সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হল থেকে সিয়াম মো. আরাফাত নামে এক শিক্ষার্থীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, তিনি আত্মহত্যা করেছেন। ওই শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ও মীর মশাররফ হোসেন হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন। এখন প্রশ্ন হলো, তার লাশ উদ্ধারের পর কেন ধারণা করা হচ্ছে তিনি আত্মহত্যা করেছেন? কেন এমন ধারণা করা হচ্ছে না যে, তাকে কেউ খুন করে ঝুলিয়ে গেছে? এসব প্রশ্নের মীমাংসার আগে প্রাথমিক ধারণাটুকু নিয়ে আলোচনা করা যাক। তাহলে প্রশ্ন উঠছে, এই শিক্ষার্থী কেন আত্মহত্যা করলেন?
এই শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার কারণ উদ্ঘাটন করবেন তদন্ত কর্মকর্তা। তার আগে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করতে চাই, মানুষ কেন আত্মহত্যা করে? এই প্রশ্নের উত্তর একেকজন একেকভাবে দেবেন। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষিত অপরাধবিজ্ঞানী দেবেন একধরনের জবাব, সমাজে ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে থাকা মানুষেরা দেবেন আরেক ধরনের উত্তর। আবার সাধারণ শিক্ষিত শ্রেণি দেবে ঠিক অন্যভাবে জবাব। কারও জবাবের সঙ্গেই কারও জবাবের সামঞ্জস্য শতভাগ পাওয়া যাবে না। কারণ প্রত্যেকেই স্ব-স্ব অবস্থান-অভিজ্ঞতা-অধীত জ্ঞানের আলোকেই জবাব দেবেন। তবে সমাজ প্রথম শ্রেণির বক্তব্য যতটা আমলে নেবে, শেষোক্ত দুই শ্রেণির বক্তব্যকে তার অর্ধেকও দাম দেবে না। সত্যিকার অর্থে বলতে গেলে আত্মহত্যার প্রকৃত কারণও হয়তো এই দাম দেওয়া-না দেওয়ার ভেতরই নিহিত রয়েছে।
আত্মহত্যার মতো বিধ্বংসী কাজের ওপর কোনোভাবেই মাহাত্ম্য আরোপ করা যায় না। এই বিষয়টি সমাজের দশজনের মতো আত্মহত্যাকারীরাও জানেন। জেনেও কেন নিজেকে ধ্বংস করে দেন তারা? এমন প্রশ্ন সমাজবিজ্ঞানী থেকে শুরু করে মনোবিজ্ঞানী, সবাইকেই ভাবিয়ে তোলে। উত্তর সবাই খোঁজেন, স্ব-স্ব অবস্থান থেকেই। ধর্মীয় চেতনাবোধসম্পন্নরা আত্মহত্যায় দেখেন খোদার ওপর খোদকারী হিসেবে, অপরাধবিশ্লেষকরা দেখেন অপরাধ হিসেবে, মনোবিজ্ঞানীরা দেখেন মানসিক রোগ হিসেবে। এর বাইরে অন্য কোনোভাবে দেখার সুযোগ কি আছে? হয়তো আছে, হয়তো বা না। তবে আত্মহত্যা অপরাধ হোক, পাপ হোক, মানসিক রোগ হোক, এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো তুচ্ছ কারণ থাকে না। থাকে গভীরতর কারণ। গভীরতম অসুখ। যা থেকে মানুষ নিষ্কৃতি পায় না সহজে।
মানুষ কেন আত্মহত্যা করে? এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে গত কয়েক বছরের আত্মহত্যার ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে বেশ কয়েকটি কারণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এগুলো হলো—
১। আর্থিক সংকট-পেশাগত অনিশ্চয়তা-সহকর্মী বা বসের দুর্ব্যবহার
২। পারিবারিক নিপীড়ন
৩। প্রেমে ব্যর্থতা, পরীক্ষায় অকৃতকার্যতা
৪। দাম্পত্য কলহ
৫। ধর্ষণ
৬। ত্রিভূজ প্রেম, ব্ল্যাকমেইলিং ও মানসিক চাপ
৭। নিঃসঙ্গতা
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে সঙ্গে জীবন-যাত্রার ব্যয়ও বাড়ছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পরিবারের সদস্যদের চাহিদা। কিন্তু তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মানুষের আয় বাড়ছে না। বরং কখনো কখনো কমছে। সরকারি চাকরিজীবী বাদে বাকিদের পেশাগত অনিশ্চয়তা নিত্যদিনের সঙ্গী। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাদের বেতন বাড়ে না, আয়ও বাড়ে না। বরং কখনো কখনো নিয়োগদাতা কোম্পানি-প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কর্মচারীদের বেতন কমিয়ে দেয়। কখনো কখনো খরচ কমানোর উদ্দেশ্যে কর্মচারীদের ছাঁটাইও করে। ফলে সাধারণ শ্রমজীবীরা হঠাৎ করেই পড়েন আর্থিক সংকটে। সংসারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি চাকরি হারিয়ে কিংবা বেতন কমে যাওয়ায় যতই দুশ্চিন্তার ভেতর দিয়ে দিনযাপন করুক, পরিবারের বাকি সদস্যরা সেই খবর রাখতে চায় না, মানতে চায় না। তারা চাকরিচ্যুতি কিংবা বেতন কমে যাওয়ার কথা অনেক সময় বিশ্বাসই করে না। বরং ওই সময় তাদের চাহিদা বেড়ে যায়। তখন উপার্জনকারী ব্যক্তিটির পক্ষে পরিবারের সদস্যদের চাহিদা মেটানো সম্ভব হয় না। ফলে সংসারে শুরু হয় টানাপড়েন, অশান্তি। এছাড়া আছে পেশাগত জীবনে সহকর্মী বা বসের দুর্ব্যবহার। দিনের পর দিন বস বা সহকর্মীর দুর্ব্যবহার মানুষকে হতাশায় নিমজ্জিত করে দেয়। ফলে একসময় পেশাজীবী-উপার্জনকারী লোকটি সবার নির্দয় চাহিদা ও নিষ্ঠুর আচরণের জবাব দিতে গিয়ে আত্মহত্যার পথই বেছে নেন।
আত্মহত্যার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ পারিবারিক নিপীড়ন। তুচ্ছ কারণে সন্দেহ, অবিশ্বাস জন্মে দাম্পত্য জীবনে। শুরু হয় ঝগড়া। একসময় উপার্জনকারী ব্যক্তিটিকে পরিবারের বাকি সদস্যরা মানসিকভাবে পীড়ন করেই চলে। তার সুস্থতা-অসুস্থতা নিয়ে পরিবারের বাকি সদস্যদের মধ্যে কোনো ভাবান্তরই থাকে না। তারা নিজেদের চাহিদা অনুযায়ী টাকা না পেলে দিনের পর দিন উপার্জনকারী ব্যক্তিটিকে নিপীড়ন করেই যায়। তার শারীরিক-মানসিক-আর্থিক সামর্থ্যের কথা বাকি সদস্যরা আমলেই নিতে চায় না। এই সময় লোকটি হয়তো বারবার আত্মহত্যার হুমকিও দেয়। তবু বাকিদের মনে কোনো দয়ামায়ার উদ্রেক হয় না। বরং তারা প্রমাণ দেখতে চায়, লোকটি তাদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে সত্যি সত্যি আত্মহত্যা করল কি না। যেন লোকটি আত্মহত্যা করলেই তাদের সব দাবি পূরণ হয়ে যাবে। আর উপার্জনকারী লোকটিও যখন বুঝতে পারেন, তার প্রতি পরিবারের সদস্যদের কারও কোনো মমত্ব-দয়ামায়া কিছুই নেই। তখন বাধ্য হয়েই আত্মহননের পথ বেছে নেন।
প্রেমে ব্যর্থ কিংবা পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েও অনেকেই আত্মহত্যা করেন। প্রেমে ব্যর্থ হলে কেউ কেউ মনে করেন, তার জীবনটাই বিফলে গেল। আর পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলে পরিবারের সদস্য ও সমাজের তিরস্কারের ভয়ে কেউ কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।
এরপর আছে দাম্পত্য কলহ। এই কলহের অনেক কারণ আছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো স্বামী-স্ত্রীর দুইজনই অথবা কোনো একজন বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়ানো। অথবা না জড়ালেও পরস্পরকে পরস্পরকে সন্দেহ করা, তুচ্ছ কারণে ঝগড়া করা। একসময় সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেন কেউ কেউ।
ধর্ষণের শিকার হয়ে লজ্জায় কেউ কেউ আত্মহত্যা করেন। আবার ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর বিচার না পেয়েও আত্মহত্যাকে কেউ কেউ আলিঙ্গন করতে বাধ্য হন।
এর বাইরে আরেকটি বড় কারণ হলো, নিঃসঙ্গতা। নিঃসঙ্গতা বড় ধরনের ব্যাধি। এই রোগে যিনি আক্রান্ত হন, সহজে তার নিস্তার মেলে না। তিনি ‘সকল লোজের মাঝে বসে’ও কেবল ‘নিজের মুদ্রাদোষে’ নিঃসঙ্গ থাকেন। একসময় জীবন ও জগৎকে তার নিরর্থক মনে হয়। তখনই তিনি হতাশা-ক্ষোভে আত্মহত্যার পথে যান।
সবচেয়ে ভয়ানক কারণটি হলো ‘ত্রিভুজ প্রেম’, ‘ব্ল্যাকমেইলিং’ ও ‘মানসিক চাপ’। এই কারণগুলো ঘটে সাধারণত লোকচক্ষুর অন্তরালে। বর্তমান সমাজে অধিকাংশ দম্পতিই অসুখী। ভেতরে ভেতরে অসুখী হলেও বাইরে তারা সুখী সুখী ভাব দেখায়। আর গোপনে সুখের বাসনায় জড়িয়ে পড়েন একাধিক সম্পর্কে। ঘরে স্বামী বা স্ত্রী থাকার পরও কেবল দাম্পত্য কলহের কারণে তারা জড়িয়ে পড়েন দ্বিতীয় সম্পর্কে। কেউ কেউ তৃতীয় সম্পর্কেও জড়িয়ে পড়েন। এই সম্পর্কগুলোয় জড়ানোর সময় তারা ভূত-ভবিষ্যৎ বিবেচনায় রাখেন না। ফলে কিছুদিন যেতে না যেতেই টের পেতে থাকে এক পক্ষ স্বার্থপরের মতো আচরণ করছেন। ইচ্ছার বিরুদ্ধেও যৌন সম্পর্কে বাধ্য করছেন। সেই সম্পর্কের ভিডিও কিংবা স্থির চিত্র তুলে রাখছেন। এরপর সেই ভিডিও-স্থিরচিত্র সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে কোনো কোনো পুরুষ দিনের পর দিন ধর্ষণ করে চলেন। আবার কেউ কেউ অর্থ হাতিয়ে নেয়।
কেবলই কি পুরুষ এই ব্ল্যাকমেইলিং করে কিংবা মানসিক চাপ দেয়? না। নারীরাও করে। তারাও পুরুষকে মানসিক চাপের ওপর রাখেন। সংকটাপন্ন পুরুষটিকে তারা এমনভাবে মানসিক চাপের ওপর রাখেন যে, ওই পুরুষটি চাইলেও বেঁচে থাকার শক্তি হারিয়ে ফেলে। বিশেষত ত্রিভূজ প্রেমের ক্ষেত্রে নারী কিংবা পুরুষ কোনো একজন মুক্তি পেতে চাইলে অন্যজন তাকে মুক্তি দিতে চান না। উল্টো তাকে ব্ল্যাকমেইলিং করে মানসিক চাপে রাখেন। এমনকি তাদের সম্পর্কে কথা অন্যজনের স্বামী বা স্ত্রীকে বলে দেওয়ার হুমকিও দেন। এতে তাদের সম্পর্ক তো স্বাভাবিক হয় না, উল্টো হুমকি ব্যক্তির মন বিষিয়ে ওঠে। একসময় বেঁচে থাকাকেই তার অনর্থক মনে হয়। তখনই আত্মহত্যার মতো জঘন্য কর্মটি সম্পন্ন করতে বাধ্য হন।
শুরুতে জাবি শিক্ষার্থী সিয়াম মো. আরাফাতের লাশ উদ্ধারের প্রসঙ্গ এনেছিলাম। সেই প্রসঙ্গ দিয়েই শেষ করতে চাই। যদি তিনি আত্মহত্যাই করে থাকেন, তাহলে উল্লিখিত যেকোনো একটি কারণ তার জন্য দায়ী হবে।
এখন প্রশ্ন হলো, মানুষকে এই ধরনের আত্মহত্যা থেকে মুক্তি দেওয়ার কোনো পথ আছে কি না। উত্তরে বলবো, অবশ্যই আছে। রাষ্ট্রকে তার নাগরিকের পেশাগত অনিশ্চয়তা দূর করার দায়িত্ব নিতে হবে। কোনো চাকরিদাতা চাইলেই যেন তার কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করতে না পারে, সে ব্যাপারে রাষ্ট্রকে দায়িত্ব নিতে হবে। কোম্পানি কিংবা চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠান যেন কোনো কর্মীর বেতন কমাতে না পারে, সে বিষয়ে প্রয়োজন আইন করে, সেই আইন পালনে বাধ্য করতে হবে সংশ্লিষ্টদের। কোথাও কোনো চাকরিজীবী পেশাগতভাবে আক্রান্ত হলে তিনি যেন সহজে আইনি আশ্রয় পান, তার নিশ্চয়তা রাষ্ট্রকে দিতে হবে। প্রয়োজনে প্রচলিত আইন সংশোধন করতে হবে। এই সমস্যার সমাধান হলেই আত্মহত্যার পরিমাণ অর্ধেকই কমে যাবে। বাকি থাকলো ‘পারিবারিক নিপীড়ন’, ‘প্রেমে ব্যর্থতা, পরীক্ষায় অকৃতকার্যতা’, ‘দাম্পত্য কলহ, ‘ধর্ষণ’, ‘ত্রিভূজ প্রেম, ব্ল্যাকমেইলিং ও মানসিক চাপ’ ও ‘নিঃসঙ্গতা’। এসব সংকট সমাধানে সামাজিক আন্দোলনের পাশাপাশি কাউন্সেলিংয়ের দিকে সমাজকে জোর দিতে হবে। সামাজিক আন্দোলন ও কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমেই এসব সমস্যা জয় করে কীভাবে ব্যক্তি তার জীবনকে উপভোগ করতে পারে, তার ধারণা দিতে হবে। তবেই আত্মহত্যার মতো ঘটনা কমে আসবে। উল্লিখিত কাজগুলো যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে পারলে হয়তো একদিন মানুষ আত্মহত্যার চিন্তাই মনে ঠাঁই দেবে না।
লেখক : কবি-প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক