পাঠ্যবই নিয়ে ‘বাঁদরনাচ’

কবির য়াহমদ প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৯, ২০২৩, ০৩:৪৮ পিএম

মানুষের পূর্বপুরুষ নিয়ে ‘বাঁদরকাণ্ড’ ঘটিয়ে ফেলেছে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীরা। পাঠ্যবইয়ে লেখা হয়নি ‘মানুষের সৃষ্টি বানর থেকে’, অথচ এ কথাটিকেই সামনে এনে পাঠ্যবই থেকে বিবর্তনবাদ বাদ দেওয়ার দাবি করছেন অনেকেই। বরং বইয়ে বলা হয়েছে— ‘অনেকে বলেন মানুষের উদ্ভব নাকি বানর থেকে। এ কথা ভুল’। এই তথ্য একবার নয়, একাধিকবার বলা হয়েছে। পাঠ্যবইকে কেন্দ্র করে মানুষ ও বানর নিয়ে যে কাণ্ড ঘটছে, সেটা এককথায় ‘বাঁদরকাণ্ড’ বলা যায়। সামাজিক মাধ্যমে এ নিয়ে চলছে ‘বাঁদরনাচ’। অনাকাঙ্ক্ষিত এই কাণ্ডের প্রভাব পড়ছে সবখানে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবক মহলে।

ভাবতে অবাক লাগে, শিক্ষা নিয়ে এখনো এমন গুজব প্রচারে একটা শ্রেণির মানুষ খুব আগ্রহী। এটা কোনো রাজনৈতিক উপলক্ষ নয়, রাজনৈতিক স্বার্থও এখানে জড়িত নয়; তবু...।

পাঠ্যবই নিয়ে বিতর্ক নিয়মিত ঘটনা আমাদের। প্রতিবছরই কোনো না কোনো বিতর্ক সৃষ্টি হয়। পাঠ্যবইয়ে ধর্ম, বিশেষত ইসলামবিরোধী লেখা ও লেখকের আধিক্য রয়েছে— এমন প্রচার চালিয়ে বেশ কয়েক বছর আগে বেশ কিছু লেখা ও লেখককে সরিয়ে দেওয়ার দাবি উঠেছিল। হেফাজতে ইসলাম নামের ধর্মভিত্তিক সংগঠনের সেই দাবির কাছে নতি স্বীকার করেছিল সংশ্লিষ্টরা। গত বছর ময়মনসিংহ-৮ আসনের সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম পাঠ্যবই নিয়ে জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে মিথ্যাচার করছিলেন। তার সেই মিথ্যাচারে গলা মিলিয়েছিলেন সরকারবিরোধী বিভিন্ন দলের বেশ কজন সংসদ সদস্যসহ অনেক সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারী ও টক শোর আলোচক। ফখরুল ইমাম তার বক্তব্য পরবর্তী সময়ে প্রত্যাহার করলেও সেই রেশ এখনো রয়ে গেছে। গতবার তিনি যে দাবি করেছিলেন এবার পাঠ্যবই নিয়ে বিতর্কের এই সময়ে পুরোনো সেই কথাগুলো আবারও সামাজিক মাধ্যমে ঘুরেফিরে এসেছে, জোরালোভাবে এসেছে। এখানে ফের গলা মেলাচ্ছেন আগের সেই গুজব প্রচারকারীরা।

এবারও পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে ধর্মের বিরোধ দেখানোর চেষ্টা হয়েছে ফেসবুক-ইউটিউবসহ বিভিন্ন মাধ্যমে। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.), হজরত আবু বকর, হজরত ওমরের জীবনী এবং বিদায় হজ নামের নিবন্ধ বাদ দেওয়ার যে দাবি করা হচ্ছে, সেটা মিথ্যা। যে সংসদ সদস্যের মাধ্যমে মিথ্যাচার হয়েছিল সংসদে, সেই সদস্য স্পিকারকে চিঠি দিয়ে তার বক্তব্য প্রত্যাহারের আবেদনও করেছিলেন। কিন্তু গুজবের উৎসমুখ বন্ধ হলেও সেই গুজব কিন্তু থামেনি, বরং বিপুলভাবে সেটা শাখাপ্রশাখা ছড়িয়েছে।

এবার কেন পুরোনো গুজবে লাগল নতুন হাওয়া— এর পেছনে কী কারণ? ধারণা করা যায়, এর কারণ মুহম্মদ জাফর ইকবাল। পাঠ্যবই নিয়ে এবার বিতর্ক শুরু হয়েছে মূলত ‘প্লেজারিজম’ থেকেই। জাপানপ্রবাসী গবেষক এস এম নাদিম মাহমুদ একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত এক নিবন্ধে সপ্তম শ্রেণির বিজ্ঞান বইয়ে ‘হুবহু চুরি আর গুগলের অনুবাদ’ বিষয়ে আলোকপাত করার পর ওই বইয়ের রচনা ও সম্পাদনার দায়িত্বে থাকা ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও ড. হাসিনা খান তাদের দায় স্বীকার করে নেন এবং পরিমার্জন ও সম্পাদনার আশ্বাস দেন। উল্লেখ্য, নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে লেখা সপ্তম শ্রেণির বিজ্ঞান ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ বইটি রচনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল, ড. হাসিনা খান, ড. মোহাম্মদ মিজানুর রহমান খান, ড. মুশতাক ইবনে আয়ূব, রনি বসাক; সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল।

মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও হাসিনা খান পাঠ্যবই নিয়ে বিতর্ক শুরুর সঙ্গে সঙ্গে মূল বিষয়টি এড়িয়ে না গিয়ে সততার পরিচয় দিয়েছেন, এবং নিজেরা বইয়ের নির্দিষ্ট ওই অংশ রচনা না করলেও দায় স্বীকার করে নিয়েছেন। তাদের এই দায় স্বীকারকে ভুল স্বীকারের সংস্কৃতির গঠনে সহায়ক হিসেবে দেখে ওখানে আলোচনার সমাপ্তি হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু সেটা হয়নি। বরং সেটাকেই কেন্দ্র করে মূলত পাঠ্যবই বিষয়ে বড়ধরনের গুজব ছড়ানো হয়েছে। যারা পুরনো গুজবকে নতুনভাবে ছড়িয়েছে তারা জানে ‘প্লেজারিজম’ বিষয়ক আলোচনা মূলত বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা, যেখানে সাধারণের অংশগ্রহণ থাকবে না, সাধারণেরা ওসব নিয়ে মাথা ঘামাবে না; তাই তারা পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে ধর্মের বিরোধ দেখানোর পুরোনো চেষ্টাটাই চালিয়েছে। এবং গুজবপ্রিয় কিংবা গুজবপ্রবণ লোকজন সেটাকেই সত্য বলে ধরে নিয়ে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে।

গুজব যারা ছড়ায় তারা অসৎ মানসিকতার নিঃসন্দেহে। তাদের এই অসততা ফের মাথাচাড়া দিয়েছে বইয়ের সঙ্গে মুহম্মদ জাফর ইকবালের নাম যুক্ত থাকার কারণে। যেকোনোভাবে তাকে বিতর্কিত ও অসম্মান করাই উদ্দেশ্য এখানে।

গুজব নিয়ে অনেক কথা হয়, অথচ প্রতিবারই একেকটা গুজব আমাদের ক্রমনিঃশেষ করে দিচ্ছে। সরকার বলে, আমরাও বলি অনলাইনে শেয়ারের আগে তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত হতে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! সবাই যার যার লক্ষ্য পূরণে, তথ্য মিথ্যা হলেও...!

পাঠ্যবই নিয়ে যারা গুজব ছড়াতে বিভিন্নভাবে ভূমিকা রাখছেন, তাদের সবাই যে কম শিক্ষিত এমন না, অনেক শিক্ষিত লোকও আছেন এর মধ্যে; তবু তারা জেনেবুঝেই এসব কাজ করছেন। এসব যে অনৈতিক, এই নৈতিক শিক্ষা কে দেবে তাদের?

 

লেখক : প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক