ফুটবলারদের স্বপ্নভঙ্গ

অঘোর মন্ডল প্রকাশিত: এপ্রিল ৩, ২০২৩, ০৬:১৪ পিএম

বাঙালির ফুটবল প্রেম বড় অদ্ভুত! আবেগ সর্বগ্রাসী। স্বপ্ন আকাশ ছোঁয়া! বাঙালিকে স্বপ্নের কথা বলে ঘুম পাড়িয়ে রাখাও খুব সহজ। দেশের ফুটবল কর্তারাও একটার পর একটা স্বপ্ন পরিবেশন করে আবেগী মানুষগুলোকে ঘুম পাড়িয়ে রাখার দক্ষতাটা ভালোভাবে রপ্ত করেছেন!

তবে দুর্ভাগা ফুটবল কর্তারা জানেন না তাদের পরিবেশন করা স্বপ্নগুলো বাস্তবের মাঠে প্রবেশের সুযোগ পায় না। এমন কি বাস্তবতার সাইড লাইন ধরেও দৌঁড়াতে অক্ষম! কিন্তু তারা যখন স্বপ্নের কথা বলেন, তখন মনে হবে এই সব স্বপ্ন পক্ষীরাজের ঘোড়ায় করে ওড়ে। একটু স্মৃতির সরণি দিয়ে হেঁটে আসুন। বাঁকে বাঁকে দেখবেন বাংলাদেশ ফুটবলের মৃত স্বপ্নের কফিনগুলো পড়ে আছে! ওগুলো দাফন করার লোক নেই। টাকাও নেই! অনুভূতিতে ধাক্কা লাগল? নাকি অনুভূতিহীন হয়ে পড়ছেন!

যাই হোক কী আর করা! একটু মনে করে দেখুন তো, কোন সালে বাংলাদেশ বিশ্বকাপ খেলবে বলে স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল? কাতারে বিশ্বকাপের উন্মাদনার মাঝে বাঙালি সেটা হয়তো ভুলেই গেছে! ফিফার বর্ষপঞ্জী অনুযায়ী ২০২২-এর বিশ্বকাপ শেষ হয়ে গেছে। আর বাঙালির স্বপ্নের ঘুম ভাঙার পর দেখলো আর্জেন্টিনা নামক একটা দেশ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন মেসি থেকে তার দেশের প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত। এরপর বাংলাদেশের ফুটবল উন্নয়নের স্বপ্নীল প্রজেক্ট হিসেবে মেসির আর্জেন্টিনাকে ঢাকায় আনার কথা ভাসিয়ে দেয়া হলো! ভাবখানা এমন মেসিরা একটা ম্যাচ খেলে গেলে বাংলার উর্বর ফুটবল জমিনে হাজার হাজার ‍‍`মেসি‍‍` বেরিয়ে আসবে! হোক তাতে একশ কোটি টাকা খরচ!

সেই স্বপ্নের প্রজেক্ট ধাক্কা খেয়েছে। টাকাতো জোগাড় করে গৌরি সেন। মানে সরকার। অর্থাৎ এদেশের জনগণ। কিন্তু মানুষ কেন যেন এবার আর সেই স্বপ্নজালে বন্দী হতে চাননি। গণমাধ্যম থেকে সামাজিক মাধ্যম সব জায়গায় ঐ প্রোজেক্টের সমালোচনা হয়েছে। আর্জেন্টিনার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকায় এসে মতিঝিল পাড়ার বাফুফে ভবনে গিয়েছিলেন। কিন্তু তার শারীরিক বা মুখের  ভাষায় তেমন কোন প্রতিশ্রুতির ইঙ্গিত ছিল না। বরং তার উপস্থিতি আর বক্তব্যে যা বোঝা গিয়েছিল, তাকে ফুটবলীয় ভাষায় বলা যায়, বাফুফের কিক বার উঁচিয়ে চলে গেছে! ঢাকায় আর্জেন্টিনার দূতাবাস চালু করা হোক, বা সেদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাফুফে ভবন যান, তাতে বাংলাদেশ ফুটবলের রং বদল হবে না!

