ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশ

কবির য়াহমদ প্রকাশিত: জানুয়ারি ২১, ২০২৩, ০৩:৩৪ পিএম

‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এক যুগের বেশি সময় আগে ক্ষমতায় এসেছিল আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার পথে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। শুরুর সেই সময়ের তুলনায় আমরা তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বেশ এগিয়ে আছি। সরকার যেভাবে এই খাতকে অগ্রাধিকার যাচ্ছে, তাতে করে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণ অসম্ভব নয়। এখন প্রায় সবকিছুতেই তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা নিতে হয় আমাদের। এটা আমাদের রাষ্ট্রীয় অগ্রগতির সূচক।

ডিজিটাল বাংলাদেশ স্লোগানের সঙ্গে এবার যুক্ত হয়েছে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’-এর স্বপ্ন। এবার সরকারের লক্ষ্য ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’-এ রূপান্তর। স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট সোসাইটি, স্মার্ট ইকোনমি ও স্মার্ট গভর্নমেন্ট—এ চারটি মূল ভিত্তিকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ সরকার আগামী ২০৪১ সাল নাগাদ একটি সাশ্রয়ী, টেকসই, বুদ্ধিদীপ্ত, জ্ঞানভিত্তিক, উদ্ভাবনী স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চায়। এ লক্ষ্যে কাজ ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে। সরকারের নানা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সঙ্গে সঙ্গে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ স্লোগানটিও ক্রমে প্রকাশ্য হচ্ছে।

গত বছরের এপ্রিলে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্স’-এর তৃতীয় সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশকে ‘স্মার্ট বাংলাদেশে’ রূপান্তরের পরিকল্পনার কথা জানান। প্রধানমন্ত্রীর এই পরিকল্পনা আলোচনায় আসে একই বছরের ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস ২০২২-এ। গত ১২ ডিসেম্বর ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের ঘোষণা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগামী ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি ও উদ্ভাবনী বাংলাদেশ। তিনি বলেন, আগামী ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তুলব, সেই সঙ্গে বাংলাদেশ হবে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’।

সরকারি অনুষ্ঠানেই কেবল প্রধানমন্ত্রী স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করেননি, এই পরিকল্পনা তাদের দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীকেও জানিয়ে দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় সম্মেলনে শেখ হাসিনা বলেছেন, আগামীর বাংলাদেশ হবে স্মার্ট বাংলাদেশ, যেখানে প্রতিটি জনশক্তি স্মার্ট হবে, তারা প্রতিটি কাজ অনলাইনে করতে শিখবে, ইকোনমি হবে ই-ইকোনমি, যাতে সম্পূর্ণ অর্থ ব্যবস্থাপনা ডিজিটাল ডিভাইসে করতে হবে। আমাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মযোগ্যতা সবকিছুই ই-গভর্ন্যান্সের মাধ্যমে হবে। ই-এডুকেশন, ই-হেলথ, ই-কৃষিসহ সবকিছুতেই ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করা হবে। ২০৪১ সাল নাগাদ সরকার এটা করতে পারবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

সরকারের স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন যে কথার কথা তা নয়, এর জন্যে ইতোমধ্যেই কাজ শুরু হয়ে গেছে। এ লক্ষ্যে গঠিত হয়েছে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ টাস্কফোর্স’। গত বছরের ১৬ আগস্ট মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জারি এক প্রজ্ঞাপনে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ৩০ সদস্যের এই টাস্কফোর্স গঠিত হয়। এই টাস্কফোর্সে আছেন প্রধানমন্ত্রীসহ ছয়জন মন্ত্রী, একজন প্রতিমন্ত্রী এবং সচিবসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের মধ্যে আছেন প্রধানমন্ত্রী (চেয়ারপারসন), অর্থমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সচিবকে টাস্কফোর্সের সদস্য সচিব করা হয়েছে।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রজ্ঞাপনে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ টাস্কফোর্স’-এর নয়টি কার্যপরিধি স্পষ্ট করা হয়েছে। যার মধ্যে আছে— অগ্রসরমাণ তথ্যপ্রযুক্তি বাস্তবায়ন বিষয়ে দিকনির্দেশনা প্রদান; শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ও আর্থিক খাতের কার্যক্রম স্মার্ট পদ্ধতিতে রূপান্তরের সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে দিকনির্দেশনা প্রদান; স্মার্ট ও সর্বত্র বিরাজমান সরকার গড়ে তোলার লক্ষ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক, বাণিজ্যিক ও বৈজ্ঞানিক পরিমণ্ডলে তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক বিধিবিধান প্রণয়নে দিকনির্দেশনা প্রদান; বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ উৎক্ষেপণে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা প্রদান; এজেন্সি ফর নলেজ অন অ্যারোনটিক্যাল অ্যান্ড স্পেস হরাইজন (আকাশ) প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা প্রদান; ব্লেন্ডেড এডুকেশন মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন এবং ফাইভজি সেবা চালু-পরবর্তী সময়ে ব্যান্ডউইথের চাহিদা বিবেচনায় চতুর্থ সাবমেরিন কেব্‌লে সংযোগের প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা প্রদান; রপ্তানি কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে মেড ইন বাংলাদেশ পলিসি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সময়াবদ্ধ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে দিকনির্দেশনা প্রদান; আর্থিক খাতের ডিজিটালাইজেশন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান এবং স্মার্ট বাংলাদেশ ২০৪১ (স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট সোসাইটি, স্মার্ট ইকোনমি এবং স্মার্ট গভর্নমেন্ট) বাস্তবায়নে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাস্তবায়নে দিকনির্দেশনা প্রদান।

এর আগে ডিজিটাল বাংলাদেশ স্লোগান ও বাস্তবায়নের স্বপ্ন যখন দেখাচ্ছিল আওয়ামী লীগ সরকার তখন অনেকেই অবাক হয়েছিলেন, কিন্তু সেই স্বপ্ন বাস্তবতার পথে। যারা ডিজিটাল বাংলাদেশ স্লোগান ও স্বপ্ন নিয়ে ঠাট্টা করছিলেন, তারাও এই ডিজিটাইজেশনের সুফল ভোগ করছেন। এটা যদিও রাজনৈতিক কোনো স্লোগান ও লক্ষ্য ছিল না, তবু রাজনৈতিক কারণে অনেকেই বিদ্রূপ করছিলেন; তবে শেষ পর্যন্ত তারাও স্বীকার না করলেও এর সুফলভোগী। স্মার্ট বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা শুরুর পর অদ্যকার যে বিরোধিতা কিংবা বিদ্রূপ সেটাও রাজনৈতিক হলেও আমরা নিশ্চিত এটা বাস্তবায়ন হলে সবার মতো তারাও এর সুফলভোগী হবেন।

রাজনৈতিক সরকারের যেকোনো কর্মসূচি নিয়ে রাজনৈতিক পর্যায়ে আলোচনা-সমালোচনা থাকতেই পারে, কিন্তু দেশের উন্নয়নের স্বার্থে যেকোনো কর্মসূচিকে আমাদের সমর্থন করা উচিত। বাংলাদেশের প্রতি সেক্টরে তথ্যপ্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে, এই খাতে বাংলাদেশ এগিয়েছে অনেক। এটাকে স্বীকার করা উচিত, সমর্থন করা উচিত। ডিজিটাল বাংলাদেশকে স্মার্ট বাংলাদেশে উন্নীত করার সরকারের যে পরিকল্পনা, সেটা নিয়ে নানামুখী আলোচনা হতে পারে, কিন্তু এর বিরোধিতা করতে এই স্লোগান নিয়ে বিদ্রূপ অনুচিত।

২০৪১ সাল নাগাদ বাংলাদেশ হবে উন্নত দেশ, হবে স্মার্ট বাংলাদেশ—এই ঘোষণাকে আওয়ামী লীগের আরও ২০ বছর ক্ষমতায় থাকার অভিলাষ হিসেবে না দেখে দেশের উন্নয়নে সরকারের নেওয়া মহাপরিকল্পনা হিসেবে দেখতে পারি আমরা। আর এটা সম্ভব হলে ডিজিটাল বাংলাদেশ, স্মার্ট বাংলাদেশ বিদ্রূপ আর বিরোধিতার উপকরণ হবে না, হবে দেশের উন্নয়নে একাত্ম হয়ে এক লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার টনিক।
 

লেখক : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক