মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির আত্মপরিচয়ের স্মারক কিংবা জন্মজরুল বলা যায়। মুক্তিযুদ্ধ কখনো একটি ঘটনার মধ্য দিয়ে শুরু হয় না—ভারতবর্ষেও স্বাধীনতাসংগ্রামের আগে থেকেও আমরা একই বিষয় দেখে এসেছি। সিপাহি বিদ্রোহ বা সিরাজউদ্দৌল্লার আম্রকাননের যুদ্ধ কোনোটাই মুক্তিসংগ্রাম থেকে আলাদা নয়। আন্দোলন-সংগ্রামের এক একটি সোপানকে অতিক্রম করে স্বাধীনতাসংগ্রামের দিকে অগ্রসর হয়। বাঙালির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ছিল বহু পুরোনো। কৈবর্ত বিদ্রোহ থেকে তেভাগা, টংক, নানকার, ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহসহ বিভিন্ন কৃষক সংগ্রাম সব গণসংগ্রামই ছিল স্বাধীনতার এক একটি সোপান। স্বাধীনতাযুদ্ধ কখনো একবারে বা এক দিনে শুরু হয়েছে বিশ্বের স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাস তা বলে না।
বাঙালির গণসংগ্রামের এই ধারাবাহিকতায় ৫২, ৬২, ৬৯-এর রক্তাক্ত পথ পেরিয়ে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে, অজস্র মানুষের আত্মদানের মধ্য দিয়ে আসে একদিন আসে মুক্তির সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। কিন্তু ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণের আগে পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী যে সর্বনাশের আগুন জ্বেলে দেয়, সেটা বড় ভয়ংকর। সেই সর্বনাশের ক্ষতি আজও পূরণ হয়নি। পকিস্তানিরা আমাদের শেষ বেলায় মরণকামড় দিয়েছিল। যার নাম বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড। এই হত্যাকাণ্ড জাতির জন্য শোকের, কষ্টের কালিমামাখা। ১৯৭১-এর ডিসেম্বর মাসে স্বাধীনতাযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এসে পাকিস্তানি বাহিনী যখন বুঝতে শুরু করে যে পরাজয় নিশ্চিত মানে তাদের পক্ষে যুদ্ধে জেতা সম্ভব না, তখন তারা নবগঠিত দেশকে সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও শিক্ষাগত দিক থেকে দুর্বল ও পঙ্গু করে দেওয়ার জন্য পরিকল্পনা করতে থাকে। পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী বাছাই করে দেশবরেণ্য সূর্যসন্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করতে থাকে। বাঙালি জাতি যেন শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ও সামাজিকভাবে দুর্বল হয়ে যায়, সেই লক্ষ্যে বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করে দেওয়ার লক্ষ্যে তালিকা তৈরি করে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইটের মধ্য দিয়ে সারা দেশে যে গণহত্যা শুরু করা হয়, তার প্রক্রিয়া চলতেই থাকে শেষ অবধি।
সবশেষে পরাজয় অনিবার্য জেনে ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে দ্রুতগতিতে চলে বুদ্ধিজীবী অপহরণ। ১৪ ডিসেম্বর রাতে পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী তাদের দেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সহায়তায় দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের যাদের নিজ নিজ গৃহ থেকে তুলে এনে নির্যাতন করা হতো। নির্যাতনের পর হত্যা করা হতো দেশবরেণ্য সন্তানদের। এই বন্দী অবস্থায় বুদ্ধিজীবীদের বিভিন্ন বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাদের ক্ষত-বিক্ষত ও বিকৃত লাশ রায়েরবাজার ও মিরপুর বধ্যভূমিতে পাওয়া যায়। অনেকের লাশ শনাক্তও করা যায়নি, পাওয়াও যায়নি বহু লাশ।
পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র গঠনের পর থেকেই বাঙালিদের বা পূর্ব পাকিস্তানিদের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের রাষ্ট্রযন্ত্র বৈষম্যমূলক আচরণ করতে থাকে। তারা বাঙালিদের ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানে। এরই ফলে বাঙালির মনে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হতে থাকে এবং বাঙালিরা এই অবিচারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন শুরু করে। এসব আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকতেন সমাজের সর্বস্তরের বুদ্ধিজীবীরা। তাঁরা সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে বাঙালিদের বাঙালি জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করতেন। তাঁদের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ফলেই জনগণ ধীরে ধীরে নিজেদের দাবি ও অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠতে থাকে, যা পরবর্তী সময়ে তাদের রাজনৈতিক আন্দোলনের দিকে ধাবিত করে। এ জন্য শুরু থেকেই বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তাানের সামরিক শাসকদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিলেন। তাই ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইটের পরিকল্পনার সঙ্গে বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। পাকিস্তানি সেনারা অপারেশন চলাকালে খুঁজে খুঁজে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করতে থাকে। তবে পরিকল্পিত হত্যার বড় সর্বনাশটি হয় যুদ্ধ শেষ হওয়ার মাত্র কয়েক দিন আগে।
এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডেরে মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। কারণ, স্বাধীনতার পর ধ্বংসপ্রাপ্ত বঙ্গভবন থেকে তার স্বহস্তে লিখিত ডায়েরি পাওয়া যায়, যাতে অনেক নিহত ও জীবিত বুদ্ধিজীবীর নাম পাওয়া যায়। এ ছাড়া আইয়ুব শাসনামলের তথ্য সচিব আলতাফ গওহরের এক সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায় যে, ফরমান আলীর তালিকায় তাঁর বন্ধু কবি সানাউল হকের নাম ছিল। আলতাফ গওহরের অনুরোধক্রমে রাও ফরমান আলী তার ডায়েরির তালিকা থেকে সানাউল হকের নাম কেটে দেন। এ ছাড়া আলবদরদের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা তিনিই করেছিলেন বলে তার ডায়েরিতে একটি নোট পাওয়া যায়।
ওই ডায়রিতে হেইট ও ডুসপিক নামে দুজন মার্কিন নাগরিকের কথা পাওয়া যায়। এদের নামের পাশে ইউএসএ ও ডিজিআইএস লেখা ছিল। এর মধ্যে হেইট ১৯৫৩ সাল থেকে সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীতে যুক্ত ছিলেন এবং ডুসপিক ছিলেন সিআইএর এজেন্ট। এ কারণে সন্দেহ করা হয়ে থাকে, পুরো ঘটনার পরিকল্পনায় সিআইএর ভূমিকা ছিল। ডিসেম্বরের ১০ তারিখ হতে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের প্রস্তুতি নেওয়া হতে থাকে। মূলত ১৪ ডিসেম্বর পরিকল্পনার মূল অংশ বাস্তবায়ন হয়। অধ্যাপক, সাংবাদিক, শিল্পী, প্রকৌশলী, লেখকসহ চিহ্নিত বুদ্ধিজীবীদের পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তাদের দোসরেরা অপহরণ করে নিয়ে যায়। তাঁদের চোখে কাপড় বেঁধে মিরপুর, মোহাম্মদপুর, নাখালপাড়া, রাজারবাগসহ অন্যান্য আরও অনেক স্থানে অবস্থিত নির্যাতন কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের। তাদের ওপর বীভৎস নির্যাতন চালানো হয়। পরে তাদের নৃশংসভাবে রায়েরবাজার ও মিরপুর বধ্যভূমিতে হত্যা করে ফেলে রাখা হয়। ২০০ জনের মতো বুদ্ধিজীবীদের তাদের বাসা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। বাংলাপিডিয়ার হিসাব বলছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় ১ হাজার ১১১ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি বাহিনী। যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল ঢাকায়, ১৪৯ জন। ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন বলছেন, আলবদর বাহিনী হওয়ার আগেই বিভিন্ন জায়গায় বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংঘ পুরোপুরি আলবদরে রূপান্তরিত হয়। তাদের ওপর সুনির্দিষ্টভাবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। ঢাকা শহরে আলবদররাই মাইক্রোবাসে করে সবাইকে ধরে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছে। একাত্তরে বাংলাদেশের যুদ্ধের শেষের দিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী সংগঠন আলবদর বাহিনী পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে।
মুঈনুদ্দীন বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের ঘটনার অপারেশন ইনচার্জ এবং আশরাফ ছিলেন চিফ এক্সিকিউটর। তবে সংখ্যার দিক থেকে বিবেচনা না করে যদি জনসংখ্যা আর মৃত্যুর হার হিসাব করা হয় তাহলে ঢাকার বাইরে জেলাগুলোতে অন্যান্য আরও বেশিসংখ্যক বুদ্ধিজীবী মারা গেছেন কিন্তু তাদের আসলে সেভাবে স্মরণ করা হয় না। শুধু কি তাই? বাংলাদেশের গণহত্যা ও বুদ্ধিজীবী হত্যার জন্য পাকিস্তান যেমন ক্ষমা চায়নি, তেমনি তখনকার পাকিস্তানের দোসর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এখন নির্বাচনে গণতন্ত্রেও ছবক দেয়, ইসরায়েলিদের গাজায় গণহত্যা চালানোর নেপথ্যেও তারা। অথচ মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের এবং চীনের ভূমিকা সম্বন্ধে কোনো কথাই বলা হয় না। ইতিহাসের কানাগলিতে পড়ে থাকে মুক্তিযুদ্ধের শত্রু-মিত্রদের নাম। শুধু এক ১৪ ডিসেম্বরের জন্য আমরা অপেক্ষা করি।
বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধগুলো সারা বছর অবহেলা-অনাদরে পড়ে থাকে। কে নেবে খবর? জামায়াত দেশে হরতাল-অবরোধ ডাকে। রাজনীতির পাল্লা ভারী করতে তাদের ব্যবহার করা হয়। কোনোখানে সামাজিক বয়কটের বিষয়টি নেই। গত ৫২ বছরে তারা শিকড় বিস্তার করেছে বহুদূর। মুক্তিযোদ্ধরা এখন রাজাকারের তালিকা করতে ভয় পায়। এখন পাকিস্তানের সমর্থক বাড়ছে। ক্রিকেট বা ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সীমান্ত উত্তেজনা বাড়লে এটা চোখে পড়ে। এটা নিয়ে কথা বললে বলবে, খেলায় রাজনীতি নেই। আসলেই কি রাজনীতি নেই? নাকি রাজনীতিটা হারিয়ে গেছে, এটা পরিষ্কার করা দরকার।