কদিন ধরে ‘স্যার’ ইস্যুতে সরগরম বাংলাদেশের ফেসবুক জগৎ। ঘটনার পক্ষ-প্রতিপক্ষ; একজন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও একজন জেলা প্রশাসক তথা আমলা। কোনো এক সভা শেষে শিক্ষক মহোদয় প্রশাসক মহোদয়কে স্যার না বলে আপা বলায় পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। স্যার ইস্যুতে বলনেওয়ালা ও শুনলেওয়ালা উভয়েই যারপরনাই অপমানিত বোধ করেন। এর প্রতিবাদের পদক্ষেপ হিসেবে শিক্ষক মহোদয় তার নাবালিকা কন্যাকে নিয়ে একটি পোস্টার-সমেত অবস্থান ধর্মঘটের মতো একটি কর্মসূচি গ্রহণ করেন। অতঃপর বিষয়টি ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়ে নেট-দুনিয়ায়। বুদ্ধিমতী জেলা প্রশাসক পরিস্থিতির ভয়াবতা আঁচ করতে পেরে তাৎক্ষণিক উদ্যোগে ইতিবাচকভাবে পরিস্থিতি সামাল দেন। অনুশোচনা প্রকাশের মাধ্যমে ঘটনা মিটমাট করেন। তদুপরি থেমে যায়নি ফেসবুকের ইঞ্জিন। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক পর্যায়ের শিক্ষক কেন একজন জেলা প্রশাসককে স্যার সম্বোধন করবেন, আর একজন জেলা প্রশাসকই-বা কোন যুক্তিতে স্যার ডাক শোনার জন্য এতটা কাতর হয়ে পড়বেন, তা এক হ্যাভিওয়েট প্রশ্ন হয়ে গণমনে ওড়াউড়ি করছে। একই সঙ্গে আমলাদের কামলা বলে যাচ্ছেতাইভাবে কটাক্ষ করা হচ্ছে। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক অত্যন্ত গাম্ভীর্য নিয়ে টিভি সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে বলেছেন; সরকারি আমলারা তো জনগণের টাকায় বেতন পায়। উনি এমনভাবে এ কথাগুলো বলছিলেন যেন তা কোনো দিন কেউ শোনেনি। প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে; তিনি কার টাকায় বেতন নেন? এক স্যার ইস্যুতে তিনি পুরো আমলাতন্ত্রকে টান দিয়েছেন। অথচ এই আমলারা কিন্তু তাদেরই কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বিদ্যা অর্জন করেছেন। তাহলে প্রশ্ন থেকেই যায়, কী শিখিয়েছেন তাদের ছাত্রদের? তাদের মানসিক উৎকর্ষের জন্য কী করেছেন তারা? এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। একটি সমাজের সর্বত্র ক্ষত দেখা দিলে বিচ্ছিন্নভাবে কোনো কিছু দেখার বা করার থাকে না।
বিষয়টি নাড়াচাড়া করলে দেখা যায়; রাষ্ট্রাচারিক পর্যায়ে সম্বোধনের ক্ষেত্রে কিছু বিষয়ের অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য। রাষ্ট্রকাঠামো বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে যে প্রশাসনিক কাঠামো বিকশিত হয়েছে, সম্বোধনের বিষয়টি সে কাঠামোর একটি তাৎপর্যপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে চর্চিত হয়ে আসছে। প্রাক্-ব্রিটিশ পর্যায়ে এ ক্ষেত্রে রাজন্যদের প্রতি জাঁহাপনা সম্বোধনটি ছিল বহুল চর্চিত। এর সঙ্গে ক্ষেত্রবিশেষে যোগ করা হতো নানা ধরনের স্তুতিমূলক বিশেষণ। ক্ষমতাকাঠামোর একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে দেওয়ানির বেটা বা মাতবর সাব বহুল ব্যবহৃত একটি সম্মানসূচক সম্বোধনিক শব্দ, যা আজও আমাদের গ্রামীণ জনপদে বিস্তৃত পর্যায়ে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
