চলতি বছর নোবেল শান্তি পুরষ্কারে ভূষিত হন ইরানের সমাজকর্মী নার্গিস মোহাম্মদী। দীর্ঘদিন পর নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদানের বিষয়টি বিতর্কের জন্ম দেয়নি।
নার্গিস মোহাম্মদীকে যখন পুরষ্কারের বিজয়ী ঘোষণা করা হয় তখন তিনি কারাগারে। ভয়ঙ্কর সময়ে প্রতিবাদ ও সৎসাহস দেখানোর পরিণাম ও নিপীড়ন কেমন হয় তার জলজ্যান্ত উদাহরণ হয়ে আছেন তিনি। মোহাম্মদী বহুদিন থেকে নারী বৈষম্য দূরীকরণে কাজ করছেন। লিঙ্গ বৈষম্যের বিষয়টি নিয়ে তার উদ্যোগ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে প্রশংসিত হয়েছে ব্যাপকভাবে। কিন্তু ইরানে তা অনেকেই ভালো চোখে দেখেনি। নার্গিস মোহাম্মদীর শিক্ষাগুরু আরেক নোবেলবিজয়ী শিরিন এবাদির মতোই অন্যায়কে মেনে নেননি। বরং আপোষ না করেই এগিয়ে গিয়েছেন। গত বছর হিজাববিরোধী আন্দোলনে তার সাংগঠনিক নৈপুণ্যও বিশ্ব সম্প্রদায়ের সহানুভূতি আদায় করেছে। সমস্যা হলো, ইরানে তার আন্দোলন আরও বড় প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েছে। শাসকরা চলতি বছর আরও কঠোর আইন চালু করেছে। হিজাব না পরলে নারীদের আরও কঠিন শাস্তির মুখে পড়তে হবে নতুন আইনে।
নোবেল কমিটি সম্প্রতি এই নোবেলজয়ীর স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তিত। জেলে চিকিৎসা সেবা না দেওয়ায় ও হিজাব নিয়ে কড়া নিয়মের বিরুদ্ধে ইরানের জেলে অনশন শুরু করেছেন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী নার্গিস মোহাম্মদী। ৬ নভেম্বর তার অনশন শুরু হওয়ার পরই নরওয়েজিয়ান কমিটি এক বিবৃতিতে জানায়, “হিজাব না পরার অপরাধে একজন নাগরিককে চিকিৎসাসেবা না দেওয়ার বিষয়টি অমানবিক।” অমানবিক অবশ্যই। কিন্তু গোঁড়া ইরানের শাসকরা এখনো নড়েচড়ে বসতে পারেননি। হিজাববিরোধী আন্দোলনের স্বতস্ফূর্ততা নিয়ে আমাদের সন্দেহ নেই। সংকটের বিষয় হলো, এই আন্দোলন কতক্ষণ জারি রাখা সম্ভব হবে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দমনপীড়নের বিষয়টিও ভুলে গেলে চলবে না। নোবেল কমিটির প্রয়াস, নার্গিস মোহাম্মদী ডিসেম্বরে নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করতে পারবেন। কিন্তু তেমনটি হওয়ার সম্ভাবনা আপাতত কম। বরং অবস্থা বেগতিক মোড় নিয়েছে। আশার বিষয়, মোহাম্মদীর বার্তা শাসকদের কাছে এখন স্পষ্টভাবেই পৌঁছে গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবিক সংস্থার বরাত দিয়ে জানা গেছে, একান্ন বছর বয়সী মোহাম্মদী দীর্ঘদিন ধরেই হৃদরোগে ভুগছিলেন। তাকে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার ব্যাপারে জেল কর্তৃপক্ষ রাজি ছিল। শর্ত ছিল, মোহাম্মদীকে হিজাব পরতে হবে। প্রতিবাদী মোহাম্মদী তাতে রাজি হননি। আর এই অবাধ্যতাই শাসকদের খেপিয়ে দিয়েছে। তারাও জেদ ধরেছে, মোহাম্মদী হিজাব না পরলে হাসপাতালে নেওয়া হবে না। বিচারকেন্দ্রিক পদ্ধতির আশ্রয় নিয়েও ফলপ্রসূ কিছু পাওয়া যায়নি। নার্গিস মোহাম্মদীর পরিবারের সদস্যরাও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। তারা জানিয়েছে, মোহাম্মদীকে দ্রুত হৃদরোগের বিশেষায়িত হাসপাতালে নেওয়া জরুরি। তাছাড়া অসুস্থ শরীরে অনশন করায় তার স্বাস্থ্য আরও ভেঙে পড়ছে। মাহসা আমিনির মৃত্যু আর স্কুলছাত্রী অমৃতা গেরাভান্দের মৃত্যুর পর থেকেই উত্তপ্ত ইরান। এই অপসংস্কৃতির রূপ নেওয়া আইনের বিরুদ্ধেই যখন তার অবস্থান সেহেতু আপোষের সুযোগ নেই। বরং তিনি নিজের জীবন ঝুঁকিতে রেখে আন্দোলন করে যাচ্ছেন।
অনশন শুরুর আগেই পরিবারের সদস্যদের জানানোর ব্যবস্থা করেছেন। জেলে বন্দী রেখেও তাকে দমানো যায়নি। বিষয়টি ইরানের ধর্মীয় শাসকদের ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করেছে। এই মুহূর্তে তাদের হাতে সুযোগ নিতান্তই কম বলে মনে হচ্ছে। যা হোক, নার্গিস মোহাম্মদীর এই আন্দোলন কতটা সফল হবে তা অনুমান করা কঠিন। তবে তিনি ইরানের ধর্মীয় গোঁড়ামির বিষয়ে যেভাবে কণ্ঠ তুলেছেন, যেভাবে দাঁড়িয়েছেন তা গোটা বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষণ করতে শুরু করেছে। বিষয়টি ইরানের ভবিষ্যৎ পরিবর্তনের বার্তাবহও বটে। দেখার বিষয় শাসকরা কেমন সিদ্ধান্ত নেয়। ঘটনা যেদিকেই মোড় নিক, আরেকটি বড় গণ অভ্যুত্থান তারাও প্রত্যাশা করবে না। শাসকরা তা মোকাবিলাও করতে রাজি হবে না।
লেখক : সংবাদকর্মী