সাত দিনের মধ্যে অনিবন্ধিত অনলাইন মিডিয়া বন্ধের একটা আদেশ এসেছে উচ্চ আদালত থেকে। এক রিট আবেদনের নিষ্পত্তিতে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ এই আদেশ দেন। আগামী সাত দিনের মধ্যে বিটিআরসি চেয়ারম্যান ও প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যানকে এ নির্দেশ বাস্তবায়ন করে প্রতিবেদন দাখিলের কথাও বলা হয়েছে আদেশে। বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মো. কামরুল হোসেন মোল্লার সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। আদেশে নিবন্ধনের অপেক্ষায় থাকা অনলাইন মিডিয়া বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও আদালত বলেছেন।
ডিজিটাল বাংলাদেশে দ্রুত প্রসারমাণ এক খাত হচ্ছে এই অনলাইন মিডিয়া। ইন্টারনেটভিত্তিক এই মিডিয়াগুলোর শুরুতে নিবন্ধনের কোনো ব্যবস্থা না থাকলেও ২০১৫ সালের দিকে সরকার নিবন্ধনের উদ্যোগ নেয়। এতে কয়েক হাজার অনলাইন নিউজ পোর্টাল নিবন্ধনের আবেদন করে। পরে সময়ে-সময়ে এই নিবন্ধনের আবেদনও বাড়ে। এই ছয় বছরে সরকার মাত্র ৯২টি অনলাইন মিডিয়াকে নিবন্ধনের অনুমতি দিয়েছে। নিবন্ধনের এই প্রক্রিয়ায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে দফায় দফায় তদন্তও করা হয়। একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা এই তদন্তের কাজ করে আসছে।
একটি অনলাইন নিউজপোর্টালের প্রধান সম্পাদক হওয়ার সুবাদে একাধিকবার এই সংস্থাগুলোর মুখোমুখি হয়েছি, আমাদের মিডিয়ার অন্য দায়িত্বশীলেরাও হয়েছেন। সর্বশেষ এই বছরের প্রথম অর্ধের দিকে যে তদন্তের মুখে, বলা যায় জেরার মুখে পড়েছিলাম সেটা সংবাদ, সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। একটি সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন আমার রাজনৈতিক অবস্থান নিয়েই বরং বেশি আগ্রহী ছিলেন। আমি আওয়ামী লীগ করি কি না, এ নিয়েই ছিল তার সমূহ আগ্রহ। আমি ‘আওয়ামী লীগ করি’ এটাই আমার মুখ দিয়ে শুনতে চেয়েছিলেন তিনি। স্বীকারও করেছেন আওয়ামী লীগ না হলে তারা ইতিবাচক প্রতিবেদন দিতে পারবেন না। তাকে বলেছিলাম এখন তো ঘরে ঘরে আওয়ামী লীগ, জামায়াত-শিবিরের লোকজনও নিজেদের আওয়ামী লীগ দাবি করে থাকে, এ ক্ষেত্রে আপনারা কীভাবে সেটা নিচ্ছেন। উনি বলেছিলেন, সংশ্লিষ্টদের মুখ থেকে ‘আওয়ামী লীগ করি’ শোনাটাই দরকার তাদের।
আমার ছাত্রজীবনে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততার প্রসঙ্গে তার মূল্যায়ন ছিল মানুষ বদলাতে বেশি সময় লাগে না। ছাত্ররাজনীতির প্রসঙ্গ আমার দৃষ্টিতে অপ্রাসঙ্গিকভাবে তিনিই এনেছিলেন। আমার পরিবারের রাজনৈতিক বিশ্বাস-অবস্থান সবটাই ছিল তার নখদর্পণে, তবু বারবার আমার মুখ থেকে ‘আওয়ামী লীগ করি’ কথাটাই শুনতে চাওয়াই লক্ষ্য ছিল তার। বিরক্ত আমি সেদিন সরাসরি বলেছিলাম—‘আমি একটা মিডিয়ার প্রধান সম্পাদক হিসেবে আপনার কাছে আমি আমার রাজনৈতিক বিশ্বাসের জায়গাটা নিয়ে কথা বলতে পারি না। আমার অবস্থান রাজনৈতিক বিশ্বাস প্রকাশের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে যাবে, অন্তত নিবন্ধন পাওয়ার উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক বিশ্বাস প্রকাশ সমীচীন নয়। আমি দুঃখিত আমি এটা নিয়ে কিছু বলব না।’ আমার এই অবস্থান তাকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি, বুঝেছিলাম সঙ্গে সঙ্গেই। ওই আলোচনায় তিনি আমাকে বলেওছিলেন ছাত্ররাজনীতি করলে আমার নামে কোনো মামলা নাই কেন? হাস্যকর যত সব প্রশ্ন!
তদন্তের ওই পর্যায়ে বুঝতে পেরেছিলাম যারাই তদন্তের কাজে ছিল তাদের সাংবাদিকতা সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা নাই। ‘নাই’ বলছি অন্তত ওই প্রশ্নকর্তার প্রশ্নের ধরন দেখে। ওই সংস্থার সেই দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি খোঁজখবর নিতে আমাদের ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে পর্যন্ত ফোন দিয়েছিলেন। এর আগে তদন্তের আরেক পর্যন্ত থানা থেকেও খবর পর্যন্ত নেওয়া হয়েছিল। বিভিন্ন সংস্থার এই তদন্তের বেশির ভাগ প্রশ্নই ছিল রাজনীতিকেন্দ্রিক। মনে হয় রাষ্ট্র সংবাদ, সংবাদবিষয়ক প্রতিষ্ঠানের জন্য যোগ্য ব্যক্তি খুঁজছে না, খুঁজছে তেমন রাজনীতিক যারা নাকি মিডিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকবে। আরেকবার আরেক তদন্তকারী কর্মকর্তা আমার শ্বশুরবাড়ি কোথায়, সেটাও তাদের জানা বলে জানিয়েছিলেন। অথচ অনলাইন নিউজ পোর্টালের নিবন্ধনের সঙ্গে এই প্রসঙ্গ যেমন অপ্রয়োজনীয়, তেমনি নিবন্ধন আবেদনেও সেটা উল্লেখ ছিল না।
আমার আদর্শিক অবস্থান বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতার বাহাত্তরের সংবিধান, মুক্তির সংগ্রাম থেকে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ; প্রসঙ্গক্রমে বলেছিলাম একবার। তবে তার একটাই দাবি ছিল বলতে হবে ‘আওয়ামী লীগ করি’। কতটা অপেশাদার লোক দিয়ে তদন্ত সম্ভব, ভাবতে পারিনি! গণমাধ্যমের সঙ্গে যুক্তদের সঙ্গে কেমন ও কীভাবে প্রশ্ন করতে হয় এই শিক্ষার অভাব ছিল তার। আমি জানি না অন্যদের ক্ষেত্রে এমন হয়েছে কি না, তবে আমার অভিজ্ঞতা সুখকর নয় নিশ্চিতভাবেই। কারণ এই ধরনের প্রশ্ন সত্যি অপমানজনক। অনলাইন মিডিয়ার নিবন্ধনের তদন্তকাজে যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত তাদেরকে আরও বেশি মিডিয়াবান্ধব ও মিডিয়াধর্ম সম্পর্কে অবগত হওয়া উচিত বলে আমার অভিমত। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় এ নিয়ে আরও সতর্ক পদক্ষেপ নেবে বলে আশাও করি। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার উল্লেখ মূলত এই কাজে তাদের দায়িত্ব দেওয়া উচিত যারা সত্যিকার অর্থে পেশাদারত্বের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ সেই বার্তাটা দেওয়া। তা না হলে লক্ষ্যবিচ্যুতি অবশ্যম্ভাবী। রাজনৈতিক সরকার সব সেক্টরে নিজেদের লোক চাইতে পারে, কিন্তু এই চাওয়ার মধ্যে রাষ্ট্রীয় চরিত্র, পেশাদারত্ব যেন বজায় থাকে। সাংবাদিক পরিচয়ধারীরা কি সাংবাদিক; নাকি সাংবাদিক পরিচয় ব্যবহারকারী, এখানে ‘পরিচয়ের’ সঙ্গে ‘ব্যবহারকারী’ শব্দের যে যোগ ও পার্থক্য এটা বুঝতে না পারা কাউকে তদন্তের দায়িত্ব দিলে রাষ্ট্রের প্রকৃত উদ্দেশ্যই ব্যাহত হয়, হচ্ছে, হবেও।
ছয় বছর ধরে নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারেনি সরকার। অনলাইন সংবাদপত্রের নিবন্ধন চালুর পর অনিবন্ধিতগুলো বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলে আসছিলেন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। তবে সরকারের পক্ষ থেকে আবেদিত মিডিয়াগুলোর আবেদনের নিষ্পত্তির আগেই এ নিয়ে আদালতের একটা আদেশ এসেছে। মন্ত্রী আদালতের আদেশের পর বলছেন, একসঙ্গে সবগুলো অনলাইন বন্ধ করা হবে না। একই সঙ্গে তারা আবেদিত মিডিয়াগুলোর আবেদন নিয়ে কাজ করবেন বলেও জানিয়েছেন। মন্ত্রী জানিয়েছেন তারা আদালতকে জানাবেন যে সাত দিনের মধ্যে সবগুলো বন্ধ করে দেওয়া ঠিক হবে না। দেশে এত অনলাইনের দরকার নেই উল্লেখ করে মন্ত্রী গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘অনলাইনগুলোর আবেদনের পর যাচাই-বাছাই করার জন্য আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠাই। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এগুলো তদন্তকারী সংস্থাকে দেয়। সেটি শেষ করে না আসা পর্যন্ত আমরা দিতে পারি না। এ কারণে সময় লাগছে।’ মন্ত্রী বলেন, ‘এখন যেগুলো নিবন্ধনপ্রাপ্ত, সেগুলো ছাড়া আর কোনো অনলাইন ভবিষ্যতে বের হবে না তেমন নিয়ম তো নেই। আজকে যেসব পত্রিকা আছে, সেগুলো ছাড়া ভবিষ্যতে আর কোনো পত্রিকা বের হবে না, তেমন নিয়মও নেই। এই নিয়ম আমাদের দেশেও নেই, অন্য কোনো দেশে আছে কি না, তা-ও জানা নেই।’ মন্ত্রীর এই বক্তব্য আশাব্যঞ্জক। তবে যে প্রক্রিয়া ধরে বিশেষত যে তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আবেদনগুলোর নিষ্পত্তি তারা করছেন, সেটা কি ঠিক হচ্ছে, আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে এই প্রশ্ন!
‘ঘরে-ঘরে অনলাইন’—এমন একটা আওয়াজ আছে সবখানে। এই আওয়াজ অনেকটা অভিযোগের সুরে, যদিও এটা অসত্য নয় পুরোপুরি। এ ক্ষেত্রে সরকার যে নিবন্ধনের ব্যবস্থা করেছে, সেটাকে অবশ্যই সমর্থন করি। তবে নিবন্ধনের নামে নিয়ন্ত্রণকে সমর্থন করতে পারি না। নিয়ন্ত্রণ বলছি, কারণ ওই যে তদন্তে রাজনীতি ধরে টান! এটা উচিত বলে মনে করি না।
যা-ই হোক, অনিবন্ধিত অনলাইন নিউজ পোর্টালকে সাত দিনের মধ্যে বন্ধের যে নির্দেশ এসেছে হাইকোর্ট থেকে, সেটা এক রিটের নিষ্পত্তি। এর উৎস মূলত কলেজছাত্রী মোশারাত জাহান মুনিয়ার মৃত্যু। মুনিয়ার মৃত্যুর ঘটনায় অনেক অনলাইন নিউজ পোর্টাল, অনলাইন চ্যানেলে ‘সম্মানহানিকর’ খবর প্রকাশ বন্ধে গত জুন মাসে আইনজীবী জারিন রহমান ও রাশিদা চৌধুরী নীলু উচ্চ আদালতে রিট করেছিলেন। পরে এই দুই আইনজীবী অননুমোদিত, অনিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল বন্ধের আদেশ চেয়ে আবেদন করেন। সেই রিটের ধারাবাহিকতায় এসেছে অনিবন্ধিত অনলাইন নিউজ পোর্টাল বন্ধে হাইকোর্টের এই আদেশ। মুনিয়ার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে আমরা দেখেছি অনেক পরিচিত-অপরিচিত অনলাইন মিডিয়ায় অপপ্রচার ও চরিত্রহানির চেষ্টা। আগে থেকে অপরিচিত অনেক অনলাইন নিউজ পোর্টালের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ছিল মুনিয়ার মৃত্যুতে অভিযুক্ত একটি শিল্প গ্রুপের মালিকানাধীন মিডিয়াগুলো। মজার বিষয় হচ্ছে, আদালতের নির্দেশে সরকার অনিবন্ধিত অনলাইন মিডিয়াগুলো বন্ধ করলেও ওই শিল্প গ্রুপের মালিকানাধীন মিডিয়াগুলোর কিছুই হবে না। তারা মুনিয়ার মৃত্যুর পর মালিকপক্ষকে বাঁচাতে অপসাংবাদিকতা করলেও স্রেফ নিবন্ধন থাকার কারণে তারা থাকবে বহাল তবিয়তে। কারণ, এখন পর্যন্ত সরকার যে ৯২ অনলাইন মিডিয়াকে নিবন্ধনের অনুমতি দিয়েছে, সেখানে আছে এই শিল্প গ্রুপের মালিকাধীন মিডিয়াগুলোও।
যে উদ্দেশ্য নিয়ে অননুমোদিত ও অনিবন্ধিত অনলাইন মিডিয়া বন্ধে হাইকোর্টের আদেশ, সেটার প্রকৃত বাস্তবায়ন কি সম্ভব হবে? এর কাগুজে বাস্তবায়ন হয়তো সম্ভব হবে। নানা কারণে নিবন্ধনের বাইরে থাকা সুস্থধারার অনেক মিডিয়া হয়ত বন্ধ হয়ে যাবে। একইভাবে উদ্দেশ্যমূলক কিছু অপপ্রচারকারীও নিবন্ধনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে টিকে থাকবে।