গণমাধ্যম: শৃঙ্খল নয়, শৃঙ্খলা চাই

প্রভাষ আমিন প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২১, ২০২১, ০৫:০২ পিএম

গল্পটি নানাভাবে প্রচলিত। সম্রাট আকবর তার সভাসদদের কাছে জানতে চাইলেন, এই নগরীতে কতগুলো কাক আছে? সবাই মাথা নিচু করে বসে থাকলেও বীরবল আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জবাব দিলেন, জাঁহাপনা, ৬০ হাজার ৩১৮টি কাক আছে নগরীতে। আকবর বললেন, আপনি কীভাবে নিশ্চিত হলেন? বীরবল বললেন, জাঁহাপনা আপনার লোকদের দিয়ে গুনে দেখেন। যদি আপনি এর বেশি পান, তাহলে বুঝতে হবে এখানে তাদের কিছু মেহমান এসেছে। আর যদি কম পান, তাহলে বুঝতে হবে তারা অন্য কোথায় বেড়াতে গেছে।

বাংলাদেশে কয়টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং আইপিটিভি আছে, এই প্রশ্নের উত্তরও বীরবল ছাড়া আর কেউ দিতে পারবেন না। সংখ্যাটা আকবরের আমলের দিল্লির কাকের চেয়ে অনেক বেশি হবে, তা নিশ্চিত। একসময় বলা হতো, আকাশের যত তারা, পুলিশের তত ধারা। এখন বলতে হবে, আকাশের যত তারা, বাংলাদেশে তত অনলাইন।

বর্তমান সরকারের নীতিনির্ধারকদের অনেকে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলতে গিয়ে গণমাধ্যমের সংখ্যাধিক্যকে সূচক হিসেবে বিবেচনা করেন। একধরনের আত্মপ্রসাদ নিয়ে বলেন, আমাদের আমলে এতটি টেলিভিশনের লাইসেন্স পেয়েছে, এতটি পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু সংখ্যা দিয়ে কখনো স্বাধীনতা মাপা যায় না। বরং ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা নিয়ন্ত্রণহীন অনলাইন আর আইপটিভি এখন সরকারের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। কোথায় কে, কী কন্টেন্ট প্রচার করছে, কোনটা সত্য, কোনটা গুজব, সেটা যাচাই করাও কঠিন নয় শুধু, প্রায় অসম্ভব।

দেরিতে হলেও বিপদটা সরকার টের পেয়েছে। বর্তমান তথ্যমন্ত্রীও নানাভাবে গণমাধ্যমে শৃঙ্খলা আনা, তাদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। বেশ কয়েক বছর ধরে সরকার অনলাইন এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে শৃঙ্খলা আনার চেষ্টা করছে। অনলাইনের নিবন্ধন দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে কয়েক বছর আগে থেকে। কয়েক হাজার আবেদনের বিপরীতে শখানেক অনলাইনকে নিবন্ধন দেওয়াও হয়েছে।

বাংলাদেশের গণমাধ্যমে বরাবরই দুটি ধারা আছে। একটি মূলধারা, আরেকটি আন্ডারগ্রাউন্ড। বাংলাদেশে এখন নিবন্ধিত পত্রিকা আছে ৩ হাজার ২২২টি, এর মধ্যে দৈনিক পত্রিকাই ১ হাজার ৩২৩টি। এর মধ্যে আপনি কয়টির নাম জানেন? পত্রিকা হয়তো প্রকাশিত হয় না বা কালেভদ্রে প্রকাশিত হয়, কিন্তু ডিএফপির তালিকায় প্রচারসংখ্যা লাখ লাখ। সেই সংখ্যা অনুযায়ী তারা সরকারি বিজ্ঞাপনও পান। শুরুতে অনলাইনের যেহেতু নিবন্ধনের ব্যাপার ছিল না, তাই যেখানে সেখানে গজিয়ে উঠেছে অনলাইন নিউজ পোর্টাল। স্বামী সম্পাদক, স্ত্রী প্রকাশক; ব্যস হয়ে গেল একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল। নামের শেষে ডটকম থাকলেই হলো। তারপর সাংবাদিক পরিচয়ে চলে দেদার ধান্দাবাজি। আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকা করতে তবু কিছু খরচ আছে। অনলাইন করতে খালি একটা ল্যাপটপ বা কম্পিউটার থাকলেই হলো। বাকিটা চলে কাট-পেস্টের মাধ্যমে।   

শুরুতে না পারলেও এখন সরকার অনলাইনকে একটি শৃঙ্খলায় আনার চেষ্টা করছে। গত সপ্তাহে হাইকোর্টও ৭ দিনের মধ্যে অনিবন্ধিত অনলাইন বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন। তবে হাইকোর্ট নির্দেশ দিলেও তা বাস্তবায়ন করা কঠিন। যাচাই-বাছাই ছাড়া অনলাইনের নিবন্ধন দেওয়া যেমন উচিত নয়, আবার যাচাই-বাছাই ছাড়া বন্ধ করাও সমীচীন নয়। সুখের কথা হলো, তথ্যমন্ত্রী সমস্যাটা জানেন। হাইকোর্টের নির্দেশের প্রতিক্রিয়ায় তথ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, অনলাইন নিউজ পোর্টাল নিবন্ধন একটি চলমান প্রক্রিয়া। তবে তিনি এটাও বলেছেন, হাইকোর্টের নির্দেশনা এ ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা বিধানে সহায়ক হবে। তথ্যমন্ত্রী স্পষ্ট করেই বলেছেন, ইতোমধ্যেই রেজিস্ট্রেশন পাওয়া ছাড়া ভবিষ্যতে আর কোনো অনলাইন বের হবে না বা আজকে যে সমস্ত পত্রপত্রিকা আছে, সেগুলো ছাড়া ভবিষ্যতে আর কোনো পত্রপত্রিকা বের হবে না, তেমন নিয়ম কোথাও নেই। কোনো অনলাইন নিবন্ধন চাইল আর সরকার নিবন্ধন দিয়ে দিল, বিষয়টি অত সরল নয়। আবেদনের পর যাচাই-বাছাই করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আবার তদন্তকারী সংস্থাকে দেয়। তাই প্রক্রিয়াটি সময়সাপেক্ষ। তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, যেসব অনলাইন সত্যিকার অর্থে গণমাধ্যম হিসেবে কাজ করে না বরং নিজস্ব বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে, ব্যাঙের ছাতার মতো এত অনলাইন দেশে প্রয়োজন নেই। যার যেমন ইচ্ছে একটি অনলাইন খুলে বসবে এবং সেটি নিয়ে যেমন ইচ্ছে তেমন সংবাদ পরিবেশন করবে, মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করবে, গুজব রটানোর কাজে ব্যস্ত হবে, অন্যের চরিত্র হনন করবে, ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে পরিচালিত হবে, কোনো ব্যবসায়িক স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য সেখানে লেখালেখি হবে, এটি কখনোই সমীচীন নয়।

পত্রিকার মতো অনলাইনেও যাতে আন্ডারগ্রাউন্ড ধারাটি সক্রিয় হতে না পারে, সে ব্যাপারে শুরুতেই সরকারকে কঠোর হতে হবে। এটা মানতেই হবে, শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা বিশ্বেই অনলাইনই এখন গণমাধ্যমের ভবিষ্যৎ। তাই এখন থেকেই সেটিকে একটি শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে হবে। যারা এরই মধ্যে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছেন, তারাই শুধু নিবন্ধন পাবেন বা তারাই আগে পাবেন; সেটি হওয়া উচিত নয়। যারা যোগ্য, আবেদন আগে করুক আর পরে করুক; তারাই আগে নিবন্ধন পাবেন। কোয়ানটিটি নয়, কোয়ালিটিটাই যেন প্রাধান্য পায়। পাঁচ বছর আগে প্রকাশিত হওয়া ‘স্বামীস্ত্রীডটকম’-এর চেয়ে পাঁচ দিন প্রকাশিত হওয়া সত্যিকারের গণমাধ্যম যেন অগ্রাধিকার পায়। আর ‘স্বামীস্ত্রীডটকম’ মার্কা অনলাইন যেন কখনোই নিবন্ধন না পায়। আমাদের অনলাইনের ক্ষেত্রটি যেভাবে আগাছায় ভরে উঠেছে, তাতে ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে। তবে মুড়ি-মুড়কি যেন একদরে না বিকোয়।

অনলাইনের পাশাপাশি এখন অনিবন্ধিত আইপিটিভি আর ইউটিউব চ্যানেলও সরকারের মাথাব্যথার কারণ হয়ে গেছে। সরকারের লাইসেন্স পাওয়া গোটা চল্লিশেক স্যাটেলাইট চ্যানেলের পাশাপাশি দেশে এখন অসংখ্য আইপিটিভি সম্প্রচারিত হয়। এমনকি কোনো কোনো উপজেলায় ২০-৩০টা টিভি আছে। এ ব্যাপারে সরকার কঠোর হয়েছে। গত সপ্তাহে বিটিআরসি ৫৯টি আইপটিভি বন্ধ করে দিয়েছে। আইপিটিভি প্রসঙ্গে তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, আমরা যেভাবে অনলাইনের নিবন্ধন দিচ্ছি, একইভাবে ইউটিউব বা আইপিটিভি নিবন্ধন দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছি। এখনো কাউকে নিবন্ধন দেওয়া হয়নি। আমরা আশা করেছিলাম গত মাস থেকে দিতে পারব। কিন্তু তদন্ত রিপোর্ট না পাওয়ায় আমরা দিতে পারিনি। ব্যাঙের ছাতার মতো আইপিটিভি করার যে সুযোগ রয়েছে, এটা কোনোভাবেই সমীচীন নয়। যে সমস্ত আইপিটিভি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে এবং নিজেকে টেলিভিশন চ্যানেলের মতো জাহির করছে, খুব দ্রুত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আমরা তথ্যের অবাধ প্রবাহ চাই। কিন্তু গণমাধ্যমের নামে আগাছা এসে যেন মূলধারার গণমাধ্যমের ফসল নষ্ট না করে। আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকা বা আন্ডারগ্রাউন্ড অনলাইন বা আন্ডারগ্রাউন্ড আইপিটিভির কারণে সাংবাদিকতাই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। মূলধারার গণমাধ্যমের আস্থা, বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে পড়ছে। তবে নিবন্ধনের নামে যেন গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করা না হয়। আমরা শৃঙ্খলা চাই, কিন্তু কোনোভাবেই শৃঙ্খলিত হতে চাই না।

 

লেখক: সাংবাদিক