বাঙালির প্রাণের উৎসব

কবির য়াহমদ প্রকাশিত: এপ্রিল ১৩, ২০২৩, ০৬:৪৫ পিএম

প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখকে বাঙালির একমাত্র সার্বজনীন উৎসব বলা যায়। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এ একটা দিনই জাতিসত্তা ও দেশকে ধারণ করা বাঙালির অন্যান্য সকল আনন্দ ও উৎসব ম্লান হয়ে যায় পহেলা বৈশাখের কাছে এসে। লুপ্ত হয়ে যাওয়া, সুপ্ত হয়ে থাকা বাঙালিয়ানার উদগীরণে বাঙালি এদিন যে উৎসবে মাতে তার তুলনা হয় একমাত্র উৎসবের রঙে রাঙানো বাংলা নববর্ষের সঙ্গেই।

আমাদের স্বাতন্ত্র্য, সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার পহেলা বৈশাখের উৎসব আমেজ দিন দিন বাড়ছে। দশক আগের বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন আর অদ্যকার এ দিনের মধ্যে পার্থক্য বিস্তর। এখন মানুষ এ দিনে প্রাণাবেগে বানের জলের মত নেমে আসে পথে, উৎসবের রঙে নিজে সাজে, অন্যকেও সাজিয়ে দিতে চায় নিজস্ব ভঙ্গিমায়। ব্যক্তিগত আনন্দকে সমষ্টিতে রূপান্তরের এ অভিপ্রায় ধার করা সংস্কৃতি থেকে উৎসারিত হলে সম্ভব হতো না। প্রাণের উৎসব আর আরোপিত উৎসবের মধ্যে এ পার্থক্য বহতা জলের মত, তাই এটা আমাদের একান্ত নিজস্ব বলে উচ্ছ্বাসের মাত্রা বাঁধভাঙা।

পহেলা বৈশাখের এ উৎসব সার্বজনীন একবাক্যে হয়ত বলা যাবে না। কারণ বাঙালি আর বাঙালিয়ানার শত্রু সব সময়েই ছিল, এখনও আছে। তবে যে বা যারা নিজেদেরকে প্রকৃত বাঙালি বলে বিশ্বাস করে, বাঙালিত্বকে নিজেদের মধ্যে ধারণ করে তাদের সকলের মধ্যেই আছে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের সীমাহীন আগ্রহ।

এর বাইরে দেশে অগণন লোক আছে যারা বাংলাদেশে বাস করে তবে নিজেদেরকে এদেশীয় কিংবা বাঙালি ভাবে না, অথবা বাংলাদেশের নাগরিকত্বকে কষ্টভোগতূল্য ভাবে তাদের কাছে বাঙালির সংস্কৃতি, আচার আর পহেলা বৈশাখকে ধারণ ও উদযাপনের চিন্তা অযৌক্তিক ঠেকে। এরা সংখ্যায় কম নয় মোটেও, বাংলাদেশের নাগরিকও বটে। তবে পহেলা বৈশাখকে উদযাপন করার মানসিকতা ধারণ করে না।

প্রাণের উৎসব হিসেবে পহেলা বৈশাখের সার্বজনীন রূপে রূপান্তর টের পাওয়া যায় গত কয়েক বছরের ব্যাপকতা দেখে। দিন দিন এ উৎসবের ব্যাপকতা দেশের সকল স্তরে যেভাবে ছড়িয়ে পড়েছে তাতে করে বছরের এ একটা দিন মানুষের শেকড়ের কাছাকাছি যাওয়ার তুমুল অভিপ্রায় আমাদের আশাবাদী হওয়ার প্রেরণা যোগায়।

আগে যে উৎসব একটা শহরের নির্দিষ্ট কয়েকটি জায়গায় সীমাবদ্ধ থাকত, এখন তা শহরের অলিতে-গলিতে ছড়িয়ে গেছে। জেলা শহর, উপজেলা শহর, এমনকি এর বাইরেও বিচ্ছিন্নভাবে উদযাপিত হচ্ছে প্রাণের এ উৎসব। জনমানুষের মধ্যে পহেলা বৈশাখকে উৎসব হিসেবে গ্রহণ করার এ মানসিকতার বিপরীতে এ সমাজের মধ্যেই আছে চাপিয়ে দেওয়া এক ধরনের সামাজিক প্রতিবন্ধকতা; যা চাপিয়ে দেওয়া ধর্মীয় বোধ থেকে উৎসারিত।

পহেলা বৈশাখ উদযাপন ও বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ইসলাম কিছু না বললেও কিছু মানুষ আরবদেশীয় সংস্কৃতি ও আচারকে প্রতিষ্ঠিত ও উচ্চাসন দিতে গিয়ে বাঙালি সংস্কৃতির বিরোধিতায় মেতে ওঠেছেন। এখানে ধর্মীয় বিরোধ যতখানি তারচেয়ে বেশি ভিনদেশিয় সংস্কৃতিকে প্রতিষ্ঠিত করার মহাপরিকল্পনা। ফলে তারা তাদের নিজস্ব চিন্তার দীনতা ও জ্ঞানের সীমাবদ্ধতাকে ঢাকতে গিয়ে সরাসরি বাঙালির প্রাণের উৎসবের বিরুদ্ধাচরণ করছেন। এবং বক্তব্যের যথার্থতাকে প্রমাণ করতে গিয়ে ধর্মের আশ্রয় নিয়েছেন।

তবে আশার কথা ধর্মসৃষ্ট এ সামাজিক প্রতিবন্ধকতা স্বত্বেও সাম্প্রতিক সময়ে প্রান্তিক পর্যায়ের জনগোষ্ঠীর মাঝেও পহেলা বৈশাখ উৎসব হিসেবে দেখা দিচ্ছে। ঈদ-পূজার মত এ দিনেও মানুষজন আনন্দ করছে। অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল-অসচ্ছল নির্বিশেষে পরিবারগুলোর অনেকেই এখন বাংলা নববর্ষের দিনে তাদের সন্তানদের অন্তত একটা নতুন জামা দেওয়ার চেষ্টা করছে।

মফস্বলের হাটবাজারগুলোতে পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে ‘বৈশাখী পোশাক’ নামের রঙিন জামাকাপড় বিকিকিনির হাল দেখে অনুমান করা যায় পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীও একে উৎসব হিসেবে গ্রহণ করার মানসিকতার প্রতি ঝুঁকছে। অবশ্য বহু আগে থেকেই ব্যবসা-বাণিজ্যে জড়িতরা নতুন বছরের প্রথম দিনে ‘হালখাতা’ উৎসবের মাধ্যমে মিষ্টিমুখ করাতো তাদের গ্রাহকদের।

পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ আগে যেখানে ছিল হালখাতাকে ঘিরে একান্তই, অদ্য তা নতুন বছরের জামাকাপড় ও বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালনের মাঝেও সঞ্চারিত হয়ে অর্থনৈতিক কর্মপ্রবাহের দিকে রূপান্তর ঘটছে। যদিও অনেকেই এর মাঝে নিজেদের জড়ালেও উৎসব হিসেবে সজ্ঞানে স্বীকৃতি দেওয়ার বোধসম্পন্ন হয়নি, তবু উৎসবের চিরায়ত রূপ এখানেও বহমান।

সময়ের সাথে সাথে মিডিয়া, বিশেষ করে অনলাইন ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বিস্তার সকল শ্রেণির মানুষের মাঝে হওয়ার কারণে আদতে এ বিপ্লব দ্রুত সম্পাদিত হচ্ছে। অর্থনৈতিক শ্রেণিভেদে সামর্থ্যের রকমফেরের কারণে মানুষ নিজেদেরকে সেভাবেই তৈরি করছে। ফলে শুরুতে যেভাবেই হোক পহেলা বৈশাখকেও মানুষ উৎসব হিসেবে গ্রহণ করতে শুরু করেছে। আস্তে আস্তে বোধজ্ঞান বাঙালিত্বের প্রতি ঝুঁকতে থাকলে তখন হয়ত সংস্কৃতি, কৃষ্টির সাথে এ আচার উল্লেখিত হতে থাকবে, সজ্ঞানে।

বাংলাদেশ সরকার পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে উৎসব ভাতা (বোনাস) দেওয়ার যে প্রচলন করেছে এটাকে বৈপ্লবিক এক সিদ্ধান্ত বলা যায়। এর ফলে উৎসব হিসেবে সরকারিভাবে অর্থনৈতিক স্বীকৃতিও মিলল। এবার পহেলা বৈশাখে দেশের সব মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজে জাতীয় সংগীত ও এসো হে বৈশাখ গান পরিবেশনের মাধ্যমে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের নির্দেশ দিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তর। যদিও এবারই এক আইনজীবী পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধের জন্যে আইনি নোটিস পাঠানোর খবর এসেছে। তবে এই আইনি নোটিসের সংবাদ আসার পর পরই সামাজিক মাধ্যমে সুচিন্তার মানুষেরা যেভাবে প্রতিবাদ করেছেন তাতে আমাদের আশাবাদের ব্যাপ্তি বেড়েছে।

আমরা বাঙালি, এটাই আমাদের পরিচয়। কিছু ব্যতিক্রম বাদে এই বোধ জাগ্রত হচ্ছে মানুষের মাঝে। এটা আশাবাদী হওয়ার মতো খবর।

 

লেখক : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক