উদ্দেশ্যমূলক হোক, জেনে হোক, না জেনে হোক, বুঝে হোক, না বুঝে হোক—প্রথম আলো যেটা করেছে, সেটা ভুল। সাংবাদিকতায় ভুল হতেই পারে। প্রথম আলো মাত্র ১৭ মিনিটের মধ্যেই তাদের ভুলটি বুঝতে পেরেছে। নিউজটি প্রত্যাহার করেছে, ভুল স্বীকার করেছে। ভুল স্বীকার করার পরও এটা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হতে পারে, হচ্ছিলও। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই স্বাধীনতা দিবসে একজন দিনমজুরের মুখে এমন সংলাপে হতাশ হয়েছেন, ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তারা মনে করছেন, স্বাধীনতা দিবসে এমন একটি রিপোর্ট করে মহান স্বাধীনতা দিবসকেই হেয় করা হয়েছে। আরেকটি মহল মনে করছেন, স্বাধীন সাংবাদিকতায় সাংবাদিকরা সত্য তুলে ধরবেন, সেই সত্য যত তেতোই হোক। কোন দিবসে কে, কী বলল, সেটা দেখার দায়িত্ব সাংবাদিকের নয়।
এখানে একটু কথা আছে, গণমাধ্যম আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পার্থক্য আছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যা ইচ্ছা তা লেখা যায়। কিন্তু গণমাধ্যমে যায় না। গণমাধ্যমে এডিটরিয়াল পলিসি আছে, এডিটরিয়াল জাজমেন্ট আছে, দায়িত্বশীলতার প্রশ্ন আছে। বাজারে গেলে ঘাম দিনমজুর জাকির হোসেনের একার ছোটে না, বাংলাদেশে কোটি কোটি মানুষ আছে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে যারা দিশাহারা।
আমি নিয়মিত বাজারে যাই। বাজারে যদি প্রথম আলো বা অন্য কোনো রিপোর্টার আমাকে প্রশ্ন করেন, আমি হয়তো হুবহু দিনমজুর জাকির হোসেনের ভাষায় বা তার চেয়েও কড়া ভাষায় কথা বলব। বছরের ৩৬৫ দিনই আপনি ‘বাজারে গেলে ঘাম ছুটে যাওয়া’ জাকির হোসেনদের দেখা পাবেন। চাইলে প্রতিদিনই বাজারদর নিয়ে এই তেতো সত্য তুলে ধরা সম্ভব। প্রথম আলোসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম নিয়মিত সেই তেতো সত্য প্রকাশও করে। কিন্তু স্বাধীনতা দিবসেই একজন দিনমজুরের মুখে, ‘পেটে ভাত না জুটলে স্বাধীনতা দিয়া কী করুম’ সংলাপটি বড্ড বেমানান লাগে। তার চেয়ে বড় কথা, দিনমজুর কোনো সভা, সমিতি বা মানববন্ধনে বলেননি বা তিনি প্রথম আলোর সাংবাদিকের কাছে এসে কথা বলেননি, যে তার কথাটি প্রকাশ না করলে সত্য গোপন করা হবে। বরং প্রথম আলোর সাংবাদিকই তার সঙ্গে গিয়ে কথা বলেছেন, তাকে প্রশ্ন করেছেন।
এখন আপনি স্বাধীনতা দিবসে একজন দিনমজুরকে বাজারদর নিয়ে প্রশ্ন করবেন কি না, প্রশ্নের জবাবে স্বাধীনতা নিয়ে তার হতাশা ছাপবেন কি না, সেটা আপনার এডিটরিয়াল পলিসি। অনেকে বলছেন, স্বাধীনতা এত ঠুনকো নয় যে তা নিয়ে প্রশ্ন করা যাবে না। অবশ্যই প্রশ্ন করা যাবে। আপনি করুন। তবে যে প্রশ্ন বছরের বাকি ৩৬৪ দিনেও করার সুযোগ আছে, একই রকম উত্তর পাওয়ার অবকাশ আছে, সে প্রশ্ন আমি স্বাধীনতা দিবসে করব না। সে উত্তর ছাপব না। এটা আমার টেস্ট।
অনেকে বলছেন, এই প্রশ্ন না করতে চাওয়া আসলে সেলফ সেন্সরশিপ। কিন্তু আমি মনে করি এটা সেন্সরশিপ নয়, এডিটরিয়াল জাজমেন্ট। বাজারদর নিয়ে কোনো কথাই বলব না, এটা হলো সরকারের ভয়ে সেলফ সেন্সরশিপ। আর স্বাধীনতা দিবসে স্বাধীনতা নিয়ে কারও হতাশা প্রকাশ করব না, এটা আমার এডিটরিয়াল জাজমেন্ট। তবে আমার টেস্ট আর এডিটরিয়াল জাজমেন্টের সঙ্গে আপনার টেস্ট না-ও মিলতে পারে। তাতেও কোনো আপত্তি নেই।