মূলত ব্রিটিশ শাসনের সূচনা থেকে এ অঞ্চলে বহুল আলোচিত ‘স্যার’ সম্বোধন প্রবর্তিত হয়। এটি ব্রিটিশদের শাসন কর্তৃত্বের প্রকাশ নয়। সংস্কৃতজাত প্রত্যয়। একটি বর্বরোচিত অধ্যায়ের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশরা যে মানবমুখী সমাজ গঠনে সক্ষম হয়েছে, যে সমাজে ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি ও লিঙ্গনির্বিশেষে মানুষকে সম্মানের আসনে বসিয়েছে, সে সমাজে পারস্পরিক সম্মান জ্ঞাপনার্থে সম্বোধনের ক্ষেত্রে স্যার ও ম্যাডামের চল চালু হয়েছে। একই সঙ্গে তাদের সমাজ থেকে অধীনতা বা দাসত্বমূলক সম্বোধনিক প্রথাগুলো বিলুপ্ত করা হয়েছে। যে কারণে দেখা যায় ব্রিটেনসহ ইউরোপীয় সমাজে রাজা-রানি ব্যতিরেকে প্রত্যেকে প্রত্যেককে নাম ধরে ডেকে থাকে। ক্ষেত্রেবিশেষে যুক্ত করা হয় মিস্টার, মিস বা মিসেস। এই সংস্কৃতি শিক্ষা, প্রশাসন, পরিবার ও অন্যান্য সব ক্ষেত্রে স্বীকৃত ও দ্বিধাহীনভাবে চর্চিত হয়ে থাকে। সে দেশে কিয়ৎকাল অবস্থানকালে সর্বত্র এমনটাই পরিদৃষ্ট হয়েছে। আমাদের প্রফেসর জনকে আমরা সব সময় মিস্টার জন বলেই সম্বোধন করেছি। এমনকি দেশটির পদস্থজনদেরও নাম ধরেই সম্বোধন করেছি। এটিই দেশটির ভব্যতার সংস্কৃতি। পরবর্তী সময় পাশ্চাত্যের ফ্রান্স, বেলজিয়াম, প্রাচ্যের সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া ও মালয়েশিয়ার মতো দেশেও একই সংস্কৃতি পরিদৃষ্ট হয়েছে। তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো, সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে এসব দেশের সরকারি-বেসরকারি সব পর্যায়ে সেবাগ্রহীতাকে অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে সম্বোধন করা হয়ে থাকে। এটি তাদের উন্নত মানের পার্ট অব কালচার। এক দুপুরে ব্রাডফোর্ড ইউনিভার্সিটির অঙ্গনে বরফাচ্ছন্ন পরিবেশে ধূমপানকালে অকস্মাৎ এক পুলিশ কর্মকর্তা এসে হাজির হন (দেশটিতে যত্রতত্র ধূমপান করা আইনসিদ্ধ নয়)। অতঃপর খুব তমিজের সঙ্গে বলেন; মাফ করবেন স্যার, এটা ধূমপানের সহি স্থান নয়। মনে মনে একটু ভয়ই পেয়েছিলাম, ভেবেছিলাম; হয়তো বিশ হাজার টাকা জরিমানা বাবদ গচ্চা দিতে হবে। কিন্তু আখেরে তেমনটা হয়নি। বিদেশি ও দেশটির আইন সম্পর্কে অজ্ঞতার বিষয়টি জানানোর পর তিনি সহাস্যে বলেন; ওকে স্যার কাম উইথ মি। এরপর তিনি ধূমপানের নির্ধারিত স্থান দেখিয়ে দিয়ে প্রস্থান করেন। শুধু পুলিশ নয়; ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট করতে গিয়েও একইভাবে সম্বোধিত হয়েছি। এ ছাড়া সর্বক্ষেত্রে তারা ‘অনুগ্রহ’ শব্দটি ব্যবহার করে থাকেন। আমাদের মতো কখনো বলেন না; দাঁড়ান দিচ্ছি বা আসেন-আসেন। এগুলো একধরনের আদেশমূলক ভাষা, যা তারা ভদ্রতার বরখেলাপ বলে মনে করেন। এ উপমহাদেশের পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের লোকেরা স্যার নয়, জনাব বলে সম্বোধন করতে অভ্যস্ত। ভারতের বাঙালিরা এখনো বহুল পর্যায়ে ‘মহাশয়’ ব্যবহার করে থাকেন।
পরিতাপের বিষয়, আমরা এখনো সর্বজনগ্রাহ্য এ ধরনের কোনো সম্বোধনসূচক প্রাতিষ্ঠানিক শব্দ প্রবর্তন করতে পারিনি। রিকশাওয়ালা, হোটেলের কর্মচারী, দোকানদার, হকার, সরকারি-বেসরকারি অফিস ও সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো সর্বজনীন শ্রদ্ধাজ্ঞাপক প্রাতিষ্ঠানিক ভাষা নেই। এঁরা সাধারণত মামা, আঙ্কেল, মুরব্বি, ভাই ইত্যাকার ভাষা ব্যবহার করে থাকেন। ক্ষেত্রবিশেষে বলেন স্যার, এ বলাটাও শ্রদ্ধাস্নাত নয়, অনেকটা দায়ে ঠেকে বলা, কখনোবা বাণিজ্যিক প্রয়োজনে বলা। সম্বোধনের এহেন বন্ধ্যাত্ব শুধু প্রান্তিক পর্যায়ে নয়, ক্ষমতাকাঠামোর ওপরের পর্যায়েও বিস্তৃত। প্রয়াত আবুল মাল আবদুল মুহিত সাহেব দীর্ঘ সময় অর্থমন্ত্রী ছিলেন। অনেক সময় সরকারি অনুষ্ঠানে দেখেছি; কোনো কোনো সাংবাদিক তাকে মুহিত ভাই বলে সম্বোধন করছেন। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তাকে মাননীয় অর্থমন্ত্রী বা মিস্টার মুহিত বলে সম্বোধন করাটা হয়তো সমীচীন হতো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে সম্বোধনের ক্ষেত্রেও এমনটা প্রায়শ পরিদৃষ্ট হয়। নিজেকে আপনা আদমি হিসেবে জাহির করার জন্য অনেকেই তাকে অতি উৎসাহে ‘আপা’ বলে অ্যাড্রেস করেন। তিনি হয়তো এতে আপত্তি করেন না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রাচারগতভাবে তাকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সম্বোধন করাটাই হয়তো অধিক সংগত।
বহুল আলোচিত স্যার নিয়ে আমলাতন্ত্রের অভ্যন্তরে তেমন সংকট নেই। প্রজাতন্ত্রের ২৮টি ক্যাডার সার্ভিসের সবাই নিজ নিজ ক্যাডারের সিনিয়রদের স্যার সম্বোধনেই অভ্যস্ত। কখনো কখনো সমস্যা দেখা দেয় আন্ত ক্যাডার সম্পর্কের ক্ষেত্রে। এ ক্ষেত্রে সর্বত্র প্রশাসন ক্যাডারের একধরনের প্রাধান্য বিস্তারের প্রবণতা লক্ষণীয়, যা অনেক ক্ষেত্রেই পীড়াদায়ক হলেও সে বলয় অনতিক্রম্য। দেখা যায়; জেলার সিভিল সার্জনকে সহকারী কমিশনার ডাক্তার সাহেব বলে সম্বোধন করছেন কিন্তু সহকারী সার্জনরা জেলা প্রশাসককে স্যার না বললে তা গর্হিত বলে সমালোচিত হচ্ছে। এক নবনিযুক্ত ডাক্তার জেলার সমন্বয় সভায় লক্ষ করেন; তার সিভিল সার্জনকে সহকারী কমিশনার ডাক্তার সাহেব বলে সম্বোধন করছেন। অতঃপর সেই পদাঙ্ক অনুসরণক্রমে নবনিযুক্ত ডাক্তার সোলায়মান যখন ডিসিকে স্যার না বলে ডিসি সাহেব বলে সম্বোধন করেন; তখন হাউস উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এই স্যার নিয়ে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় নিপতিত হন পুলিশ আর প্রশাসন ক্যাডারের কর্তারা। প্রাণিসম্পদ, কৃষি, সমবায়সহ অন্যান্য অনেক ক্যাডারের কর্তারা এ নিয়ে মাথা ঘামান না, এ নিয়ে আক্ষেপ করবারও তাদের অবকাশ নেই। তাদের অংশীজনেরা ভাই বা আঙ্কেল ডাকলেও তা তাদের প্রসণ্নচিত্তেই মেনে নিতে হয়। কিন্তু একজন ওসি, এসি ল্যান্ড, ডিসি বা এসপিকে স্যার না বললে অনেক ক্ষেত্রে বেকায়দায় পড়তে হয়। প্রত্যাশিত সহায়তা হয় সুদূরপরাহত। এই সম্পর্কের বিষয়ে কোনো নির্দেশনাও নেই। মাঝে মাঝে স্যার নিয়ে সমস্যা দেখা দিলে; জনপ্রশাসন থেকে বলা হয় জনগণ সরকারি লোকদের স্যার ডাকবে; এমন কোনো বিধান নেই। তাহলে জনগণ কী বলে সম্বোধন করবে? তারও কোনো নির্দেশনা নেই। বিষয়টির সুরাহা হওয়া দরকার।
এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে অনেক কিছুরই পরিবর্তন হয়েছে। বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে একজন সরকারি কর্মকর্তা পাখি শিকার করছিলেন; একপর্যায়ে তার গুলিতে একজন সাধারণ লোক নিহত হয়েছিল। অতঃপর প্রভাব খাটিয়ে তিনি সেই হত্যাকাণ্ড ধামাচাপা দিয়েছিলেন। আজকের দিনে তেমনটা হলে সেই কর্মকর্তাকে নিঃসন্দেহে আদালতের মুখোমুখি হয়ে চাকরি খুইয়ে শাস্তির মুখোমুখি হতে হতো। যেই ব্রিটিশদের শাসনকাঠামোর উত্তরাধিকারী আমরা, সেই ব্রিটিশরা সময়ের প্রয়োজনে নিজেদের দেশে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সিভিল সার্ভিসের পরিধি সংকুচিত করেছে অনেক আগে। বিলুপ্ত করেছে দেশটির সিভিল সার্ভিস কলেজ। প্রশাসনকে নিয়ে গেছে জনগণের দোরগোড়ায়।
এই ঔপনিবেশিক প্রশাসনিক কাঠামো ভেঙে একটি গণবান্ধব শাসনকাঠামো প্রতিষ্ঠায় প্রত্যয়েই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাকশাল ব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। পরিতাপের বিষয়; তাকে সেই সুযোগ দেওয়া হয়নি। অঙ্কুরেই তা নস্যাৎ করে দেওয়া হয়। অতঃপর দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও আমরা অভিপ্রেত পরিবর্তন সাধনে সক্ষম হইনি। অধিকন্তু সেই আদি জমানার মাইন্ড সেট আরও মজবুত করে আমরা হাঁটছি পুরোনো পথেই।
প্রকাশ থাকে; দেশের সবচেয়ে মেধাবী সন্তানেরা এখনো সিভিল সার্ভিসে যোগ দিয়ে থাকে। তারাই দেশটির কর্ণধার। তাদের সার্বিক দক্ষতার ওপরই দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি নির্ভরশীল। এ অবস্থায় তাদের সম্মানের দিকটির দিকে যেমন নজর দেওয়া আবশ্যক, তেমনি কর্তৃত্ব নয় দায়িত্বশীলতার ওপরও নজর দেওয়া অত্যাবশ্যক। প্রয়োজন ট্রাডিশনাল মাইন্ড সেটের আমূল পরিবর্তন। এক্ষেত্রে ‘স্যার’ বিষয়ক বেহুদা হুজ্জুতি অভিপ্রেত নয়। স্যার শব্দটি ইতোমধ্যে যেহেতেু একধরনের দাসত্বের প্রতীকে পরিণত হয়েছে, সেহেতু তা পরিহার করাই হবে শ্রেয়তর, সব দিক দিয়ে কল্যাণকর। সে ক্ষেত্রে আন্তক্যাডার সম্পর্ক ও জনগণের সঙ্গে প্রশাসকদের সম্মানজনক সম্পর্কের উপায় সন্ধানের অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য।
স্যার ডাকটি শুধু আমলাতন্ত্রের বলয়ে আদৃত নয়, গণপ্রতিনিধিরাও এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় সম্মানিত সংসদ সদস্য বা মাননীয় মন্ত্রীগণকে স্যার অভিধায় অভিষিক্ত না করলে; তারা ভীষণ গোস্বা করেন। এ-বিষয়ক একটি উদাহরণ তুলে ধরছি। ‘ক’ নির্বাচনে বিজয় লাভের পর একদিন এলাকায় সফরে যান, তার প্রটোকলের দায়িত্ব দেওয়া হয় এক জুনিয়র আমলাকে, যিনি ছাত্রজীবনে একই ধারার রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। এমপি সাহেবকে পেয়ে তিনি আনন্দে আটখানা। আপনা আদমি মনে করে স্যার না বলে সমানে তিনি ভাই ভাই বলে চলছেন। এমপি মহোদয় বার তিনেক তার দিকে কটাক্ষ দৃষ্টি হানেন। অনভিজ্ঞ তরুণ অফিসার দৃষ্টির ভাষা বুঝতে ব্যর্থ হন। অতঃপর একপর্যায়ে ধৈর্য হারান এমপি মহোদয়। ভারী কণ্ঠে বলেন; আমার প্রয়াত পিতার কোন স্ত্রীর সন্তান আপনি? এ কথা শোনার পর তরুণ অফিসার আমতা আমতা করতে থাকেন। ইতোমধ্যে তার আইকিউ চ্যানেল প্রসারিত হয়। ভুল বুঝতে পারেন। শুরু করেন স্যার স্যার। বিদায়কালে এমপি মহোদয় তরুণ অফিসারের পিঠ চাপড়িয়ে স্মিতহাস্যে বলেন; ভালো থাইকেন ইয়াং ম্যান।আমাদের দেশ ২০৪১ সালে উন্নত বিশ্বের কাতারে উন্নীত হবে। এ লক্ষ্যে শাসনকাঠামোর উৎকর্ষ ও দক্ষতার ওপর জোর দেওয়া প্রয়োজন। বৈশ্বিক বলয়ে আমাদের সার্বিক দক্ষতা এখনো বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। এ অবস্থায় শুধু প্রশাসনিক পর্যায়েই নয়, সব পর্যায়ের সার্বিক সম্মানের দিকে নজর দেওয়ার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। জনগণই সব ক্ষমতার উৎস, এ কথাটি শুধু বাণীর পরিধিতে সীমাবদ্ধ না রেখে বাস্তব ক্ষেত্রে কার্যকর করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সব পর্যায়ের সার্ভিস সংস্থাগুলোকে কর্তৃত্ববাদী না করে সেবাদানকারী সংস্থায় পরিণত করতে হবে। কর্তৃপক্ষ নয়, সেবাগ্রহীতাদের যেন সম্মানের সঙ্গে জনাব বলে সম্বোধন করা হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ গণপ্রশাসনের সব পর্যায়ে অভিশপ্ত ‘স্যার’র পরিবর্তে জনাব বা মহোদয় সম্বোধন নিশ্চিত করা সমীচীন হবে। সর্বোপরি কোনো পর্যায়েই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাউকেই তুমি বা তুই বলার প্রবণতা আইনের মাধ্যমে নিরোধ করতে হবে। তা না হলে জাতির জনকের স্বপ্নের বাংলাদেশ পথে পথে হোঁচট খাবে। যা একদিকে যেমন সংবিধানসম্মত নয়, অন্যদিকে স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য অভিপ্রেতও নয়।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক