জীবনের দুর্বিপাকে এলোমেলো তারকা গোলকিপার

অঘোর মন্ডল প্রকাশিত: জুন ৭, ২০২৩, ০৪:১২ পিএম

প্রিয় মোহসীন,

সাংবাদিক হিসেবে ধর্মসংকটাপন্ন মন নিয়ে লেখাটা শুরু করতে হলো! সাংবাদিকের ধর্ম: যা সত্য, সেটা তুলে ধরা। কিন্তু মন সায় দিচ্ছে না। হাতের আঙুলগুলো কি-বোর্ডে ঠিকমতো চলছে না! বিবেক বারবার পথ আঁকড়ে ধরছে। অন্তরাত্মা প্রশ্ন করছে, তুমি যা জানো তাকে পাশে সরিয়ে রেখে আবেগতাড়িত হয়ে বিষণ্ণতার ভাঙা টুকরো দিয়ে পাঠকের হৃদয়-কর্ডে করুণ সুর তুলতে চাইছ কেন! জার্নালিজমের ব্যাকরণ ভেঙে ভাইরালিজমকে পুঁজি করে ভিউ, লাইক, শেয়ারের দিকে ছুটছ? রিয়ালিটি চেক করতে ভুলে গেলে?

মন দৃঢ়ভাবে বলল, হ্যাঁ তাই। আমরা সবাই মিলে সাংবাদিকতাকে লাইক, ভিউ কেনাবেচার শেয়ার মার্কেট নিয়ে ফেলেছি! কার সূচক বাড়ল-কমল, সেটা দেখেই বাজারমূল্য নির্ধারণ হচ্ছে! তাই সাংবাদিকতার ধর্মসংকট মাথায় নিয়ে আপনাকে কিছু কথা লিখতে হচ্ছে। আপনাকে বা আপনার ফুটবল সমাজকে ছোট করার জন্য নয়। কাউকে আঘাত করার জন্য নয়। আপনার কয়েকটা ছবি আর কিছু কথা সামাজিক মাধ্যমে দারুণভাবে ভাইরাল হয়েছে। এটা দেখে অনেক কিছু মনে হচ্ছে। আমরা আপনার বর্তমান দেখে অতীতকে সামনে নিয়ে আসছি। আপনি গোলকিপার মোহসীন এ দেশের ফুটবলানুরাগীদের মন থেকে ডিলিট হয়ে গিয়েছিলেন আগেই! আপনি, মানে সেই মোহসীন যিনি আশি-নব্বইয়ের দশকের সেরা তারকা গোলকিপার! যিনি বিরাশিতে মোহামেডানের গোলপোস্টে দাঁড়ানোর সুযোগ পেয়েছিলেন তারকা কোচ গোলাম সারোয়ার টিপুর ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্তে। দলের এক নম্বর গোলকিপার লাল মোহাম্মদকে বসিয়ে আপনাকে মোহামেডানের গোলপোস্ট আগলানোর দায়িত্ব দিলেন। আপনি চ্যালেঞ্জটা নিলেন। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আবাহনীর বিপক্ষে সেই সময়ের তারকা স্ট্রাইকার কাজী সালাউদ্দিনের নেওয়া পেনাল্টি শট রুখে দিয়ে তারকা বনে গেলেন! ক্যারিয়ারে তারপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হলো কোথায়? ওই বছর দিল্লি এশিয়াডে দলে দ্বিতীয় গোলকিপার হিসেবে গেলেন। কিন্তু খেললেন প্রথম একাদশে! ‍‍’৮৫-তে মোহামেডানের অধিনায়ক। একই বছর বাংলাদেশ মেক্সিকো বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব খেলার সুযোগ পেল। আশিস ভদ্র দলের অধিনায়ক। আপনি গোলকিপার। বাংলাদেশের প্রথম বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব খেলার সদস্য। এরপর যোগ দিলেন আবাহনীতে। সেরা সময়টা সেখানেই পার করলেন। অধিনায়কত্ব করলেন। আবার আবাহনী-মোহামেডান-ব্রাদার্স পুল প্রথার নামে ফুটবলারদের পায়ে শিকল পরানোর চেষ্টা করল তখন সেখানেও বিদ্রোহী আপনি। জাতীয় দলের প্রায় সব খেলোয়াড় নিয়ে গড়া হলো মুক্তিযোদ্ধা সংসদ। সেই দলেরও অধিনায়ক আপনি। ঢাকার ফুটবলের সেই সময়ের তিন বড় দল, মোহামেডান, আবাহনী, মুক্তিযোদ্ধার আর্ম ব্যান্ড পরা একমাত্র তারকা আপনি। সেই মোহসীনের যে ছবি দেখে ফুটবলপ্রেমীদের হৃদয়ের রক্ত ক্ষরণ শুরু হয়েছে, সেটা শারীরিক-মানসিকভাবে বিধ্বস্ত একজন তারকা গোলকিপারকে নিয়ে আকুতি হতে পারে আপাতত। আসলে ওটাই বাংলাদেশ ফুটবলের বাস্তবতার প্রতীক! গোলপোস্ট দাঁড়িয়ে বাজপাখির মতো ছোঁ মেরে বল গ্লাভসবন্দী করতেন, কিংবা প্রতিপক্ষের ভয়ংকর সব স্ট্রাইকারের পায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে বল আটকেছেন, তার সেই হাত অন্যের দয়া বা সাহায্যপ্রার্থী হতে পারে, এটা আমরা যারা আশি-নব্বইয়ের দশকের ফুটবল দেখেছি, কাভার করেছি, তাদের পক্ষে বিশ্বাস করা কঠিন! কারণ, আমরা দেখেছি, মোহসীন, কায়সার, রুমি, মুন্না, আসলাম, বাদল রায়, আশিস ভদ্রদের ঘিরে দর্শক-উন্মাদনা কী ছিল। আপনাদের প্র্যাকটিস দেখতে হাজার পাঁচেক মানুষ প্রতিদিন জড়ো হতো! আবাহনী, মোহামেডানের ক্লাবগেট আটকে রাখা হতো দর্শকদের বন্য ভালোবাসা থেকে ফুটবলারদের বাঁচাতে!
 

ফুটবলার মোহসীন। ছবি কৃতজ্ঞতা: শহীদুল আজম


আপনি সেই মোহসীন, যার ভিউকার্ড বিক্রি হতো শুধু পোশাকের স্টাইল দেখার জন্য! যাকে সেই সময়ের জনপ্রিয় সাপ্তাহিক বিচিত্রায় ঈদ সংখ্যায় পোশাকের মডেল হিসেবে বেছে নেওয়া হতো! আপনি সেই মোহসীন, যিনি আবাহনী ক্লাবের গেট পেরিয়েই সাতমসজিদ রোড়ে পা রাখতে ভক্তরা ভিড় জমাতেন! আপনি সেই মোহসীন, যার শুধু পুরুষ ফ্যান ছিল না। আপনার ভক্তের তালিকায় সেই সময়ের জনপ্রিয় সিনেমা-নাটকের নায়িকারাও ছিলেন! বাকি তরুণীদের কথা বাদই দিলাম।

আপনি সেই মোহসীন, মোহামেডান, আবাহনী, মু্ক্তিযোদ্ধার ক্লাবের কর্তারা যাকে সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক দিয়ে রাখতেন। নিজেদের গোলপোস্ট সেভ থাকবে সেই আশায়। মোহসীন, আপনার ভাইরাল হওয়া কয়েকটা ছবিতেই দারুণভাবে ফুটে বেরিয়েছে, বাংলাদেশ ফুটবলের অতীত আর বর্তমান!  আপনার গায়ে সেই সময়ে আবাহনীর জার্সির স্পন্সর মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির কোমল পানীয় ‍‍‘কোকাকোলা‍‍’! সেই কোম্পানি এখন ক্লাব দূরে থাক, জাতীয় দলকেও স্পন্সর করার কথা ভাবতে পারে না! আমদের দেশের ফুটবল এতটা গরিব হয়ে পড়েছে!

দেশের সাবেক অধিনায়ক আপনি শারীরিক-মানসিকভাবে আজ অসুস্থ। আপনার পাশে দাঁড়ানোর উদারতা, সাহস কোনোটাই দেখাতে পারলেন না বাফুফের সভাপতি, যিনি ফেডারেশন কাপের ফাইনাল দেখতে কুমিল্লা যান হেলিকপ্টারে চড়ে! সোশ্যাল মিডিয়ায় আপনি নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্ট করে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন, আপনার খারাপ সময়ে বিসিবি সভাপতি পাশে দাঁড়ানোর জন্য। কৃতজ্ঞতা আপনি জানাতেই পারেন। নতুন প্রজন্মের দেশজ ফুটবল প্রেস হয়তো জানে না, এটা আসলে ক্রিকেট বোর্ড ফুটবলের কাছে পুরোনো ঋণের কিছুটা শোধ করল! কারণ, আশি-নব্বই দশকে আপনাদের মতো তারকারা ফুটবল খেলতেন বলেই সেই সময়ের ঢাকা স্টেডিয়ামের গ্যালারি দর্শকে উপচে পড়ত। বাফুফের অ্যাকাউন্টও মোটা হতো! বাফুফের কাছ থেকে ঋণ করে বিসিবি ক্রিকেট চালিয়েছে। সেটা বছরের পর বছর! আপনাদের তারকারা খেলতেন বলে দর্শক পয়সা দিয়ে টিকিট কেটে মাঠে ঢুকতেন ফুটবল দেখতে।

সেই মোহসীন খ্যাতি, যশ, অর্থকড়ি সব পাওয়ার পর হঠাৎ আরও সুখবিলাসী হতে উন্নত জীবনের খোঁজে কানাডায় পাড়ি জমালেন! সেখানেই থিতু হওয়ার চেষ্টায় বিয়ে করলেন। ঘর-সংসার শুরু করলেন! দেশের হয়ে যিনি দীর্ঘদিন গোলপোস্ট আগলেছেন, তিনি তার নিজের সংসারটা আগলে রাখতে পারলেন না! আপনার জীবন সংসারের জালে এত ছিদ্র আটকানোর জন্য শুধু ট্যালেন্ট যথেষ্ট নয়। জীবনের পোস্ট আগলে রাখতে আরও কিছু দরকার পড়ে। সেই তালিকায় সবার ওপরে আছে শৃঙ্খলা। আপনার জীবনে সেটারই বড্ড অভাব ছিল। তাই জীবনের এই সময় আপনার মতো একজন তারকা ফুটবলারের এই ভবিতব্য!

আপনার চারপাশে একসময় এত ভক্ত-সমর্থক, সেই আপনি আজ নিঃস্ব।নিঃসঙ্গ! আপনার এই অবস্থা দেখে কানাডায় আপনার বন্ধু, একসময়ের টিমমেট রুমি, মামুন জোয়ার্দার, মিজানরা বাক্‌রুদ্ধ। অশ্রুসিক্ত। নিজেদের সামলে নিয়ে তারাও অনেক কথা বললেন। তারা কেউ বসে নেই। মামুন আমাকে কল করে জানিয়েছেন, তারা আপনার জন্য কানাডায় সব করতে প্রস্তুত। মামুনের অনুরোধ, ‍‍‘দাদা, মোহসীন ভাইয়ের পাসপোর্টের মেয়াদ আছে কি না, একটু জেনে দিন।‍‍’ আমি তাকে জানিয়েছি এখনো ৯ মাসের মেয়াদ আছে।‍‍’ ও প্রান্ত থেকে উত্তর এলো,‍‍ ‘আমরা টিকিট পাঠাব। আপনারা একটু কষ্ট করে হুইলচেয়ার বুক করে তাকে কানাডার ফ্লাইটে তুলে দেবেন। মোহসীন ভাই কানাডার নাগরিক। তাকে এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি আমরা হাসপাতালে নিয়ে যাব। কোনো অসুবিধা হবে না। চিকিৎসাসহ সবকিছু হবে বিনা পয়সার। তবে কষ্ট লাগে দেশের জার্সি গায়ে কম কিছু করেছেন মোহসীন ভাই? আজ তার এই অবস্থা, দোষ হয়তো তারও আছে। কিন্তু ফুটবল কর্তারা তার পাশে দাঁড়ানোর উদারতা দেখাতে পারলেন না!‍‍’

খানিকটা দার্শনিকতা নিয়ে তার কথাগুলো শুনলাম আর বললাম, খারাপ খবরগুলো মন থেকে ডিলিট করে রাখতে চাই। কিন্তু এবার মোহসীনের কারণে ফুটবল নিয়ে খারাপ খবরই লিখতে হলো! মোহসীনকে শেষবার দেখছিলাম ধানমন্ডিতে একটা রেস্টুরেন্টে!  বলতে দ্বিধা নেই, চিনতে কষ্ট হয়েছিল!  মোহসীন কী খবর? এ অবস্থা কেন? কষ্ট মেশানো হাসি টেনে বলেছিল, ‍‍‘ভালো নেই দাদা!‍‍’ ভালো নেই মানে এতটা খারাপ হবে ভাবতে পারিনি!
নিজে জানি জীবন মানে স্ট্রাগল। যন্ত্রণা। জীবনের দুর্বিপাক হ্যান্ডেল করতে হয় যুক্তি, ভাবনা, মন, মনন সব মিলিয়ে! সেই জায়গায় আপনি ব্যর্থ! তবে এটা জানি স্টারডোমটা আপনি উপভোগ করেছেন। পরবর্তী ধাক্কাটার কথা ভাবতে পারেননি! এখনো সব শেষ হয়ে যায়নি মোহসীন। এই ধাক্কাটা থেকে আপনাকে বেরিয়ে আসতে হবে। তার জন্য মনকে শক্ত করতে হবে। শান্ত করতে হবে। আশায় বুক বাঁধতে হবে।

মন থেকে অজানা আশঙ্কা দূর করে ফেলুন। চারদিকে আরও অনেককে পাবেন বিসিবি সভাপতির মতো। কানাডায় আপনার বন্ধুরা সব অপেক্ষায় আছেন। আপনাকে কানাডায় নিয়ে যাবেন ওরা। সব হারালেও কিছু বন্ধু এখনো আপনার আছেন। ফুটবল মাঠে পোস্টের নিচে এত সাফল্য যার ফুটবল ঈশ্বর তাকে একেবারে নিঃস্ব করবেন কেন! জীবনের দমকা হাওয়া আপনাকে এলোমেলো করে দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু সুপারস্টার গোলকিপারকে দেশের নতুন প্রজন্মের কাছে বড় নিষ্ঠুরভাবে পরিচিত করে দিয়ে গেল!

এভাবে আপনাকে আমাদের তুলে ধরতে হবে কোনো দিন ভাবতে পারিনি! মুন্না অসুস্থ হয়ে মারা যাওয়ার পর বুঝেছিলাম মেগাস্টারকেও এ দেশের মানুষের ভুলতে সময় লাগে না! আর আপনার এই অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, এই সমাজ শুধু সাফল্য দেখে বা মনে রাখে। বাকি যা করে সেটা করুণার মতো, কিন্তু আপনার কি এই করুণা প্রাপ্য ছিল? শেষ করতে চাই চুরাশি সালে মুক্তিযোদ্ধা সংসদে যোগ দিয়ে আপনি যা বলেছিলেন, সেই বাক্যটা   দিয়ে,‍‍ ‘আমরা ফুটবলকে বাঁচাতে বড় ক্লাবের শিকল কেটে বেরিয়ে এসেছি!‍‍’ সেই কথাটা অন্যরকমভাবে এখন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে কানে। ‍‍‘আমরা মোহসীনকে বাঁচাতে চাই।‍‍’

শুভকামনা
অঘোর মন্ডল