যুগের পরিবর্তন হলেও আজও নারী-পুরুষভেদে এক পক্ষ হয়েছেন শাসক, অন্য পক্ষ শোষিত। পরিবার থেকে শুরু হয় নারীর প্রতি বৈষম্য-শোষণ। সেই বৈষম্য প্রতিটি ক্ষেত্রেই স্পষ্ট। তবু পরিবারে যেমন দিনের পর দিন নারী নিগৃহীত হচ্ছে, তেমনি হচ্ছে কর্মক্ষেত্রেও। নারীর অধিকার সম্পর্কে মুখ ফুটে বলার যেন কেউ নেই।
নারীর এই হীন দশা চোখে পড়ছে আরও স্পষ্টভাবে সাফজয়ী নারী চ্যাম্পিয়নদের বিজয় শেষে দেশে ফেরার পর। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় তাদের মতো সাহসী, দুর্নিবার, অপ্রতিরোধ্য নারীরাও জিম্মি। দুবেলা যাদের নুন আনতে পানতা ফুরায়, সেই নারী খেলোয়াড়দের জীবনকে অনেকটাই পঙ্গু করে দিয়েছে এরূপ বৈষম্য। কিন্তু তাদের অপরিসীম মনোবল অর্থনৈতিকভাবে ধস্ত করলেও মানসিকভাবে তারা শক্তিশালী। ফলে বিজয় ছিনিয়ে আনতে কোনো কিছুই তাদের জীবনকে স্থবির করতে পারেনি। কিন্তু ক্রীড়াঙ্গনে নারীদের প্রতি এরূপ বৈষম্য কেন?
একটি সচেতন মহল ক্রীড়াঙ্গনে নারী ফুটবলারদের প্রতি বৈষম্যকে দেশবাসীর সামনে এনেছেন। প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন ক্রীড়াঙ্গনে ঘটে চলা নারীর প্রতি বৈষম্যের ওপর। একই সঙ্গে গণমাধ্যমেও উঠে এসেছে নারী ফুটবলারদের প্রতি বৈষম্যের পরিসংখ্যান। পুরুষ খেলোয়াড়দের যেখানে বাড়ি, গাড়ি পর্যন্ত শুধু উপঢৌকন মেলে, সেখানে নারী খেলোয়াড়রা পেটের ভাতটুকুও ঠিকমতো জুটাতে পারেন না।
‘নারী ও পুরুষ খেলোয়াড়দের বেতনবৈষম্য’ শিরোনামের ওই ইনফোগ্রাফে নারী ও পুরুষ ক্রিকেটারদের পাশাপাশি ফুটবলারদের আয়ের একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে ‘এ’ শ্রেণিভুক্ত নারী ফুটবলারদের মাসিক বেতন ১০ হাজার টাকা। ‘বি’ শ্রেণিভুক্তদের আট হাজার টাকা এবং ‘সি’ শ্রেণিভুক্ত নারী ফুটবলাররা বেতন পান ৬ হাজার টাকা।
এখানে পুরুষ ফুটবলারদের বেতনের তথ্য অবশ্য উল্লেখ করা হয়নি। তবে এতে বলা হয়েছে ক্লাব পর্যায়ে শীর্ষ পর্যায়ের একজন পুরুষ ফুটবলারদের বার্ষিক আয় ৫০-৬০ লাখ টাকা। সেখানে নারী ফুটবলাররা সর্বোচ্চ ৩-৪ লাখ টাকা আয় করেন। দেশের নারী ফুটবলাররা ২০১৯ সাল থেকে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফ) বেতন কাঠামোর আওতাভুক্ত হন। বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে সাবিনা-কৃষ্ণা-মারিয়াসহ ৩৬ ফুটবলারকে বেতনের আওতায় নিয়ে আসে সংস্থাটি। নারী খেলোয়াড়দের এই বেতন খুব বেশি না হলেও জাতীয় দলের পুরুষ খেলোয়াড়েরা এখন পর্যন্ত কোনো বেতন কাঠামোর আওতায় আসেনি বলে জানা যায়। তবে ক্লাব পর্যায়ে তাদের বেতন আকাশচুম্বী। যেটা নারীদের জন্য বরাদ্দ নয়।
নারী খেলোয়াড়রা বাফুফের বেতনভুক্ত হলেও ক্লাব পর্যায়ে অনেক কম পারিশ্রমিক পান সাবিনা-কৃষ্ণারা। তারা পান সর্বোচ্চ ৩-৪ লাখ টাকা। অথচ তপু-জামালরা অর্ধকোটির ওপরে আয় করেন। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে নারী-পুরুষের এমন বেতন বৈষম্য, সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করার দায় কর্তৃপক্ষের। যদিও কর্তৃপক্ষ এই দায়কে গায়ে না নিয়ে বরং ফান্ড নেই বলে গা বাঁচিয়েছে। কিন্তু পুরুষ খেলোয়াড়দের জন্য যদি মাসে মাসে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা যায়, সেই একই ক্ষেত্রে নারীদের ক্ষেত্রে কেন এত সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে?
নারী খেলোয়াড়দের প্রতি বৈষম্যের জন্য মূলত কয়েকটি বিষয় বিশেষভাবে দায়ী।
প্রথমত, পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা, দ্বিতীয়ত, নারীর প্রতি বিশ্বাস বা আস্থাহীনতা, তৃতীয়ত, ধর্মীয় গোঁড়ামি, চতুর্থত, কর্তৃপক্ষের গাফিলতি, পঞ্চমত, বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো নারীদের জন্য বিনিয়োগে অনীহা, ষষ্ঠত, সরকারি উদ্যোগের অভাব। আধুনিকতার বাতাবরণে নিজেদের আবদ্ধ করলেও দেশের বেশির ভাগ মানুষ এখনো পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতাকে লালন করেন। ফলে নারীদের যে সমাজ, রাষ্ট্র থেকে কিছু পাওয়ার আছে, সে বিষয়ে সবাই উদাসীন। এমনকি নারীরা তাদের দক্ষতা, যোগ্যতাকে কাজে লাগিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হলেও টেনেহিঁচড়ে তাদের নিচে নামানোর পাঁয়তারা করেই চলছে পুরুষতন্ত্র। যারা নারীদের যোগ্যতা-দক্ষতাকেই আজও সম্মান করতে পারেনি; সেই সমাজ, রাষ্ট্রের কাছ থেকে নারীর প্রতি সম-অধিকার আশা করা অনেকটাই দিবাস্বপ্নের মতো। দিনের পর দিন নারীরা পরিবার থেকে খেলার মাঠ সবর্ত্রই বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। আর সেই বৈষম্যকে দূর করতে জাতিকে জাগতে হবে।
নতুনভাবে নারীদের ভাবার সময় এসেছে। খেলার মাঠে যেমন সাফ চ্যাম্পিয়ান নারীরা সব অপশক্তিকে পায়ে পিষে তাদের বিজয় ছিনিয়ে এনেছে, এ ক্ষেত্রেও নারী খেলোয়াড়দের পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। খেলার মাঠের যেই অমিত তেজোদ্দীপ্ত শক্তি দিয়ে তারা বিজয় ছিনিয়ে এনেছে, ঠিক ততটাই প্রবলভাবে তাদের প্রতি পুরুষতন্ত্রের বৈষম্যকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে হবে। আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে নিজেদের অধিকারের পক্ষেও সোচ্চার হওয়া নারী খেলোয়াড়দের জন্য এখন সময়ের দাবি। তাই পুরুষতন্ত্রের শিকারে পরিণত না হয়ে ক্রীড়াঙ্গনে নারী-পুরুষের সমতাকে প্রাধান্য দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার নারীদেরই তাদের অধিকার নিয়ে কথা বলতে হবে। কোনোরকম আপস না করে বা ভীত না হয়ে নিজেদের জন্য সুস্থ, সুন্দর পরিবেশ গঠন করার প্রত্যয় গ্রহণ করতে হবে।
ক্রীড়াঙ্গনে নারী খেলোয়াড়দের বৈষম্য মূলত বেতন বৈষম্য, সুযোগ-সুবিধার বৈষম্য। তবে এই বৈষম্য কিন্তু নতুন কোনো ঘটনা নয়। বরং নারীদের সব ক্ষেত্রেই এরূপ পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই জীবন পার করতে হয়। কিন্তু ক্ষেত্র বিশেষে কোথাও নারী ব্যাপক আকারে বৈষম্যের শিকার হয়, কোথাও কম। তবে নারী খেলোয়াড়দের ক্ষেত্রে এ বৈষম্য আকাশ-পাতাল। কারণ, পুরুষ খেলোয়াড়েরা যেখানে ৫০-৬০ লাখ টাকা পাচ্ছে, সেখানে নারীদের বার্ষিক ৩-৪ লাখ টাকা আসছে। এর পেছনে কিছু বিষয় সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। তার মধ্যে অন্যতম নারীদের যোগ্যতার আস্থাহীনতা-অবজ্ঞা। পুরুষ খেলোয়াড়দের দিয়ে যেখানে ইনভেস্ট করাতে কর্তৃপক্ষ বা প্রতিষ্ঠান কার্পণ্য করছে না, সেখানে নারীর ক্ষেত্রে ফান্ড সমস্যা!
নারীর যোগ্যতার প্রতি বিশ্বাস বা আস্থা না থাকার কারণেই এ ধরনের বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে। তবে আশার বিষয় এই যে ইতোমধ্যে নারী ফুটবল দল সাফ চ্যাম্পিয়নে জয়ী হয়ে দেশে ফিরেছে। ফলে সংগঠন, ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান নতুনভাবে ভাবনার জগৎ উন্মুক্ত করুক। নারীদের যোগ্যতা-দক্ষতাকে সম্মান করতে শিখুক এবং নারী খেলোয়াড়দের বেতন বৈষম্য, সুযোগ-সুবিধার সুষম বণ্টনের ব্যবস্থা করুক।
নারী খেলোয়াড়দের সঙ্গে এমন বৈষম্যের নেপথ্যে সর্বোচ্চ ক্রিয়াশীল অপশক্তি ধর্মীয় গোঁড়ামি। ধর্মের অসংলগ্ন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে পুরুষতন্ত্র সর্বদাই চায় নারীকে অবরুদ্ধ করতে। নারীর পায়ে শিকল পরিয়ে তাকে ঘরে বন্দি রাখতে। সে দৃশ্য যে খুব একটা ভুল, তা নয়। বরং এর প্রমাণ ধর্মান্ধদের আবরণে যারা ভণ্ডামির চর্চা করেন, তারা দিয়েছেন।
যখন গোটা বিশ্ব সাফ চ্যাম্পিয়নে নারীদের বিজয়কে সাধুবাদ জানিয়েছেন ঠিক তখনই একদল ব্যানার পোস্টার নিয়ে নারীর খেলাকে রুখে দেওয়ার পক্ষে মাঠে নেমেছেন। ইসলামিক রাষ্ট্রের দোহাই দিয়ে এই শ্রেণি নারীকে অবরুদ্ধ করে ঘরে বন্দি রাখতে চায়। ফলে নারী খেলোয়াড়রা ক্রীড়াঙ্গনে এতটা বৈষম্যের শিকার।
কারণ, যে দেশের নাগরিক নারীদের উন্নতিকে থমকে দিতে চায়, সেখানে বেতন কাঠামো তো বেশ জোর তাগিদের কথা! বিষয়টা অনেকটাই এমন যে নারীরা ঘরের বাইরে খেলতে পারছে এই কত, তাদের আবার সুযোগ-সুবিধা, বেতন-ভাতা! তবে ধর্মীয় গোঁড়ামিকে রুখে দিয়ে যদি এই নারীরা বিজয় ছিনিয়ে আনতে পারে তবে নারীরা সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নেওয়ারও সামর্থ্য রাখেন। তবে নারীদের আরও সংগঠিত হতে হবে এসব অপশক্তি দূরে হটিয়ে নিজেদের যোগ্যতাকে বিশ্বের বুকে তুলে ধরার।
তবে কর্তৃপক্ষ যদি ক্রীড়াঙ্গনে নারীদের বৈষম্যকে আমলে নেন তবে নারীদের প্রতি হওয়া অন্যায় ধ্বংস হবে। তার জন্য কর্তৃপক্ষকে নারীদের যোগ্যতা-দক্ষতার প্রতি আস্থা রাখতে হবে। নারীদের পুরুষদের থেকে আলাদা করে না দেখে নারীরাও মানুষ এই বিষয়টি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতে হবে। বরং পুরুষদের চেয়ে যে নারীরা কোনো অংশেই কম নয়, সেটা তারা তাদের অর্জনের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়েছেন। ফলে কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি প্রয়োজন এবং সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে এসব নারীকে আরও উন্নত প্রশিক্ষণ, খাদ্য, বাসস্থান, বেতনের ব্যবস্থা করতে হবে। তবেই এই নারীরা আরও দ্বিগুণ শক্তিতে নিজেদের আত্মনিয়োগ করতে পারবেন।
মাথার ওপর যখন নিরাপদ ছাদ থাকবে, খাবার জন্য যেমন খাদ্য থাকবে, বাবা-মাকে যখন ভালো রাখতে পারবেন, তখন এমনিতেই দায়িত্বের প্রতি আরও অবনত থাকবেন। ফলে বিশ্বের দরবারে সুনাম অর্জনের জন্য, দেশের জন্য কল্যাণ বয়ে আনতে নারীদের প্রতি বৈষম্য দূর করতে হবে।
এ কাজে বিশেষভাবে সহযোগিতা করতে পারে নানা প্রকার বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান। এত দিন যাবৎ তাদের অনীহা নারী খেলোয়াড়দের নানা রকমভাবে বৈষম্যের শিকার করেছে। পুরুষ খেলোয়াড়দের পেছনে এত এত বাজেট থাকলেও নারীদের জন্য এসব প্রতিষ্ঠান থেকে ফান্ডের ব্যবস্থা করে না বা তারা স্পন্সর হন না। কর্তৃপক্ষেরও উচিত নতুনভাবে নারী খেলোয়াড়দের উন্নয়নের কথা ভাবার। তার জন্য বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
সর্বোপরি সরকারি উদ্যোগ এই সমস্যার সমাধান করতে পারে। তার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বাজেটের একটি অংশ নারী খেলোয়াড়দের উন্নয়নকল্পে রাখতে হবে। তাদের বেতন কাঠামোর প্রতি নজর দিতে হবে। সরকারি উদ্যোগ, ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ, সৎ ইচ্ছাই পারে নারীদের প্রতি ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করতে।
নারী খেলোয়াড়দের প্রতি এরূপ বৈষম্য দূরীকরণে সমাজ, রাষ্ট্রকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তবেই ক্রীড়াঙ্গনে নারীরা পাবেন সুস্থ, সুন্দর, নিশ্চিতে গড়ে ওঠার পরিবেশ।
লেখক : গবেষক ও শিক্ষক।