বাঙালি অতীতের প্রতি মমত্বহীন। সেই সংস্কৃতির প্রকাশ তার ক্রিকেটও বারবার ধরা পড়েছে! নিকট অতীতকে যারা খুব তাড়াতাড়ি ভুলে যেতে পারেন, সুদূর অতীত নিয়ে তাদের কোনো আগ্রহ থাকারই কথা নয়। সেটা বাঙালির রাজনীতি, ক্রীড়া, সংস্কৃতি সব জায়গায়। কিন্তু কিছু ইতিহাস, কিছু রেকর্ড আপনি না চাইলেও কুইজের মতো সামনে চলে আসে।
ধরুন টেস্ট প্লেয়িং দেশ হিসেবে বাংলাদেশের কাউকে যদি প্রশ্ন করা হয়, প্রথম বাঙালি টেস্ট ক্রিকেটার কে? আপনি অনেকগুলো উত্তর পেতে পারেন। বিভ্রান্ত হতে পারেন। কিন্তু সঠিক উত্তরের জন্য যদি কিছু ক্লুও দেন, তাহলেও সঠিক উত্তর পাওয়া কঠিন হতে পারে। যদি বলে দেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তার টেস্ট অভিষেক হয়েছিল, সব মিলিয়ে চৌদ্দটা টেস্ট খেলেছেন অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, পাকিস্তানের বিপক্ষে। তিনি একজন উইকেটকিপার ব্যাটার ছিলেন। স্যার ডন ব্র্যাডম্যানকে প্রথম এবং একমাত্র বাঙালি উইকেটকিপার হিসেবে অ্যাডিলেডে প্র্যাকটিস ম্যাচে স্টাম্পড করেছিলেন। জন্ম এই বাংলাদেশে। গুগলে সার্চ দিয়ে পি সেন জাতীয় একটা নাম খুঁজে হয়তো পাবেন! কিন্তু আর কিছু?
পাবেন। সেটা অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়ার নিখুঁত, নির্ভুল দু-একটা বাক্য। যারা অন্যের জন্য গোটা দুয়েক প্রশংসাবাক্য লিখতে বার তিনেক ভাবেন, সেই অজি মিডিয়া যথেষ্ট সম্ভ্রম নিয়ে লিখেছিল “দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে ভারতীয় দলের অস্ট্রেলিয়া সফরে।” পার্থের ‘দ্য ডেইলি নিউজ’ লিখেছিল, ‘একজন গাট্টাগোট্টা, বেঁটেখাটো তরুণ উইকেটকিপারকে নিয়ে এসেছে ভারত। গ্লাভস হাতে উইকেটের পেছনে এই বেবি যথেষ্ট দক্ষ। মানকড়ের বলে ডনকে স্টাম্পড করে নিজের দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।
এই তরুণের জন্ম আর বেড়ে ওঠা যে শহরে সেই শহর তাকে মনে রাখেনি। সেই দেশের মানুষও তাকে চেনেন না! অথচ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যত ব্রিটিশ সৈন্য মারা যায়, তাদের স্মৃতি ধরে রাখতে সেই কুমিল্লায় সযত্নে তৈরি হয়েছে সমাধিস্থল। রোজ নিয়ম মেনে কত ইতিহাসপিপাসু পর্যটক আসেন সেখানে, কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর সেই শহীদদের শ্রদ্ধা জানান তারা।
অথচ সেই বিশ্বযুদ্ধের পরপরই টেস্ট গ্রহে প্রথম বাঙালি হিসেবে যিনি পা রেখেছিলেন, সেই প্রবীর সেনকে তার শহর মনে রাখেনি। তার নাম জানেন দু-একজন। পুরো একটা দিন কুমিল্লা চষে বেড়িয়ে এমন কাউকে পাওয়া গেল না যিনি প্রথম বাঙালি টেস্ট ক্রিকেটার প্রবীর সেন বা খোকা সেন সম্পর্কে দু-একটা তথ্য দিতে পারেন! কুমিল্লার স্থানীয় একটা কাগজের সম্পাদক আবুল হাসনাত বাবুল জানালেন, ‘তার বাড়ি সম্ভাবত ছিল ঠাকুরপাড়া এলাকায়।’ কিন্তু সেটাই ঠিক, তা নিশ্চিত নন কুমিল্লার ক্রীড়া এবং সংস্কৃতি অঙ্গনের পরিচিত মুখ বদরুল হুদা জেনু।
স্থানীয় এক ইতিহাসবিদ বললেন, ‘যে শহর ভাষা আন্দোলনের অগ্রসেনানী ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে মনে রাখে এক স্টেডিয়ামের মধ্য দিয়ে, সেখানে প্রথম বাঙালি টেস্ট ক্রিকেটারকে মনে রাখবেন কে! তবে আমি যেটুকু জেনেছি প্রবীর সেনের বাবা অমিয় সেন এখানকার প্রতিষ্ঠিত একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। দেশভাগের আগে থেকেই তাদের কলকাতায় যাতায়াত ছিল।’
যে শহরে শচীন-কর্তার বাড়ি। যেখানে কাজী নজরুল ইসলাম আসতেন। থাকতেন। গান লিখেছেন। সুর দিয়েছেন সেই রাজবাড়ীরও অর্ধেকটা হয়ে গেছে হাঁস-মুরগির খামার, সেই শহর প্রবীর সেন বা খোকা সেনকে খুব মনে রাখবে সেটা আশা করা একটু বাড়াবাড়ি না! বরং মন্দের ভালো প্রবীর সেন সম্পর্কে জানতে চাইলে বা খোঁজ নিতে গেলে এনামুল হক মনি, এমদাদুল হক, ফয়সাল হোসেন ডিকেন্সদের উত্তর বা পূর্বসূরি কেউ বলেননি, ৮৪ বছর আগে এই শহরের কে কোথায় কী করেছেন, তা জেনে আমি কী করব? আমার তাতে কী লাভ!
ইতিহাস লাভ-লোকসানের হিসাব রাখে। কুমিল্লার এক ভদ্রলোক বাঙালির ইতিহাসের প্রথম টেস্ট ক্রিকেটার। ভারতের হয়ে ১৪ টেস্ট খেলেছেন। বাংলাদেশ নামে বিশ্বে কোন দেশের জন্মের আগেই তিনি মারা যান মাত্র ৪৩ বছর বয়সে। ১৯২৬ সালের এই দিনে (৩১ মে) তাঁর জন্ম হয়েছিল অবিভক্ত বাংলার কুমিল্লায়। সুনীল গাভাস্কারের মামা মাধব মন্ত্রীকে সরিয়ে দলে জায়গা করে নিয়েছিলেন। বাঙালিও টেস্ট খেলতে পারে, বিশ্বকে এই বার্তাটা প্রথম দিয়েছিলেন প্রবীর সেন। তাঁর জন্মভূমি তাকে স্মরণ করতে না পারলেও ইতিহাস তাঁকে বুকে আগলে রাখবে।
লেখক: সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলামিস্ট