লাগাতার লোডশেডিং ডেকে আনতে পারে বড় বিপর্যয়

মোহাম্মদ নূরুল হক প্রকাশিত: অক্টোবর ২৭, ২০২২, ১১:০৮ এএম

সম্প্রতি দেশে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে লোডশেডিং। এই লোডশেডিংয়ের পক্ষে বিদ্যুৎ বিভাগ তাদের যুক্তিও তুলে ধরেছে। এসব যুক্তি তুলে ধরার সময় তারা চাহিদার তুলনায় বিদ্যুতের সরবরাহ কম থাকা ও জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয়ের কারণকে দায়ী করেছে। কিন্তু যে কারণেই বিদ্যুৎ-বিপর্যয় ঘটুক, তার প্রভাব গিয়ে পড়বে শিক্ষা, কৃষি, কলকারখানা, সরকারি-বেসরকারি দপ্তরের কর্মঘণ্টার ওপর। ভয়ানক প্রভাব পড়তে জনস্বাস্থ্যেও। আর এসবের সম্মিলিত নেতিবাচক প্রভাব পড়বে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ওপর।

দেশের অসহনীয় লোডশেডিংয়ের ভেতর মাঝে মাঝে বড় ধরনের বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের ঘটনাও ঘটে। এর মধ্যে চলতি বছরের ৪ অক্টোবর দেশের অর্ধেকের বেশি এলাকা ছয় ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে বিদ্যুৎহীন ছিল। এসব এলাকার মধ্যে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটে অঞ্চলের অধিকাংশ এলাকা রয়েছে। এর আগে, বড় ধরনের বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটেছিল ২০১৭ সালের ৩ মে।  ওই সময় গ্রিড বিপর্যয়ের ফলে উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমের ৩২ জেলায় কয়েক ঘণ্টা বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন ছিল। সবচেয়ে বড় গ্রিড বিপর্যয় ঘটেছিল ২০১৪ সালে। ওই বছর ১ নভেম্বর বেলা ১১টা ২৭ মিনিট থেকে পরবর্তী ১৪ ঘণ্টা ধরে পুরো বাংলাদেশ বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। এর আগে ২০০৭ সালেও বড় ধরনের ব্ল্যাকআউটের ঘটনা ঘটেছিল। ওই বছর নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে দুই দফা ব্ল্যাকআউটের ঘটনা ঘটে।

এ তো গেল গ্রিড বিপর্যয়ের কথা। আবারও লোডশেডিং প্রসঙ্গে আসা যাক। ভোক্তাপর্যায়ের নিত্য অভিযোগ, কখন বিদ্যুৎ যায়, আর কখন আসে, তার কোনো সময়-অসময় নেই। কোনো কোনো এলাকায় দিনের অধিকাংশ সময়ই বিদ্যুতের দেখা মেলে না। ফলে ভোক্তাদের বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকতে হচ্ছে। এভাবে দিনের পর দিন, দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন থাকার কারণে বড় ধরনের যেসব ক্ষতি হয়, সেগুলো হলো: ১. শিক্ষার ক্ষতি, ২. কলকারখানার উৎপাদন হ্রাস, ৩. সরকারি-বেসরকারি দপ্তরের কর্মঘণ্টা নষ্ট, ৪. কৃষি খাতে ক্ষতি, ৫. অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে আশঙ্কা বৃদ্ধি ৬. ইলেক্ট্রিক ও ইলেক্ট্রনিক্স যন্ত্রপাতির ক্ষতি।  

দীর্ঘ সময় ধরে লোডশেডিংয়ের প্রত্যক্ষ ক্ষতির শিকার শিক্ষার্থীরা। বর্তমানে দেশের প্রায় প্রতিটি এলাকাই বিদ্যুতের আওতায় এসেছে। বিদ্যুৎসংযোগ পাওয়া এলাকাগুলো দৃশ্যত সৌভাগ্যের অধিকারী হলেও কার্যত দুর্ভাগা। কারণ, বিদ্যুতে অভ্যস্ত জনগোষ্ঠী এখন আর কেরোসিনের কুপি কিংবা হারিকেন জ্বালায় না। এছাড়া, কুপি-হারিকেন ব্যবহারে পুনঃঅভ্যস্ত হতে গেলে নতুন সংকট তৈরি হবে। ঘরে ঝুলকালির পরিমাণ বাড়তে থাকবে। মানুষ স্বভাবতই উন্নত সেবায় অভ্যস্ত হওয়ার পর নিম্নমানের জীবনযাপনে ফিরে যেতে চায় না। ফলে লোডশেডিং চলার সময় কেউ কেউ চার্জার লাইট ব্যবহার করেন। কিন্তু লোডশেডিংয়ের ডিউরেশনের সঙ্গে এসব চার্জার লাইট পাল্লা দিয়ে তার গ্রাহককে সেবা দিতে পারে না। অর্থাৎ একটি চার্জার লাইটের ক্যাপাসিটি হয়তো বড়জোর আধা ঘণ্টা আলো দেওয়ার, কিন্তু লোডশেডিং চলে অন্তত টানা এক ঘণ্টা। এরপর বিদ্যুৎ এসে হয়তো থাকে সর্বোচ্চ ৪০ মিনিট। আবার শুরু হয় লোডশেডিং। এই স্বল্প সময়ের মধ্যে চার্জারগুলো পূর্ণ চার্জ হতে পারে না। ফলে ভোক্তাদের অন্ধকারেই কাটাতে হয়। আর এই অন্ধকারের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিক্ষার্থীরা। তারা আলোর অভাবে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে না। পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারে না পাঠে। ধীরে ধীরে পাঠবিমুখ হয়ে পড়ে। লোডশেডিংয়ের সময় তারা স্মার্টফোনে আসক্ত হয়ে পড়ে। এই স্মার্টফোনে তারা নানা রকম বিপজ্জনক গেমের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। পরবর্তী সময়ে পরীক্ষায় ফল খারাপ করে। পরীক্ষায় ফল খারাপ হলে পরিবারের সিনিয়র সদস্যদের শাসনের ভয়ে, স্বজনদের তিরস্কার-বিদ্রূপের ভয় ও হতাশায় আত্মহননের পথ বেছে নেয়। এতে একদিকে মেধার বিপুল অপচয় ঘটছে, অন্যদিকে ঘটছে প্রাণহানির শঙ্কাও।  

অসহনীয় লোডশেডিংয়ের দ্বিতীয় শিকার কল-কারখানাগুলো। দীর্ঘ সময় ধরে লোডশেডিং চলতে থাকলে বড় বড় শিল্পকারখানা থেকে শুরু করে ছোটখাটো উৎপাদনমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মীরা অলস সময় কাটান। লোডশেডিংয়ের সময় নিজস্ব জেনারেটরও দীর্ঘ সময় ধরে বিদ্যুৎ সাপোর্ট দিতে পারে না। জেনারেটরই যদি সারা দিনের বিদ্যুৎ সাপোর্ট দেবে, তাহলে জাতীয় গ্রিডের ইলেকট্রিসিটির সংযোগ নেবে কেন প্রতিষ্ঠানগুলো? এভাবে দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎবিচ্ছিন্নতার ফলে শিল্পপ্রতিষ্ঠানে উৎপাদন কমে যায়। উৎপাদন কমে গেলে মালিকরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হন, তেমনি আয় কমে যায় শ্রমিকদেরও। মালিকদের মুনাফা কমে গেলে তার ব্যয়সংকোচন করতে গিয়ে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের উদ্যোগ নিতে পারেন। নেনও। কিন্তু শ্রমিকরা চাকরিচ্যুত হলে কী করবেন? পথে নামা ছাড়া তাদের গত্যন্তর কী? এই যে উৎপাদনকেন্দ্রিক লোকসানের বৃত্ত, এরপর প্রভাব পড়ে জাতীয় অর্থনীতিতে।  

দীর্ঘ সময় ধরে লোডশেডিং চলার কারণে সরকারি-বেসরকারি দপ্তরের কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। লোডশেডিং চলা অবস্থায় সাধারণ সরকারি দপ্তর-অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কর্মহীন সময় কাটাতে বাধ্য হন। তেমনি বেসরকারি দপ্তরের কর্মকর্তাদেরও এই ভাগ্যবরণ করতে হয়। তারা আলো-বাতাসহীনতায় পড়ে সময় অতিবাহিত করেন। চাইলেও কাজে মনোযোগ দিতে পারেন না। ফলে আড্ডায় ব্যস্ত হতে বাধ্য হন। এর কুফল ভোগ করতে হয় পুরো জাতিকে।

আধুনিক কৃষিব্যবস্থায় বিদ্যুতের বড় ভূমিকা রয়েছে। বিশেষত সেচকাজে। দীর্ঘ সময় লোডশেডিং চলার কারণে সেচকাজ ব্যাহত হয়। পানির অভাবে ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর প্রভাব পড়ে নিত্যপণ্যের বাজারে। ফলে নিম্ন আয়ের মানুষকে চড়া দামে নিত্যপণ্য কিনতে হয়।

