যুদ্ধটা কি পুরুষের বিপক্ষে, না নিজের সঙ্গেই

শ্রাবণী মজুমদার প্রকাশিত: মার্চ ৮, ২০২৩, ১১:৩৫ এএম

নারী দিবস কী, কেন, তা নিয়ে আমি নতুন করে কিছুই বরং না বলি। কেবলই তা পাঠকের সময়ের অপচয় করবে আবার যত দিন পুরোপুরি সমতা (পুরোপুরি সমতা বিষয়টাও বেশ কনফিউজিং) না আসছে, এই দিবসের প্রয়োজনীয়তাও আছে, তাতে দ্বিমতও করছি না। নারী দিবস নিয়ে যারাই লিখছে, তারা সবাই রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার, ধর্ম, আইন কেমন করে নারীকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে, তা নিয়ে লিখেছে এবং সামনেও লিখবে, তাই সেই আলোচনাতেও যাচ্ছি না।

আমি আসলে বলতে চাই নিজেকে নিয়ে। একজন নারী হিসেবে নিজের দুর্বলতা বা সমস্যা ও করণীয় নিয়ে। সে ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় নিয়ে সামান্য আলোকপাত করছি।

যখন আমি একজন ধর্ষিতা

আমরা প্রায় সব সময়েই দেখি, একজন নারী যখন রেপড হয়; শুভাকাঙ্ক্ষীরাই যেন নারীটির বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, পক্ষে দাঁড়াবার উদ্দেশ্যে। তারা চায়, নারীটি যেন এই লজ্জা নিয়ে অস্বস্তিতে না পড়ে, মরে যাওয়ার মতো অঘটন না ঘটিয়ে ফেলে। তাই তারা বলতে চায়—তুমি লুকিয়ে থাকো, কেউ যাতে তোমাকে দেখতে না পায়, কেউ যেন তোমার এই অপমান জেনে না যায়, আমরা চাই তুমি ভালো থাকো, তাই খুব গোপনে লুকিয়ে থাকো, পত্রিকায় তোমার ছবি না উঠুক, টিভিতে তোমার লজ্জাবনত মুখ ঢেকে থাকুক, স্কুল-কলেজ-রাস্তা-দোকান কোথাও তোমার পা না পড়ুক সহজেই, কারণ আমরা চাই না সমাজ তোমাকে নিয়ে বাজে কথা বলুক।

এই শুভাকাঙ্ক্ষীদের মধ্যে থাকেন আত্মীয়, থাকেন সাংবাদিক, মিডিয়া কর্মী, আন্দোলনকারী, মা-বোন-বান্ধবী অর্থাৎ অনেকেই থাকে মূলত নারী। 

কিন্তু কেন? কেন আমাকে মুখ ঢেকে রাখতে হবে। সমাজ কে? আমিই কি সমাজ নই? কেন আমি ঢেকে রাখব মুখ, কোন অপরাধ আমি করেছি? চুরি, খুন, লুটপাট, অন্যের ঘরে আগুন দেওয়া, অর্থ পাচার, ঘুষ নেওয়া—কোন অন্যায়ের ফলে আমি মুখ লুকিয়ে রাখি?

আমি সেই নারী হিসেবে নিজেরই বিপক্ষে, যে কিনা সমাজের ভালোমানুষি ভরা রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না; বলতে পারে না, “সম্মান/অসম্মান আমার শরীরে নয়, আমার কাজে।”

পোশাকের স্বাধীনতা
আমি পোশাকের স্বাধীনতা চাই। স্লিভলেস ব্লাউজ পরতে চাই; ক্লিভেজ দেখা যাবে, এমন পোশাক পরতে চাই, ব্রেসিয়ারের ফিতা বেরিয়ে থাকা স্টাইল আমার ভালো লাগতে শুরু করেছে। ইচ্ছে হয় থ্রি-কোয়ার্টার পরে বেরিয়ে পড়ি গ্রীষ্মের দুপুরে—রোদের বাতাস আরও কিছু যদি শুশ্রূষা দেয় স্বস্তি মেলে। অর্থাৎ আমার স্বচ্ছন্দ হয়, এমন যেকোনো পোশাক পরতে আমি ভালোবাসি। এতে সমস্যাটা কোথায়? সমাজ কী ভাবে? সমাজ কী চোখে তাকায়? নাকি সমাজ বাধা দিচ্ছে? 

সমাজ যদি বাধা দেয়, সেটার বিরুদ্ধে তো দাঁড়াতেই হবে; সে বিষয়ে আপাতত বলছি না। বলছি, সমাজের ভাবনা ও তাকানো বিষয়ে আমার প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে। আমি যদি আমার পোশাক নিয়ে স্বচ্ছন্দে থাকি, তাহলে অন্য নারী বা পুরুষ কী ভাবে, কী মন্তব্য করে, কীভাবে তাকায়— তা নিয়ে কেন এত চিন্তা আমার? একজন পুরুষ যখন আমার লাল শাড়ির সঙ্গে পরা লাল টিপের মাঝে সবুজ ছোট টিপটির দিকে তাকায়, তখন তো আমার সমস্যা হয় না; কিন্তু যখন মনে হয় সে হয়তো তাকিয়ে আছে আমার খোলা নাভির দিকে বা ক্লিভেজের দিকে, তখন কেন আমার সমস্যা হয়? আমি কি নিজেই অস্বস্তি অনুভব করি আমার এই পোশাক-শরীর নিয়ে? সম্ভবত করি। কেন করি?

আর্থিক স্বাধীনতা, ক্যারিয়ার সচেতনতা

সংসার সুন্দর করে তুলতে স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই ভূমিকা থাকা চাই। চাই অর্থ, চাই ঘরের জন্য যৌথ সময়। অর্থ ছাড়াও নিজের পছন্দের ক্যারিয়ার গড়তেও করতে হয় কাজ। সেই ক্যারিয়ার গড়ার বিপক্ষে পুরুষ কি সব সময়ই বাধা হয়ে দাঁড়ায়? এই সময়ে এসে আমার তা মনে হয় না; আমি অন্তত চারপাশে তাকিয়ে তেমন ভাবতে পারি না। যারা যোগ্য তারা ঠিক নিজের মতো কাজ করছে পুরুষের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে। মিলেমিশেই। এ ক্ষেত্রে কে কতখানি আয় করল, সংসারে কতখানি কন্ট্রিবিউশন, তা নিয়ে আমি কখনো ভাবিনি। যদি আমি পারি পুরো সংসার চালাতে খরচ করব। যদি না পারি করব না; এখানে ৫০/৫০ ভাগের তো কিছু নেই। ভালোবাসা কি মেপে ভাগ করে হয়? কাল আমি যদি কাজ না করতে পারি, যদি পঙ্গু হয়ে যাই, আমার সঙ্গী কি আমার সমস্ত দেখভাল করবে না? আমাদের আসলে সময়টা দেওয়া উচিত সম্পর্ককে সহজ সুন্দর ভালোবাসাপূর্ণ করে তুলতে, যাতে উপার্জন বা ক্যারিয়ারের প্রশ্নে সঙ্গীকে প্রতিদ্বন্দ্বী নয় বরং সহযোগী হিসেবে পাওয়া যায়।

যখন আমি মা

অভিভাবক হিসেবে আমি আমার মেয়েসন্তানটিকে কীভাবে, কোন শিক্ষায় বড় করে তুলছি? এই বিষয়টা খুব জরুরি। আমি কি তাকে বড় হতে হতেই বুঝিয়ে চলছি যে, “মা, তোমার শরীর হলো একটা লজ্জার বস্তু, যা সব সময় আড়াল করে রাখতে হবে, তোমার সমস্ত সম্মান তোমার এই শরীরে…” নাকি বলছি, “তোমার শরীর, তোমার চিন্তা, তোমার কাজ—সবকিছুই তোমার স্বাধীন যাপনে গুরুত্বপূর্ণ। তোমার শরীর তোমার কাজের সহায়ক লজ্জার বস্তু নয়, যা নিয়ে ভাবতে ভাবতেই কাজের সময়ের অপচয় করে ফেলবে…তবে তোমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু ঘটলেই সেটা তুমি মেনে নেবে না, প্রতিবাদ করবে, আমরা তোমার সঙ্গে আছি, থাকব।”

পুরুষ আমার সঙ্গেই ছিল, আছে

জন্ম হতে আজ অবধি বাবা-ভাই-প্রেমিক-স্বামী-বন্ধু-সন্তান—সব পুরুষই আমার সঙ্গে ছিল। নারী হিসেবে কখনো কাউকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে হয়নি। বরং এতকাল পর আজ মনে হয়, নিজেকেই নিজের বিপক্ষে দাঁড় করিয়ে বলতে ইচ্ছে হয়, সবার ভালোবাসা পেয়েও যা কিছু করে উঠতে পারিনি, তা কেবল নিজেরই অক্ষমতায়। তাই পরিবর্তন করতে চাই নিজেকেই। কাছে থাকা দূরে থাকা সবার হাত ধরেই।

সর্বোপরি নারী হিসেবে, আমার জরুরি লড়াইটা কি পুরুষের বিপক্ষে নাকি নিজের সঙ্গে? এর উত্তরে প্রথমেই মনে আসে, কী দুর্ভাগ্য যে শেষ পর্যন্ত লড়াইটা অনিবার্য হয়ে উঠল এমনকি সেটার ব্যাখ্যাগুলোও লিখে রাখতে হচ্ছে আমাকেই এবং সে লড়াইটা আসলে নিজের সঙ্গেই, নিজেকে যোগ্য ও বড় হয়ে উঠবার লড়াই।

লেখক : লেখক ও প্রকাশক।