আমরা খবর দেখাই, কৃষক মহাসড়কে টমেটো, ফুলকপি, আলু, পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ এমন ফসল ফেলে দিয়েছেন। নদী বা বিলে ভাসিয়ে দেওয়ার ঘটনাও খবরে প্রচার করি।
কেন কৃষক তাঁর কষ্টে ফলানো ফসল ফেলে দিচ্ছেন? উত্তর খবরের সঙ্গেই থাকে। ন্যায্য দাম না পাওয়া। ফলাতে যা খরচ, সেই দাম না পাওয়াতে কৃষক অভিমানে, ক্ষোভে পথে ছুড়ে ফেলেন ফসল। জেলেদের সাগরে মাছ ধরতে না দেওয়ার প্রতিবাদেও জেলেরা জাল পুড়িয়ে দিয়েছেন, এমন খবর প্রকাশিত হয়েছে অনেকবার। আমাদের নিজেদেরও কি ক্ষোভ নেই? কাজের মূল্যায়ন না হলে হয়তো এখন আর কলম-কাগজ ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয় না। কিন্তু কি-বোর্ড, মোবাইল ফোন, মাইক্রোফোনের ওপর ঝড় খুব একটা কম যায় না।
অন্য পেশাজীবীরাও ক্ষোভ প্রকাশ করেন তাদের মতো করে। পেশায় যারা ঢুকতে পারেননি। লড়াই করছেন কোনো একটা কাজ জোগাড় করতে, তাদের ক্ষোভ তো নিত্যদিনের। চাকরি না হলে, ইন্টারভিউ ভালো না হলে, তাঁরা কখনো কখনো নিজের ওপরই ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সেই ক্ষোভ জীবনকে হত্যা করা পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছে। কাল রাতেও এক তরুণের এমন মৃত্যুর কথা শুনলাম।
স্পষ্ট চোখে ভাসছে পান্থপথ মোড়ের একটি দৃশ্য: সারি সারি রিকশা দাঁড়ানো, অন্য সময় অগোছালোভাবে দাঁড়ালেও সেদিন তাঁরা রিকশা নিয়ে সারিবদ্ধভাবেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। একজন ট্রাফিক পুলিশ এসে একের পর এক রিকশার সিট তুলে নিয়ে গেলেন। চালকরা ছুটে গিয়ে হাতজোড় করলেন। চোখের পানি ফেললেন। কিন্তু ট্রাফিক পুলিশ মহোদয়ের মন গলল না। হঠাৎ একজন চালক নিজের রিকশা উল্টে ফেলে দিয়ে ভাঙতে শুরু করলেন। সবাই দৌড়ে গিয়ে তাঁকে বাধা দিয়েও ফেরাতে পারছিলেন না। রিকশাচালকের ক্ষোভ হলো, যেখানেই যাচ্ছেন, সেখানেই ট্রাফিক পুলিশের একই হয়রানির শিকার হচ্ছিলেন তিনি, কয়েক দিন ধরে।
আমাদের স্মৃতি থেকে ব্যাটারিচালিত রিকশার চালকের কান্নার ছবিটি নিশ্চয়ই মুছে যায়নি। করোনার সংকট সময়ে সিটি করপোরেশনের বুলডোজার গুঁড়িয়ে দিয়েছিল তাঁর রিকশাটি। কিন্তু সোমবার বাড্ডায় যে রাইডশেয়ার মোটরসাইকেলচালক, নিজের রুজির উপায়টিকে আগুনে পুড়িয়ে দিলেন, তাঁকে আমরা কাঁদতে দেখিনি। দেখেছি ক্ষোভের আগুনে জ্বলতে।
শওকত আলীর ভাষ্য আমরা পেয়েছি। তিনি বলেছেন, সেদিনের আগে একদিন তিনি মামলার শিকার হয়েছেন। দ্বিতীয় দিন মামলা দেওয়াতে ক্ষোভের আগুনে যেন আরও জ্বলন্ত লাকড়ি ঠেলে দেওয়া হয়। এমনিতেই যারা রাইডশেয়ারের সঙ্গে যুক্ত, তারা নিত্য মানসিক অস্থিরতায় ভোগেন। যানজট একটি বড় কারণ। সঙ্গে ট্রাফিক পুলিশের হয়রানি। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা এখন অ্যাপসকেই মনে করেন রাইডশেয়ার চালকেরা। কারণ অ্যাপস তাদের রোজগারের একটি বড় অংশ কেটে নিচ্ছে। এই রোজগারে নেমেছেন যারা, তাদের দলে তরুণরাই ভিড় করেছেন বেশি। তাদের অনেকেই শিক্ষাজীবন শেষ করে প্রাতিষ্ঠানিক সরকারি, বেসরকারি চাকরি জোগাড় করতে পারেননি। ব্যবসায় লোকসান দিয়ে বা কাজ হারিয়েও অনেকে রাইড শেয়ারকে বেছে নিয়েছেন। এ জন্য কাউকে কাউকে সম্পদ বিক্রি করে বা কর্জ করে মোটরসাইকেল কিনতে হয়েছে।
ঢাকার রাস্তায় মোটরসাইকেলের রাইডশেয়ার জমে উঠছিল যখন, একাধিক অ্যাপস কোম্পানি যুক্ত হচ্ছিল, সেই মুহূর্তে করোনাকাল চলে আসে। একাধিকবার দীর্ঘ সময়ের জন্য রাইডশেয়ার বন্ধ হয়। তখন এই রোজগারের ভরসায় থাকা মানুষদের জীবনে বিপর্যয় নেমে আসে। অনেককে জীবন বাঁচাতে মোটরসাইকেল বিক্রি করে দিতে হয়েছে। করোনাকাল শেষে এসে আবার তারা নেমেছেন জীবনযুদ্ধের লড়াইতে।
সেই লড়াকু জীবন কত দুর্বিষহ? এই উত্তর আমাদের জানা। রোজগারের জীবনে আমরা কতটা নিঃস্ব হয়েছি। এখনো কতটা অনিশ্চয়তায় পেন্ডুলামে ঝুলছে জীবন। এই পেন্ডুলামের জীবন বয়ে নিয়ে যাওয়ার সাধ্য আছে কয়জনের? কয়জনই-বা তা প্রকাশ করেন? আলগোছে লুকিয়ে রাখে বিপন্ন জীবনের বেদনা, ক্ষোভ নীরবে সয়ে যেতে যেতে একসময় বিস্ফোরণ ঘটে ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির। শওকত আলী তেমন এক আগ্নেয়গিরি।
লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক