ন্ত্রিত দল ও উপদলের উপস্থিতি, অবৈধ বাণিজ্যে সংশ্লিষ্টতা, অস্ত্র ও মাদক ব্যবসা এবং প্রত্যাবাসনের কোনো রূপ অগ্রগতি না হওয়া ইত্যাদি সব মিলিয়ে বিস্ফোরন্মুখ পরিস্থিতি বিরাজ করছে।

বাংলাদেশ সরকার যেখানে যেভাবে যতটুকু পারছে, সর্বতোভাবেই সচেষ্ট আছে শরণার্থীদের ফেরত পাঠাতে। মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিকভাবে চাপ প্রয়োগ করতে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের বক্তৃতায় শরণার্থী সমস্যার আশু গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক যে প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর শাসন প্রত্যাবাসনকে বরং অসম্ভব করে ফেলেছে। অপরাধ দমনে সীমান্তে গুলি করা যেতে পারে, কিন্তু পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঠেকাতে জোর কূটনীতির বিকল্প দেখছি না। এই কূটনীতি কেবল আন্তর্জাতিক পর্যায়ে না, বরং বেশি দরকার দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে।

লেখক: সাবেক রাষ্ট্রদূত