রাতের বেলা দীর্ঘ সময় ধরে লোডশেডিং চলার কারণে সড়ক-অলিগলি হয়ে পড়ে অনিরাপদ। সন্ত্রাসী, ছিনতাইকারীরা অন্ধকারে ওত পেতে থাকে। বিশেষ প্রয়োজনে বাসা-বাড়ি থেকে বের হওয়া গৃহবধূ, কাজের লোকসহ পথচারীদের ওপর তারা হামলে পড়তে পারে। কেড়ে নিতে পারে তাদের সর্বস্ব।  

এছাড়া ঘন ঘন বিদ্যুৎ আসা-যাওয়ার কারণে ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিকস যন্ত্রপাতি ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়তে পারে। বিদ্যুতের এই সংকটের ফ্রিজ-এসি কম্প্রেসার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, বাল্ব ফিউজ হয়ে যাওয়া, কম্পিউটারের পাওয়ার সাপ্লাই পুড়ে যাওয়ার মতো বড় বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব দুর্ঘটনাই ঘটে। এর বাইরে বড় ধরনের ক্ষতি ঘটে স্বাস্থ্যখাতে। দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎহীনতার কারণে বয়স্ক-শিশু ও অসুস্থ ব্যক্তিদের স্বাস্থ্যহানির আশঙ্কা বাড়ে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বিদ্যুৎসরবরাহ স্বাভাবিক রাখার জন্য কী করা উচিত? এই প্রশ্নের উত্তরে বলব, পদাধিকার বলে ‘সবজান্তা’ সেজে বসে থাকা ব্যক্তিদের থামাতে হবে। বিপরীতে বিদ্যুৎ সম্পর্কে শতভাগ ধারণা-জ্ঞান রাখেন, এমন প্রকৌশলীদের পরামর্শ নিতে হবে। নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে মাঠপর্যায়ে বিদ্যুৎ-সংক্রান্ত শতভাগ জ্ঞান আছে, এমন ব্যক্তিদের স্থান দিতে হবে। এরপর যে কাজগুলো করতে হবে, সেগুলো হলো:

১। বিদ্যমান বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ত্রুটি সারিয়ে তুলতে হবে
২। নতুন পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র তৈরি করতে হবে
৩। বিদ্যুতের অপচয় রোধ করতে হবে
৪। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বন্ধ করতে হবে
৫। ইলেকট্রিক বাইক নিষিদ্ধ করতে হবে

যখনই বড় ধরনের বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটে, তখনই বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে অজুহাত দেখানো হয়। আর এসব ঘটনায় যেসব তদন্ত কমিটি হয়, তারা ঘুরেফিরে একটাই কারণ বলে। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ত্রুটির কথাই এতে উঠে আসে। অর্থাৎ বিদ্যমান বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ত্রুটিপূর্ণ। যদি বিদ্যমান বিদ্যুৎকেন্দ্রে ত্রুটি থাকে, তাহলে স্থায়ীভাবে সেই ত্রুটি সারিয়ে তুলতে হবে। এসব কেন্দ্রের ত্রুটি সারিয়ে তোলার পরও চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব না হয়, তাহলে নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে হবে। সেই সব কেন্দ্র যেন পরিবেশবান্ধব হয়।

জনগণকে বিদ্যুতের অপচয় রোধে সচেতন করতে হবে। কেবল জনগণকে সচেতন করলেই হবে না, মনে রাখতে হবে, বিদ্যুতের সবচেয়ে বেশি অপচয় করে বিত্তশালী ও  সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সবার আগে সেদিকে নজর দিতে হবে।

দেশে বিদ্যুৎ অপচয়ের সবচেয়ে বড় খাত ব্যাটারিচালিত রিকশা-অটোরিকশা এবং ইলেকট্রিক বাইক বা ইজিবাইক। বিদ্যুতের অপচয় ঠেকানোর পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষার জন্যও ব্যাটারিচালিত রিকশা-অটোরিকশা-ইজিবাইক চলাচল বন্ধ করতে হবে। এ ধরনের বাহনের মালিক-চালককে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।  না হলে এভাবে লাগাতার লোডশেডিং চলতে থাকলে জাতির সার্বিক জীবনে বড় ধরনের বিপর্যয় যে নেমে আসবে, তাতে আর সন্দেহ কী?

লেখক : সাহিত্যিক ও সাংবাদিক