রোববার আসছে। ছোটবেলায় লাল শুক্রবারের অপেক্ষায় থাকতাম । যে শুক্রবার পেরিয়ে কখনো আর রোববার আসবে না। স্কুল অনন্ত দিনের ছুটি। অনন্ত ছুটি না এলেও গ্রীস্মের বা রমজানে দীর্ঘদিনের বন্ধ পেতাম। সপ্তাহখানেক হুড়োহুড়িতে কাটলেও, এরপর শুরু হয়ে যেত স্কুলে যাওয়ার জন্য হাপিত্যেস। স্কুলের মাঠ, করিডর, বেঞ্চি, কৃষ্ণচূড়া, টিফিন, ছুটির ঘণ্টা এবং বন্ধুদের জন্য মন ছুটে চলত। আঙুলের কড়ে গুনে দেখতাম আর কদিন বাকি ছুটির। কখনো কখনো এমন হতো, দিবারাত্রি স্বপ্ন দেখতাম পরীক্ষা হচ্ছে না । বন্যা, ঘূর্ণিঝড় বা হরতালে। আমাদের পরীক্ষা ছাড়াই পরের ক্লাসে উঠিয়ে দেওয়া হলো। এসব দিবারাত্রি স্বপ্ন আমাদের কালে পূরণ হয়নি, হলো সন্তানদের জীবনে। সন্তানদের জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে দেখলাম অনন্ত ছুটি, পরীক্ষাহীন ফল, পরের ক্লাসে উঠে যাওয়া কতটা দুর্বিষহ ও আনন্দহীন উদযাপন। কোভিড সেই অভিজ্ঞতায় আমাদের বিবর্ণ করে দিয়ে গেল।
কোভিডের জোয়ার-ভাটায় জীবনযাপনে স্থবিরতা এসেছে যেমন, তেমনি ফিরে এসেছে চঞ্চলতাও। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাঠে, করিডরে ফেরেনি উচ্ছলতা। প্রায় দেড় বছরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেমন জরাজীর্ণ হয়েছে, তেমনি জীর্ণ ও দেউলিয়া হয়ে গেছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। বলতে পারি অনলাইন বা ডিজিটাল মাধ্যমে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছিল। শিশু শ্রেণি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সবাই অনলাইনে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সবাই পেরেছে এই দাবি করা যাবে না। কারণ, দেশের সব শিক্ষার্থীর ছিল না আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সুবিধা। যাদের সুবিধা ছিল, তারাও গতির সীমাবদ্ধতার জন্য সহজভাবে এই শিক্ষাপদ্ধতি থেকে কিছু আহরণ করতে পারেননি। মূলত আনুষ্ঠানিকতাই ছিল অনলাইন শিক্ষা মাধ্যমের উদ্দেশ্য। বরং এই পদ্ধতিতে অভ্যস্ত হতে গিয়ে শিশু-কিশোরদের মোবাইল আসক্তি বেড়েছে। এর পাশাপাশি শুরু হয়েছিল অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেওয়ার নিয়ম। কিন্তু এটাও সেই নবম-দশম শ্রেণির বিজ্ঞানের ব্যবহারিক খাতার মতো, দোকানে তৈরি অবস্থায় বিক্রি হতে শুরু করল। সুতরাং কোভিডকালে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় শূন্যতা তৈরি হয়েছে। রোববার যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে, সেখানে স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম কবে শুরু হবে, তা অনিশ্চিত। আপাতত ছন্দে ফেরার চেষ্টা করা হচ্ছে মাত্র।
শুধু প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক নয় , উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও জট তৈরি হয়েছে। উচ্চমাধ্যমিকের দুয়ার পেরিয়ে বসে আছে শিক্ষার্থীরা প্রায় এক বছর, এখনো স্নাতক প্রথম বর্ষের পাঠ শুরু হয়নি। পরের ব্যাচও এসে ভিড় করবে শিগগির। এই জটের খোলাসা করা চোখের পলকে সম্ভব হবে না ।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার জন্য যে শর্ত বা নিয়ম নীতির কথা নির্দেশনার কথা বলা হচ্ছে , তা সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুসরণ করার সক্ষমতা আছে এমন বলা যাবে না। সব প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো ও সচ্ছলতা এক নয় যেমন, তেমনি অভিভাবকদের কাছ থেকেও একপর্যায়ের সচেতনতা প্রত্যাশা করা যাবে না। শিক্ষকদের বেলাতেও একই কথা। টিকার আওতায় সবাই দ্রুত চলে আসবে বাস্তবতা তা বলছে না। এমন একটা টানাপোড়েন অবস্থাতেই রোববার স্কুল খুলছে। অভিভাবকদের যারা অস্থির হয়ে গিয়েছিলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার জন্য, তারা এখন পিছিয়ে যাচ্ছেন। বলছেন পরীক্ষা ছাড়া বাকি দিনগুলো স্কুলে পাঠাবেন না। না পাঠালে এই কোভিডকালে জোর করারও কিছু নেই। কোভিডের তৃতীয় ঢেউ নানা দেশে শুরু হয়েছে। তৃতীয় ঢেউয়ের পূর্বাভাসে শঙ্কা রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রাণ টেকসই থাকা নিয়ে।
কিন্তু টানা প্রায় দেড় বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কোনো দেশই বন্ধ রাখেনি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার দীর্ঘ মেয়াদের যে ক্ষতি, তা পুষিয়ে নেওয়া প্রায় অসম্ভব। তাই বাংলাদেশকে সমাজের সব শ্রেণির শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো সুবিধার কথা বিবেচনায় রেখে জুতসই পদ্ধতি বের করতে হবে। এবং সেটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রেখেই। সরকারের যত্ন নিতে হবে কিন্ডারগার্টেন, প্রতিবন্ধী স্কুল, কারিগরি স্কুলের দিকে। যেন কোভিডে বন্ধ হয়ে যাওয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পুনরায় চালু হতে পারে। রোববার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের পদচারণে মুখর হয়ে উঠবে দীর্ঘ বিরতির পর। শিক্ষার্থীদের আনন্দ হোক অফুরান।
লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক