তারুণ্যের দুর্গাপূজা

প্রবীর বিকাশ সরকার প্রকাশিত: অক্টোবর ১, ২০২২, ০৬:১৯ পিএম

আমার জীবনে দুর্গাপূজার স্মৃতি সবচেয়ে উজ্জ্বল। তখন আমি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্র। ১৯৭৭-৭৮ সালের কথা। ’৭৫ সালের আমূল রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দুর্গাপূজা ও সরস্বতী পূজার যে রমরমা-মুখর-উৎসব-উৎসব আমেজ ছিল সেটা তখনও হারিয়ে যায়নি। পূর্ণ আমেজই ছিল। পূজার সংখ্যা কি হ্রাস পেয়েছিল? সঠিক মনে নেই। আনন্দ-ফূর্তিও ছিল হিন্দু-মুসলিম সকলের মনেও। কোথাও পূজার আগে বা পূজার সময় দেবদেবীর মূর্তি ভাঙ্গার সংবাদ চোখে পড়েছিল বলে স্মরণ করতে পারি না। তখন, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সাম্প্রদায়িক চেতনাটা অনুজ্জ্বলই ছিল বলা যায়। কাজেই দুর্গা ও সরস্বতী পূজায় আমরা প্রাণ খুলে প্রচুর আনন্দ-হৈ-হল্লা করতে পেরেছি।

আমার এখনো স্মরণে আছে, কুমিল্লা শহরের প্রতিটি পাড়াতেই তখন চোখে পড়ার মতো অনেক হিন্দু পরিবার ছিল। হিন্দু অধ্যুষিত পাড়াগুলো সকাল-সন্ধ্যা মুখর ছিল কলহাস্যে। সঙ্গীতের সুর ভেসে বেড়াত বাতাসে, উলু এবং ঘণ্টাধ্বনি শোনা যেত। কানে এসে বাজত সকালবেলা পবিত্র চণ্ডিপাঠের সুরেলা নারীকণ্ঠ। সন্ধেবেলায় সুগন্ধী ধূপধুনোর কুণ্ডুলি-পাকানো ধোঁয়ায় মন কেমন করত অদ্ভুত একটা ভালোলাগায়। পাড়ার একটু ভেতরে গেলেই ছোট্ট-ছোট্ট মন্দিরের প্রাঙ্গণে শনিপূজার প্রসাদ বিতরণ করা হতো, ধুলোয় লুটোপুটি খেত শিশুরা। বাংলার আবহমান সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল ভালোভাবেই বিরাজমান ছিল। কিন্তু সেই পরিবেশটা ক্রমশ বদলে যেতে থাকে সামরিক স্বৈরশাসক এরশাদের আমলে এসে। সাম্প্রদায়িকতাও ক্রমে ক্রমে জেগে উঠতে থাকে এই সময় থেকেই।

সত্তর-আশির মাঝামাঝি সময়টায় শহরের অধিকাংশ পাড়ায় অনেক দুর্গাপূজার মণ্ডপ তৈরি হতো। পূজা চলাকালীন পাঁচটি দিন শহরটাকে চেনা যেত না, মনে হতো উৎসবের শহর! গান-বাজনা, হৈ-হুল্লোড়, পানাহার, নৃত্য-সঙ্গীতে অন্যরকম হয়ে যেত শহরটা। রাস্তায়-পথে-মোড়ে-মোড়ে মানুষের ভিড় উপচে পড়ত। গোমতী নদীর ওপার থেকে, দূরান্তের গ্রাম থেকে, সীমান্তের ওপার থেকে প্রচুর হিন্দু আবালবৃদ্ধবনিতা বা পূজারি শহরে এসে দুর্গাদেবীর প্রতিমাকে দেখার জন্য, প্রণাম জানানোর জন্য জড়ো হতো। লোকে-লোকারণ্য হয়ে যেত বিকেল থেকেই শহরটা। কোথাও কোথাও স্বল্পপরিসর মেলাও বসত। অপরাহ্ণ থেকে গভীর রাত পর্যন্ত মাইকে বাংলা ও হিন্দি জনপ্রিয় গান বাজত। মনমাতানো সেইসব গান! 

পূজার প্রথম দিন অর্থাৎ ষষ্ঠির দিন সজল-স্নিগ্ধ সকালবেলা অঞ্জলি দেবার জন্য বিভিন্ন বয়সের শিক্ষার্থীরা স্নান করে পূতপবিত্র হয়ে বইখাতা কলম শ্লেট নিয়ে হাজির হতো কালীমন্দিরগুলোতে। অধিকাংশ কালীমন্দিরেই দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হতো। আমি ও আমার বন্ধুরাও এর ব্যতিক্রম ছিলাম না।

দুর্গাপূজার মাস খানেক আগে থেকেই শারদীয় আকাশে-বাতাসে একটা আভাস টের পাওয়া যেত। কাজেকর্মে, পড়ালেখা এবং আড্ডার মধ্যে একটা গুঞ্জন উঠত, দেবী আসবেন এবার কীসে চড়ে? ঘোড়ায়? হাতি? নৌকো নাকি দোলায়? এই নিয়ে একটা জল্পনা-কল্পনা হতো সদ্য তারুণ্যে উত্তীর্ণ আমাদের মধ্যে। কে আর অত পঞ্জিকা-টঞ্জিকা খোঁজে ওই বয়সে! শ্রীশ্রীদুর্গাদেবীর আগমন মানেই মহানন্দের জোয়ার আসা। তারই দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হতে যাচ্ছে এটাই ছিল যথেষ্ট তৃপ্তিদায়ক।

মন্দিরে-মন্দিরে, ধনী হিন্দুদের বাড়িতে, কলেজে, স্কুলে বা প্রতিষ্ঠানে প্রতিমা গড়ার ধুম পড়ে যেত মাস-দেড়মাস খানেক আগে থেকেই। বাজারে নতুন নতুন ফলফসারি ওঠার লগ্ন। নতুন জামা কাপড় কেনা বা পোশাক তৈরির আনন্দে উদ্বেল সববয়সী হিন্দুরা। বিশেষ করে শিশু এবং তরুণ-তরুণীদের মধ্যে দারুণ উন্মাদনা। তাই বস্ত্রালয় এবং দর্জির দোকানে দারুণ ভীড় লেগে থাকত মাস খানেক। এপাড়া-ওপাড়ার হিন্দু নারীরা দল বেঁধে বের হতেন ঠিক সন্ধেবেলায় কান্দির পাড়ের “লিবার্টি” সিনেমা হল থেকে শুরু করে মনোহরপুর, রাজবাড়ি, রাজগঞ্জ, ছাতিপট্টি হয়ে চকবাজার পর্যন্ত নতুন-নতুন রং ও ডিজাইনের শাড়ি কেরার জন্য। সেই সময় অনেক বস্ত্রালয় ছিল এইসব জায়গায়, এবং অধিকাংশই ছিল হিন্দু ব্যবসায়ীদের। “বেঙ্গল স্টোর্স” ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয়। এখন নেই, অনেক আগেই উঠে গেছে। ছেলেবেলায় কতবার যে মায়ের হাত ধরে এই দোকানে কাপড় কেনার জন্য গিয়েছি তার হিসাব নেই! মায়ের লক্ষ্য ইন্ডিয়ান “শিফন” বা “কাতান” শাড়ি। “বালুচরি” শাড়িও আসত খুব কম, কিন্তু অত্যধিক মূল্যের কারণে তা সকলের পক্ষে হস্তগত করা সম্ভব হতো না। অবশ্য প্রকাশ্যে তো বিক্রি হতো না, লুকিয়ে-চুকিয়ে বিক্রি হতো। হিন্দু মা-বৌ-বৌদিরা সারা বছর এই মোক্ষম সময়টার জন্য অধীর প্রতীক্ষায় থাকতেন। শুধু হিন্দু নারীরাই নন, মুসলিম সম্প্রদায়ের সম্ভ্রান্ত নারীদের প্রবল আগ্রহ ছিল ভারতীয় শাড়ির প্রতি। চোরাই পথে প্রচুর ভারতীয় শাড়ি ও কাপড় আসত তখন। এমনকি, কিছু কাপড় বিক্রির ফেরিওয়ালাও বাড়িতে বাড়িতে শাড়ি বিক্রি করতেন। মাকে কিনতে দেখেছি। অবশ্য, পূজার কেনা-কাটা করার জন্য স্বচ্ছল হিন্দু পরিবারের নারীরা কলকাতায় যেতেন, শাড়ি-কাপড় কিনে আনতেন। বঙ্গনারীর অঙ্গের প্রধান বৈচিত্র্যময় ভূষণই হচ্ছে নানাবর্ণের শাড়ি, যা এই দুর্গাপূজার সময়ে পুরুষের দৃষ্টিকে ঝলসে দিত।  

অবশ্যই কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী খাদির তখন রমরমা অবস্থা। বেশকিছু খাদি কাপড়ের দোকান ছিল সেসময়। যেমন কান্দিরপাড়স্থ “খাদিঘর” একটি পুরনো দোকান। পূজার আগে এবং পূজা চলাকালীন খাদি কাপড়ের দোকানগুলোতে হামলে পড়তেন সকল সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষ। কারণ পূজা উপলক্ষে নানা রং ও ডিজাইনের পোশাক বাজারজাত করা হতো।

আমার এখনো সুস্পষ্ট মনে আছে, আমাদের তারুণ্যে রানীর বাজারস্থ রামঠাকুরের আশ্রমের কাছেই “আল্পনা টেইলার্স” নামে নতুন স্টাইল ও ডিজাইনের পোশাক তৈরির একটি ছোটখাটো প্রতিষ্ঠান ছিল। তরুণদের মধ্যে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল প্রতিষ্ঠানটি। মূল মাস্টার ছিলেন একজন তরুণ আশুতোষ নামে, যিনি পোশাক তৈরির স্বনামধন্য কারিগর খুররম শাহ্র কাছে কাজ শিখেছিলেন বলে কুমিল্লার বিশিষ্ট অলঙ্কারচিত্রী, গল্পকার ও সংগঠক ফখরুল ইসলাম রচির মাধ্যমে জানা যায়। আমরা অবশ্য আশুদা সম্বোধন করতাম। এত অর্ডার জমা পড়ত পূজার আগে যে ২৪ ঘণ্টা কাজ করেও সময়মতো ডেলিভারি দেয়া সম্ভব হতো না! একবার অনেক আবেদন-নিবেদন করার পর ছোট-ছোট বরফি আকারের রঙিন চেক-কাপড়ের একটি শার্ট তৈরির অর্ডার দিতে পেরেছিলাম। অসাধারণ ডিজাইনের একটি শার্ট তৈরি করে দিয়েছিলেন আশুদা। উঁচু কলারের দুটি কোণা ছিল গোল। তবে অভিজাত হিন্দু পুরুষরা স্টেডিয়ামের অভিজাত টেইলার ওহাব মাস্টারের প্রতিষ্ঠানের জামা-প্যান্ট ও শুট-কোটের অর্ডার দিতেন দেখেছি।  

হিন্দু-বৌদ্ধদের পূজা-পার্বন মানেই বাসা-বাড়িতে নানা রকমের মিষ্টি, মিষ্টান্ন, পিঠেপুলি, পেড়া, সন্দেশ, নাড়ু-মুড়কি-মোয়া তৈরির ধুম পড়ে যেত তখন। এখন সেই রমরমা অবস্থা নেই বলেই মনে হয়। দোকানপাটেই এখন সব পাওয়া যায়। পূজার কয়েকদিন আগে থেকেই তড়িঘড়ি ব্যস্ততা বেড়ে যেত হিন্দুবাসাবাড়িতে পূজার নৈবেদ্য তৈরির জন্য। সে কি ব্যস্ততা! গভীর রাত পর্যন্ত চাল কোটার শব্দ শোনা যেত। সেইসঙ্গে মা-বৌ-ঝিদের মৃদু কলহাস্য। কত রকমের পেড়া যে তৈরি করা হতো কাঠ ও মাটির ছাঁচে পেষা চাল, নারকেল, চালের গুঁড়ো ইত্যাদি দিয়ে। মিষ্টি কেনার ধুম পড়ে যেত মিষ্টির দোকানগুলোতে। বিশেষ করে মনোহরপুরস্থ রাজরাজেশ্বরী কালীমন্দিরের সম্মুখে অবস্থিত পুরনো পাশাপাশি তিনটি দোকান যথাক্রমে “মাতৃভাণ্ডার”, “ভগবতী পেড়া ভাণ্ডার” এবং “শীতল ভাণ্ডার” লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠত বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত।  

আমি তখন শহরের অন্যতম ছোট্টপাড়া ধর্মসাগর দিঘির পশ্চিম পাড়ের এক ভাড়াবাড়ির বাসিন্দা। আমাদের পরিবারসহ বেশ কয়েকটি হিন্দু পরিবার ছিল তখন। সেইসব পরিবারের ছেলেমেয়েরা পূজাতে কী যে আনন্দ-ফুর্তি করতাম, যার ব্যাখ্যা করা কঠিন! নানা রকম প্রসাদ, ফলফসারি আদান-প্রদানের উষ্ণমধুর সম্পর্ক ছিল আমাদের মধ্যে। মুসলিম বন্ধুরাও বাসায় আসত মা তাদেরকে আদর করে পূজার প্রসাদ, জলপানীয় দিয়ে আপ্যায়ন করত। নতুন জামা পরে পূজায় যাওয়া দল বেঁধে বিকেল থেকেই দারুণ আনন্দের ব্যাপার ছিল! ঢল নামত হিন্দুদের সন্ধের দিকে রাস্তায় পূজাদেখার জন্য।

প্রতিটি পাড়াতেই আমার হিন্দু, মুসলিম ও খ্রিস্টান ঘনিষ্ঠ বন্ধু বা সহপাঠী ছিল। পূজার সময় তাদের সঙ্গে আমরা মিলিত হতাম, আড্ডা হতো, মেয়েদের সঙ্গে প্রসাদ নিয়ে কাড়াকাড়ি, খুনটুসি, ঠাট্টা, দুষ্টুমির ছবি এখনো মনকে উদ্বেল করে।

যখন সন্ধেবেলা আরতি হতো মণ্ডপের খোলা চত্বরে তখন আর আমাদের মতো যুবা বা তরুণদের হুঁশ থাকত না। শক্তি ঔষধালয়, সাধনা ঔষধালয় দোকানে মৃতসঞ্জীবনী, নাদের ট্রেডার্সে বাংলা মদ, রাম, কেরুর জিন এবং পুরনো গোমতী নদীপাড়ের গর্জনখোলার সস্তা চোলাই কেনার জন্য লাইন দিতেন অগ্রজরা। আমরা যাব কোথায়? আমার সঙ্গে খুব বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল একই পাড়ার প্রতিবেশী বড়দা শতদল রায় সরকারের সঙ্গে। তিনি কুমিল্লার একজন বিখ্যাত ক্রিকেটার। তাঁকে অনুরোধ করে আমরা কিনিয়ে আনতাম। পৌর উদ্যানের অন্ধকার নির্জন কোণে লুকিয়ে চলত আমাদের গোপন পানাহার আর ডোপিং। এরপর তো কুচ পরোয়া নেই! এক-একজন রাজা-সম্রাট-মন্ত্রী হয়ে পূজা মণ্ডপে হাজির হতাম। পূজার আনন্দ বলে কথা! বড়রা দেখেও কিছু বলতেন না, কারণ আমরা তো আর শিশু-কিশোর নই! রীতিমতো কলেজে পড়ছি। কলেজে শিক্ষাগ্রহণ মানেই সমাজের সচেতন, ভদ্র ও আধুনিকমনস্ক একটি অংশ বা প্রতিনিধি। আমরা কি খারাপ কাজ করতে পারি!