বদল হবে কিভাবে? দেশের ফুটবলের হতশ্রী চেহারায় যারা খানিকটা রঙের ছাপ দিয়েছিলেন সেই নারী ফুটবলদের সম্মান, মর্যদা দিতে যারা কার্পণ্য করেন তারা যে ‍‍`চন্দ্রমুখী‍‍`! নিজেদের দিকে প্রচারের আলো টানাতে নারী ফুটবলারদের জায়গা না দিয়ে সাফল্যের বিজয় মঞ্চে তারা আগেভাগে দাঁড়িয়ে যান বা বসে পড়েন! মাস সাতেক আগে নেপালের কাঠমান্ডু থেকে সাউথ এশিয়ান নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ জেতার পর, তাদের একটা স্বপ পূরণ করা হয়েছিল। তাও ঐ দলের এক ফুটবলারের হৃদয় স্পর্শ করে যাওয়া একটা ফেসবুক স্ট্যাটাসের সৌজন্যে। যার মর্মার্থ ছিলো, ট্রফি নিয়ে ছাদখোলা বাসে করে এই নগরীতে ঘোরার সুযোগ না পেলেও তাদের দুঃখ থাকবে না। কারণ ট্রফি জয়টাই বড়! তোলপাড় করা সেই স্ট্যাটাসের সৌজন্যে দেশের ইতিহাসে প্রথম কোন দল ছাদখোলা বাসে ট্রফি নিয়ে ঢাকা শহর প্রদক্ষিণ করার সুযোগ পেয়েছিল। ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী ধন্যবাদ পেতেই পারেন। দেশজ ফুটবলে সাফল্য দুর্ভিক্ষের মধ্যে যারা সাউথ এশিয়ায় নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে ট্রফি এনেছিলেন তাদের একটা ইচ্ছে পূরণের উদ্যোগ তিনি নিয়েছিলেন।

কিন্তু সেই নারী ফুটবলারদের স্বপ্ন যখন আরও বড় দিগন্তে ডানা মেলার সুযোগ পেল, তখন সেই ডানা ছেটে ফেলা হলো, বড্ড নির্মম এবং নিষ্ঠুরভাবে। দক্ষিণ এশিয়ার গণ্ডি পেরিয়ে অলিম্পিকের প্রাক বাছাই পর্বে খেলার সুযোগ যখন এলো তখন দলটাকে আর মিয়ানমারের পাঠানো হলো না! যুক্তি হিসেবে দাঁড় করান হলো অর্থাভাব! ৫০-৬০ লাখ টাকা খরচ করার সামর্থ্য বাফুফের নেই! তাহলে এতো নামীদামী সাবেক ফুটবলার, বড়বড় ব্যবসায়ীকে ফুটবল ফেডারেশনে বসিয়ে লাভ কি হলো দেশের ফুটবলের? হয় তাদের স্পন্সরদের কাছ থেকে টাকা আনার যোগ্যতা নেই, অথবা স্পন্সরদের কাছে তাদের সততা প্রশ্নবিদ্ধ! কারণ যেটাই হোক, শেষ মূহুর্তে কেন বলতে হবে টাকার অভাবে নারী ফুটবল দলকে অলিম্পিকের প্রাক বাছাই পর্বে খেলার জন্য পাঠানো যাচ্ছে না!

করোনা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যেয যে দেশ তার অর্থনৈতিক অগ্রগতির চাকা সচল রাখতে পারল, অথচ দেশের নারীরা টাকার অভাবে পাশের দেশ মিয়ানমারে যেতে পারলেন না! নারী ফুটবলারদের স্বপ্নভঙ্গ হলো বাস্তবের রুক্ষ্ম জমিনে! এ যেন স্বপ্নের বিমানের মুখ থুবড়ে পড়া। বিধ্বস্ত বিমানের ব্ল্যাক বক্স থেকে কী তথ্য মিলছে? ইগো, ক্রীড়া কর্তাদের রেষারেষি এবং  নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করতে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়ে বড় অংকের একটা অর্থ চাওয়া!

টুর্নামেন্টের গায়ে ‍‍`অলিম্পিক‍‍` শব্দটা লাগানো আছে, বাফুফে বলবে, এই অর্থ বহন করার কথা বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের। কথাটা একেবারে যুক্তিহীন নয়। কিন্তু প্রশ্ন থাকে। অলিম্পিক অ্যাসোসিয়শনে তো বাফুফের প্রতিনিধিও আছেন। তার মাধ্যমে অথবা চিঠি দিয়ে কবে, ক‍‍`বার জানিয়েছেন এই টুর্নামেন্টে দল পাঠানোর খরচ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনকে বহন করতে হবে? কারণ টুর্নামেন্টটা তাদের। এবং বাফুফের খরচ করার মতো টাকা নেই! সদিচ্ছা থাকলে অর্থাভাবের কথা বাফুফে এবং অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন যৌথভাবে, ক্রীড়ামন্ত্রী, এমন কি প্রধানমন্ত্রীকে জানাতে পারতেন। হয়তো প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়ে বলা হবে, অর্থাভাবে আমরা ফুটবল চালাতে পারছি না। টাকা দরকার।

ফুটবলে যে ব্যর্থতা, সেটি কি আদৌ অর্থের অভাবে, নাকি দক্ষতার অভাবে? সম্ভবত অভাব দ্বিতীয়টির। তা নাহলে এক সময় ফিফা রাকিংয়ে যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১১৪-তে, নামতে নামতে তারা এখন ২০৬ দেশের মধ্যে ১৯২তম!
 

লেখক: সাংবাদিক