পাড়াবাসীরা প্রাপ্য মর্যাদা পান কি?

ঞ্যোহ্লা মং প্রকাশিত: জুন ১৩, ২০২৩, ০৬:০২ পিএম

আমরা পড়ালেখা করতে গিয়ে বাইরের কত মানুষের সাথে মেলামেশা করি, যোগাযোগ হয়। একসময় পরিচিতরা প্রিয় বন্ধুতে রূপ নেয়। এলাকায় যাদের সাথে বেড়ে উঠি, তাদের অনেকে বিভিন্ন কারণে পিছিয়ে থাকেন বলে, আমরা তাদের কথা ভুলে যাই। তাদের নিয়ে খুব একটা চিন্তাও করি না। দেখা হলে খোঁজ-খবর, কুশল-বিনিময়টুকুতেই শেষ।

আমাদের ছেলেমেয়েরা বড় হয়। বড় হয়ে তারাও সংসার জীবনে প্রবেশ করে। তাদের বিয়েতে মান-সম্মানের কথা ভেবে আমরা অনেকে শহরের কমিউনিটি সেন্টারকে বেছে নিই। এই কমিউনিটি সেন্টারে শহরের প্যান্ট-শার্ট-টাই পরা বন্ধু ও আত্নীয়রা স্থান পায়। দূরের আত্নীয়, খেটে-খাওয়া আত্নীয়-বন্ধুরা বাদ পড়ে।

আমরা ভাইবোনরা প্রায় সকলে দূরে থাকি। বাবার অসুস্থতার খবর পেয়ে পাড়াবাসীরা আমাদের বাড়িতে জড়ো হতে থাকেন। পালাক্রমে পাহারা দিতে থাকেন। অনেকে সারারাত জেগে পাহারা দিয়ে সহায়তা করেন। মৃত্যুর আগে ও পরে পরিবারের সবাই ঘুমিয়ে পরলেও ৫-১০ জনকে পাওয়া যাবে, যারা মেঝেতে, চেয়ারে, সোফায় বসে থাকতে থাকতে একসময় ঘুমিয়ে পড়েন। শোকহত পরিবারকে সমবেদনা জানিয়ে সঙ্গ দিতে, সময় দিতে কাউকে বলতে হয়নি। তারা নিজ থেকে এসে খোঁজ খবর নেন, সময় দেন। এটি একটি সামাজিক প্রথা।

গ্রামীণ এলাকায় কারো মৃত্যুর খবর পেলে মৃত্যু পরবর্তী প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে, যারা নানা হাতের কাজ জানেন, তারা নিজ দায়িত্বে চলে আসেন। কফিন বানাতে সবাই পারেন না। যারা পারেন তারা এসে নিজ থেকে কাজ শুরু করে দেন। তাদের সহায়তা করতে অন্যরাও যে যার দক্ষতা অনুযায়ী হাতে কাজ তুলে নেন। এই সময় বয়স্করা তরুণদের দিয়ে কাজ করার, নিজেদের জ্ঞান পরবর্তী প্রজন্মের কাছে হস্তান্তরের চেষ্টা করেন।

বাবাকে যেদিন শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হবে, দেখি কেউ বাঁশ, কেউবা কাঠ সংগ্রহে নেমে পড়েছেন। কেউ বাঁশ থেকে বেত বের করেন, কেউ সাজানোর প্রয়োজনে কাগজ কাটেন, কেউ ফুল তৈরি করেন, কেউ বাঁশের বেত দিয়ে পাখি তৈরি করেন। যাদের কাউকে বলতে হয়নি “আপনাদের এটা বানাতে হবে”। লোকজন সমাগম হতে থাকলে সামাল দিচ্ছেন পাড়াবাসীরা। দুপুরের দিকে প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টিতেও সমাগত লোকজনদের সামলেছেন পাড়াবাসীরা। গ্রামের যুবক মংচিং মালয়েশিয়া যাওয়ার ১০ মিনিট আগেও পাড়ায় আগত অতিথিদের সেবা দিতে কার্পণ্য করেননি। অংসাথোয়াইকে মনে হয়েছিল যেন তার নিজের আপন দাদু মারা গেছেন। আর রিম্রাকে কি বলবো! সে এক ঘন্টাও ঘুমানোর সময় পেয়েছে কিনা সন্দেহ আছে। তেমনি গ্রামের সকল ছেলেমেয়ে, নারী-পুরুষ যে যা পারেন, বিশ্রাম ছাড়া পরিশ্রম করেছেন। দোঅংগ্যরা পাহারা দিতে দিতে ঘুমানোর জায়গা না পেয়ে মেঝেতে ঘুমিয়ে পড়েন। তার বাবাও সারারাত মৃতদেহের পাশে জেগে থাকার পরও পরের সারাদিন সময় দিয়েছেন। আকু মংমং, বনাই অংসাথোয়াইকে মনে হয়েছে যেন পরিবারের বড় সন্তান।

পাড়ার সহপাঠী বন্ধু জটিল, সোনা মনি’রা, উপজেলা পর্যায়ে সহপাঠী বন্ধু অংশুমান, প্রিয়তোষরা ফোনের ওপর ফোন করে জিজ্ঞেস করে কী লাগবে, কী করতে হবে ইত্যাদি। তাদের শিক্ষককে, বন্ধুর বাবাকে সম্মান দেখাতে কোন কমতি রাখেননি। পাড়ার প্রতিটি পরিবার দূর-দূরান্তের অতিথিদের সামাল দেওয়ার চেষ্টাগুলোকে না দেখলে অনুভব করা কঠিন হবে। আগত অতিথিরা কে খেতে পেলো, কে পেলো না পাড়াবাসীরা খুঁজে খুঁজে অতিথিদের আপ্যায়ন করেছেন। আত্নীয়দের মধ্যে আপ্রুমং, আনি, রিম্রা, উবাপ্রু, লাব্রে, ক্রজাইমা কেউ কিছুক্ষণ বসে থাকার সময় সুযোগ নেননি। পাড়ার কংজ, অলস ছাত্র ছিলেন বলে বাবা নাকি খুব পিটুনি দিয়েছিলেন, সেও চা আপ্যায়নের কমতি না রাখতে চায়ের চুলা চাড়েননি।

গ্রামের কোন আচার-অনুষ্ঠানে সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম করেন নারীরা। তারা আমাদের জন্য কী করেছেন, কী করতে হয়েছে সেটা কখনো বলেনও না। তারা নিরবে পরিবার, সমাজ, পাড়ার প্রচলিত প্রথা রক্ষায় কাজ করে যান। আমরা শিক্ষিতরা বেঁচে থাকতে, সুখে থাকতে পাড়াবাসীদের খুব কমই খবর নিই। অনেক অফিসারকে দেখেছি নিজের পাড়ায় এলে নিজের বাড়িতেও থাকেন না। দূরের অবস্থাপন্ন আত্নীয়দের বাড়িতে থাকেন। ধনী খুঁজে, অবস্থাসম্পন্নদের খুঁজে খাওয়া-দাওয়া করেন। অথচ এরা মরার পরও গ্রামবাসীরা যত্ন নিয়ে বিদায় দেবেন। আমরা পাড়াবাসীদের জন্য ভাবি না। সুযোগ পেলে গ্রামের জায়গাজমিও চুপিসারে বাইরের লোকজনদের বিক্রি করে দিই। এত কিছুর পরও গ্রামবাসীরা মুখ ফিরিয়ে নেন না। সামাজিকতা রক্ষায় কার্পণ্য করেন না।

গ্রাম থেকে বেড়ে ওঠা শিক্ষিতদের উপলব্ধিতে আসা উচিত, পাড়ায় ভালো করতে না পারি, ক্ষতি যেন না করি। আমরা অল্প শিক্ষিত, স্বল্প শিক্ষিত চাকরিজীবী থেকে বড় অফিসার, পয়সাওয়ালারাও নানা প্রক্রিয়ায় বুঝে, না বুঝে গ্রামীণ পরিবেশকে নষ্ট করেই চলেছি। পাড়াগুলো সংকোচিত হচ্ছে শিক্ষিতদের কারণে। খেটে খাওয়া মানুষদের দ্বারা গ্রাম ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি। সে উদাহরণও নেই। আমরা কথায় কথায় গ্রামবাসীদের বকা দিই, সমালোচনা করি, বদনাম করি। সমাজের প্রথা, মূল্যবোধ সব টিকিয়ে রাখেছেন গ্রামবাসীরা। তবে সময়ের বিচারে অনুপযোগী কিছু প্রথাকে প্রশ্ন করতে হলে, সেটা গ্রামবাসীদের সঙ্গে নিয়েই করা উচিত। আমরা শিক্ষিতরা গ্রাম ছেড়ে থাকতে পারলে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি।

এই যুগে গ্রাম থেকে দূরে থেকেও কাছে থাকার নানা উপায় বিদ্যমান। সেগুলোকে কাজে লাগানো উচিত। আমরা শিক্ষিতরা দূরে থাকলে গ্রামীণ মানুষগুলো অসহায়বোধ করেন। অসহায়ত্ব থেকে নানা উপসর্গ তৈরি হয়।

ফেসবুকে আমরা নিজেদের অবস্থান বুঝে বন্ধুত্ব করি। গ্রামের মানুষগুলোকে আমাদের ফেন্ডলিস্টে রাখি না। তথাকথিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও গ্রামবাসীরা অনুপস্থিত থাকেন। আমার উপলব্ধি হলো, আমরা মারা গেলে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বন্ধুরা এসে কিছু করবেন না। তারা একটা ছোট মন্তব্য দিয়ে কাজ সারবেন। কমেন্টে লিখবেন- রেস্ট ইন পিস। কাজ শেষ। গ্রামবাসীরা আমাদের বেড়ে ওঠা থেকে শুরু করে নানাভাবে যত্ন নিয়ে থাকেন। বিপদজনক গাছের আগায় উঠেছি দেখলে যেমন নামিয়ে আনেন, নদীর ধারে একা বসে আছি দেখলে নদীতে নামতে বারণ করেন।

একইভাবে একা কোথাও দেখলে, দ্রুত বাড়ি ফিরে যেতে বলেন। বেড়ে উঠতে সহায়তা করেন। আবার আমাদের বিদায়ের বেলাতেও তারাই মূল ভূমিকা পালন করেন। আমাদের সত্যিকারের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকা উচিত গ্রামবাসীদের সাথে, এলাকার মানুষদের সাথে। নেতারা আসবেন, দেখে চলে যাবেন। কাজ করেন গ্রামবাসীরা। শিক্ষিত সমাজকে, তার নিজ গ্রামবাসীর প্রাপ্য সম্মানটুকু দেয়া উচিত। সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে তাদের স্থান পাওয়া উচিত সর্বাগ্রে। এটি শুধু পাহাড়ী সমাজের বেলায় নয়, শহর-সমতল সমাজের বেলাতেও সমান প্রযোজ্য হবে বলে আমার বিশ্বাস।
 


লেখক: কলামিস্ট