আমাদের পূজার আড্ডা ও আরতির উদ্দাম নৃত্য জমে উঠত চার-পাঁচটি মণ্ডপে। মনোহারপুরে অবস্থিত রাজরাজেশ্বরী কালীমন্দির, লিবার্টি হলের ম্যানেজার বাদলবাবু এবং বাবলাদা’দের যৌথ পূজামণ্ডপ যাকে বলা হতো কলেজ রোডের পূজা, নজরুল এভিনিউর ক্যাতায়নী কালীমন্দির, চকবাজারের কালীমন্দিরেচকবাজারের একটা সুবিধে ছিল চোলাই কিনতে অসুবিধে হতো না স্থানীয় বন্ধুরা ব্যবস্থা করত। আর জমত দারুণ আড্ডা ও নাচ তালপুকুর পাড়ের পূজায়। এই পূজার আয়োজক বিখ্যাত ব্রাহ্ম পরিবারের কর্ণধার সিংহ পরিবার। এই পরিবারের ছেলে উজ্জ্বলকুমার সিংহ দোলন ছিল আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাদের পাশের বাড়িটি তারই বেয়াই নন্দদের। কাজেই পূজার প্রতিদিনই একবার হলেও ঢু দেয়া ছিল রীতি। কী জমজমাট সময়টা যে আমরা উপভোগ করতাম তা ব্যাখ্যার অতীত!

আজও মনে আছে, বাজনার তালে তালে সে কি উন্মাতাল নাচ আমাদের! বিশেষ করে বিজয়া দশমির দিন। সেদিন আরতির নাচের সময় জামা-গেঞ্জি ছিঁড়ে যেত, জুতো ছিঁড়ে যেত, ঘামে জবজবে হয়ে উঠত সর্বশরীর! হুঁশ নেই কারো! নেচেই চলেছি! কত ভঙ্গিমার যে নাচ আমরা করতাম! নাচে হিন্দি ছবির প্রভাব যেমন ছিল, ছিল টিভিতে দেখা “স্যাটার ডে নাইট ফিবারে”র ডিসকো ড্যান্সগুলোর প্রভাবও। নাচতে না জানার কারণে কারো-কারো কোমরের বেতাল দোলা বা আদিরসময় অঙ্গভঙ্গি দেখে মেয়েদের সে কি হাসি! এ ওর গায়ে ঢলে পড়ে! মাতাল বন্ধুদের মধ্যে কেউ কেউ উড়াল-চুমুও ছুঁড়ে দিচ্ছে! সেই নিয়ে আবার তীর্যক হাসাহাসি! সুচিত্রা সেন, অপর্ণা সেন, অজন্তা ভৌমিক, মিঠু মুখার্জী, ববিতার মতো অসম্ভব সুন্দরী কত মেয়ে যে এই শহরে ছিল, যাদেরকে এই দুর্গাপূজার সময়েই একমাত্র দেখা যেত বিভিন্ন বস্ত্রালয়, মিষ্টির দোকান আর পূজামণ্ডপগুলোতে। দুর্গা-লক্ষ্মী-সরস্বতীদেবী আর উদ্ভিন্ন যৌবনাদের সৌন্দর্য মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত আমাদের তারুণ্যের রঙিন দৃষ্টিতে। পূজার সময় কোনো-কোনো সুন্দরীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি তা নয়। কুঁড়িসর্বস্ব প্রেম ফোটার আর অবকাশ পায়নি এরপর কখনো, প্রথম দর্শনেই শেষ। আবার অন্যদিকে, দুর্গাপূজা ছিল সেই সময় কিশোর-কিশোরী এবং যুবক-যুবতীর বিপরীত আকর্ষণের শুভদৃষ্টির সোনালি যোগসূত্রেরও অনুঘটন! পরবর্তীকালে শুভপরিণয় পর্যন্ত সম্পর্ক গড়িয়েছে। পরিবারের কড়াকড়িকে এড়িয়ে নির্ভয়ে সাক্ষাৎ করার দারুণ সুযোগ ছিল এই দুর্গাপূজার সময়টায়। বনেদী পরিবারের প্রাচীন দালানের নির্জন ছাদে অনুজ্জ্বল জ্যোৎস্নায় মন দেয়ানেয়া আর মধুময় ছোঁয়াছুঁয়ির নাতিদীর্ঘ সুবর্ণ-স্বপ্নীল-সময়ের স্মৃতি আজও জাগিয়ে তোলে শান্ত হৃদয়কে মনের অজান্তে পূজা এলেই। দুর্গাপূজার স্মৃতি তাই এই জীবনে অনন্য, অমূল্য।

দুর্গাপূজার চরম আনন্দ এবং বিষাদের দিন ছিল দশমী। যাকে বলা হয় বিজয়া দশমী। মনটা অস্থিরতায় ভরে যেতে থাকত সন্ধেবেলা থেকেই। চোখ হতো ছলোছলো। দুগ্গাদেবী ফিরে যাবেন স্বামী শিবের আলয় কৈলাস পবর্তে। সকালবেলা প্রতিমার দিকে তাকিয়ে থাকতে গিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে যেতাম! বিষণ্ণ হতো মন। চিকন-সূক্ষ্ম কিছু নড়ে উঠত বুকের ভেতরে: অঞ্জলি দিতে এসে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ফুল হাতে অপূর্ব সুন্দরী কিশোরীটির সঙ্গেও আবার কবে দেখা হবে কে জানে! হয়ত আর দেখা হবেই না! দুর্গাপূজা এমন বিষণ্ণতারও জন্মদাত্রী।  

কলেজ প্রাঙ্গণসংলগ্ন রানীর দিঘিতে প্রতিমা বিসর্জন দিয়ে ভেজা কাপড়ে বাসায় ফেরার পথে ধর্মসাগর দিঘির পশ্চিম পাড়ে এসে বেঞ্চিতে গা এলিয়ে দিতাম আমরা বন্ধুরা। ক্লান্ত মাথার ভেতরে তখন উড়ে উড়ে ঘুরছে নেশালু প্রজাপতির ঝাঁক। হঠাৎ হিমহিম বাতাসে শিউলী ফুলের তীব্র গন্ধে এলোমেলো হয়ে যাওয়া মনটা কেবলি শূন্যতায় ভরে যেত। নিস্তব্ধ গভীর রাতের পৃথিবী। কোথাও কোনো শব্দ নেই। অথচ কিছুক্ষণ আগেও তুমুল গান, ঢাকঢোলের বাজনা, হৈ-হুল্লোড়ের আওয়াজে সমস্ত শহরটা গমগম করছিল! এখন শান্ত, স্তব্ধ, নিথর। যেন কোনো উৎসব, কোনো অনুষ্ঠানই ছিল না এই শহরে কোনোদিন, কোনো কালে!

মনের মধ্যে একটা অনির্বচনীয় রেশ রয়ে যেত। গভীর রাতে মাইকে হঠাৎ থেমে যাওয়া গানটা বুকের ভেতরে যেন বেজে উঠত: 
“আকাশ অজানা তবু 
খাঁচা ভেঙে উড়ে যায় পাখি
খোলা জানালার ফাঁকটুকু দিয়ে এজীবন
উড়ে যাবে নাকি!”......

 

লেখক : শিশুসাহিত্যিক, কথাসাহিত্যিক ও গবেষক