ভিন্নমত থাকতেই পারে। সেটা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা, তর্ক-বিতর্ক চলতেই পারে, চলছিলও। কিন্তু সেই আলোচনায় বেআইনিভাবে বাগড়া দিয়েছে সরকার। একজন সাংবাদিককে কোনোরকম ওয়ারেন্ট ছাড়া ভোররাতে বাসা থেকে তুলে নেওয়াটা বেআইনি। তুলে নেওয়ার ৩০ ঘণ্টা পর তাকে আদালতে তোলাটা বেআইনি। মাঝের ৩০ ঘণ্টা তাকে কোথায় রাখা হয়েছে, তা কাউকে না জানানোটা বেআইনি। সাংবাদিক ভুল করতে পারেন, কিন্তু সাংবাদিকতা কোনো অপরাধ নয়। অনেকেই বলছেন, সাংবাদিকরা কি আইনের ঊর্ধ্বে? সাংবাদিকরা আইনের মোটেই ঊর্ধ্বে নন। একজন সাংবাদিক খুন করলে আইন তার নিজস্ব গতিতেই চলবে। কিন্তু পেশাগত কারণে ভোররাতে একজন সাংবাদিককে তুলে নিয়ে ৩০ ঘণ্টা গায়েব করা রাখা আইনের গুরুতর ব্যত্যয়।
বাংলাদেশের সংবিধানে শর্তসাপেক্ষে সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া আছে, ‘৩৯ (২) রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে (ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের, এবং (খ) সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।
প্রথম আলো প্রকাশিত প্রতিবেদনের কারণে সংবিধানের কোনো শর্ত লঙ্ঘিত হয়নি। এমনকি বাংলাদেশে সবচেয়ে স্পর্শকাতর, কারও ধর্মীয় অনুভূতিতেও আঘাত লাগেনি। এই রিপোর্টের কারণে যুবলীগ নেতা গোলাম কিবরিয়া বা আইনজীবী মশিউর মালেক কেন সংক্ষুব্ধ হলেন, বোঝা মুশকিল। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন তো নিশ্চয়ই সংবিধানের চেয়ে বড় নয়। প্রথম আলোর রিপোর্টটি আপনার ভালো না-ই লাগতে পারে, তাই বলে আপনি মামলা করে দেবেন? সব মানুষের ব্যক্তিগত ভালো লাগা, মন্দ লাগা, ক্ষোভ-বিক্ষোভ আমলে নিলে তো প্রতিদিন দেশে হাজার হাজার মামলা হবে। সাংবাদিকতার কারণে কেউ ক্ষুব্ধ হলে তাকে প্রথমে প্রেস কাউন্সিলে যেতে হবে। আর আইনমন্ত্রী আগে বলেছিলেন, কোনো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হলে আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সেলে তা যাচাই হবে। এ ক্ষেত্রে তা হয়নি। ভোররাতে সাংবাদিক শামসুজ্জামানকে তুলে আনা এবং প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে মধ্যরাতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করে সরকার প্রমাণ করল, দেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নেই এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ব্যবহৃত হচ্ছে সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধে। আরেকটা বিষয়ও প্রমাণিত হলো, দেশে বিচার বিভাগেরও স্বাধীনতা নেই। থাকলে এমন খেলো মামলা আমলেই নেওয়া হতো না। নিলেও আদালতে হাজির করার সঙ্গে সঙ্গে শামসুজ্জামানের জামিন হয়ে যেত।
সংবিধানের আলোকে আমরা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা চাই, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা চাই, সাংবাদিকদের নিরাপত্তা চাই, মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা মামলার প্রত্যাহার চাই এবং অবিলম্বে শামসুজ্জামানের মুক্তি চাই।
লেখক : সাংবাদিক