বিল গেটস নতুন সাক্ষাৎকারে বলেছেন, পরের প্যান্ডেমিক বা অতিমারীর জন্যে ভারত প্রস্তুত থাকবে, এবং লক্ষ লক্ষ এম-আরএনএ ভ্যাকসিন ভারতে তৈরী হবে। (সূত্র: টাইমস নেশন, ১৫ই সেপ্টেম্বর, ২০২১) তিনি বলেছেন, ভারতে "দৈত্যাকার" কারখানা তৈরি হবে।
অনেকেই এই খবরে উল্লসিত হবেন, সন্দেহ নেই। হাজার হোক, বিল গেটস বলে কথা! তিনি যখন এত বড় সার্টিফিকেট দিয়ে দিয়েছেন, তখন ভারত যে ভ্যাকসিনের জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে, তাতে সন্দেহের অবকাশ কোথায়?
হিন্দুত্ববাদী বিজেপি ও আরএসএস বাহিনী এবং তাদের আইটি সেল এইসব গল্পে আরো বেশি উল্লসিত হয়, এবং নতুন প্রোপাগাণ্ডায় নেমে পড়ে। এবং এক বিশাল সংখ্যক মানুষ কোনো কিছু তলিয়ে না দেখেই তাদের প্রোপাগাণ্ডার কলে ইঁদুরের মতো আটকে পড়ে।
সমস্যাটা অন্য জায়গায়। খুব সংক্ষেপে সেগুলো একটু তলিয়ে দেখা যাক।
(১) বিল গেটস কি ধরেই নিয়েছেন, নতুন আর এক অতিমারি আসন্ন? যদি তাঁর কাছে কোনো তথ্য থাকে, তাহলে তার উচিত সেটা সবাইকে দেখানো। আমরা আপনার কথায় নতুন করে ভয় পাচ্ছি। এই নতুন অতিমারি কি বাংলাদেশ ও ভারতকে আরো বেশি করে গ্রাস করবে?
(২) এই যে "দৈত্যাকার" ফ্যাক্টরি ভারতে তৈরী হবে, তার বরাত (কনট্র্যাক্ট) কি আপনিই পাবেন? পেলে তা কি ন্যায়সঙ্গত টেণ্ডারের মাধ্যমে আপনাকে দেওয়া হবে, না কি এর মধ্যে কোনো গোপন চুক্তি আছে? এই দৈত্যাকার ফ্যাক্টরিতে তৈরি ভ্যাকসিনের অগ্রাধিকার কি ভারত ও বাংলাদেশ পাবে?
(৩) আপনি এর আগেও ডি-মনিটাইজেশন নামক চক্রান্তে খুব বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন বলে শোনা যায়। ভারতে তার বিপর্যয়কর ফল আমরা দেখেছি। এই ভ্যাকসিন অর্থনীতিও কি সেই দিকেই যাবে? এই বিষয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা চাই।
(৪) ভ্যাকসিন প্রস্তুত করার জন্যে ভারতকেই বেছে নিলেন কেন? এখানে আমি আমেরিকায় শ্রমিকদের সঙ্গে বহুকাল কাজ করছি। তারা যদি জানতে পারে আপনি আমেরিকার শ্রমিকদের ও আমেরিকার শিল্পকে বঞ্চিত করে ভারতে আপনার বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার লগ্নি করতে চলেছেন, তারা কি খুব খুশি হবে? এমনিতেই ট্রাম্প সমর্থকরা আপনার সম্পর্কে নানা চক্রান্তের কথা বলে যাচ্ছে। আপনার এই নতুন পদক্ষেপ কি তাদের হাত আরো শক্ত করবে না?
(৫) একদিকে ট্রাম্প ও মোদী জাতীয় ব্যক্তিদের মধ্যে বহুকাল ধরেই এক অশুভ আঁতাত রয়েছে। মোদী সমর্থকরা প্রায় সকলেই ট্রাম্প সমর্থক। কিন্তু আপনি "ট্রাম্প বিরোধী," অথচ মোদী সরকারের সঙ্গে একটানা কাজ করে চলেছেন। এই ডাবল স্ট্যান্ডার্ড ও পরস্পরবিরোধিতার কারণ কী? এ বিষয়ে আমরা আপনাকে চ্যালেঞ্জ করছি প্রকাশ্য বিতর্কের।
(৬) যদি ধরে নেওয়া যায় ভারতে আপনার বহু বিলিয়ন লগ্নির ফলে ভারতের অর্থনীতির উন্নতি হবে, সেই অর্থনীতির লাভের গুড় খাবে কারা? ভারতের সাধারণ মানুষ, না কি আম্বানি, আদবানি জাতীয় ০.১ শতাংশ? ভারতীয় কর্মীদের ইউনিয়ন অধিকার কি থাকবে? পুরুষ ও নারীকে কি সমান অধিকার ও অর্থ দেওয়া হবে? আমেরিকান কর্মীদের যে হারে মজুরি দেওয়া হয়, ভারতীয় কর্মীদের কি সেই হারেই দেওয়া হবে?
(৭) আপনার এই নতুন প্রস্তাব মতো ভারতে যদি বিশাল এক ভ্যাকসিন কারখানা ও শিল্প গড়ে ওঠে, সেখানে কি পরিবেশ সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে, না কি আগেকার অনেক শিল্পের মতোই ভারতের পরিবেশকে বিশ্বের ০.১ শতাংশের বর্জ্য পদার্থের আস্তাকুঁড় হিসেবে ব্যবহার করা হবে? সেই পরিবেশ ধ্বংস ভারতের সীমানা ছাড়িয়ে বাংলাদেশ ও অন্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোকে কি আরো বেশি ধ্বংস করে দেবে না? এ বিষয়ে আপনি কী কী আন্তর্জাতিক চুক্তি মেনে কাজ করবেন, সে তথ্য আমাদের জানান। কারণ, আমাদের জানার অধিকার আছে।
উত্তরগুলো পাবো না আপনার কাছে, আমি জানি। আমরা সামান্য মানুষ। আপনার কাছে পৌঁছতে পারবো না।
তবে প্রশ্নগুলো করার মৌলিক অধিকার থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে পারলাম না। আরো পাঁচজন যদি বোঝার চেষ্টা করেন কী খেলাটা চলছে।
হিন্দুত্ব আধিপত্যবাদী আরএসএস, বিজেপি, এবং ওদের শ্রমিক ফ্রন্ট ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘ এসব ব্যাপারে সম্পূর্ণ নীরব। তারা এই সেদিনও বিদেশী পুঁজির বিরুদ্ধে আন্দোলন করে এসেছে। স্বদেশী অর্থনীতির কথা বলে এসেছে। সেসব কথাও আজকাল মিডিয়া আর বলেনা।
আজকের ভারতের শাসকদের মন্ত্র বিল বাবু স্যার, আপনি ভালোই বুঝে গেছেন। ওই যে, "জানার কোনো শেষ নাই, জানার চেষ্টা বৃথা তাই।"
ভালো থাকুন আপনার বিজেপি ও তাদের উল্লসিত চিয়ারলিডারদের নিয়ে।
লেখক: মানবাধিকাকর্মী ও শিক্ষাবিদ