ইডেন মহিলা কলেজ ছাত্রলীগ নেত্রীদের কীর্তিকলাপে আমরা হতবাক হয়েছি। চাঁদাবাজি, আসন-বাণিজ্য এবং ব্ল্যাকমেলিংয়ের মাধ্যমে ছাত্রীদের অনৈতিক কাজে বাধ্য করার অভিযোগ উঠেছে সংগঠনটির শীর্ষ পর্যায়ের নেত্রীদের বিরুদ্ধে। অভিযোগ ওঠার পর অভিযোগকারী শারীরিকভাবে নিগৃহীত হয়েছেন, তার অশালীন ছবি মোবাইলে ধারণ করে সেটা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকির অভিযোগ উঠেছে। কলেজ ছাত্রলীগের বিবদমান দুই পক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়েছে। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ বেশ কজনকে বহিষ্কার করেছে, বহিষ্কারাদেশের পর বহিষ্কৃতরা অনশনে বসতে গিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের আশ্বাসে ফিরেছেন, তবে তাদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার হয়নি। এই সময়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ কলেজ শাখার কমিটি স্থগিত করেছে, কর্তৃপক্ষ হল ও কলেজ বন্ধ ঘোষণা করেছে।
হল বন্ধ, কলেজ বন্ধ, কমিটি স্থগিত, কয়েকজন বহিষ্কার—এই কি তবে বিচার? এখন পর্যন্ত কিন্তু এটাই বিচার! মারামারিতে যুক্ত ছিল সভাপতি তামান্না জেসমিন রীভা ও সাধারণ সম্পাদক রাজিয়া সুলতানা পক্ষ এবং সহসভাপতি জান্নাতুল ফেরদৌসসহ ২৫ নেত্রীর পক্ষ, কিন্তু কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ ইডেন শাখার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের পক্ষের পক্ষ নিয়ে অন্যদের বহিষ্কার করেছে। এবং সেই বহিষ্কারাদেশ বহাল রেখে কলেজ ছাত্রলীগের কমিটিই স্থগিত করেছে কেন্দ্রীয় কমিটি।
ইডেন মহিলা কলেজ ছাত্রলীগের একটা পক্ষ যে অভিযোগ করেছিল, সে অভিযোগগুলো আমলে নেয়নি কেন্দ্রীয় কমিটি। তাদের পক্ষ থেকে একটা তদন্ত কমিটি গঠনের কথা জানানো হয়েছিল, সেই কমিটির এক সদস্য আবার নিজের নাম প্রত্যাহার করেও নিয়েছিলেন। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের আগেই কেন্দ্রীয় কমিটির ওখানে হস্তক্ষেপ করলেও সেটা ছিল একপেশে। যদিও গণমাধ্যম সূত্রে সবার জানা হয়ে আছে ছাত্রলীগ নেত্রী তামান্না জেসমিন রীভার নানা কাণ্ড। গত মাসেই সামাজিক মাধ্যমে ফাঁস হওয়া এক অডিওতে রীভাকে বলতে শোনা যায়, ‘বেশি চ্যাটাং চ্যাটাং করতেছিস। এক পায়ে পাড়া দিমু, আরেক পা টাইনা ধইরা ছিঁড়া ফেলমু।...কে কে টাকা জমা দিছিস? আমারে দিছিস? আমি যদি একটা সিট না দিই, তোদের কোন বাপ সিট দেবে? ম্যাডামরা (হল প্রশাসন) দেবে? ক্ষমতা আছে ম্যাডামদের? কে কে টাকা জমা দিছিস? আমারে দিছিস?’ ওই অডিও ফাঁসের পরেও থামেননি তিনি, হলের দুই ছাত্রীকে মানসিক নির্যাতনের পর তাদের বিবস্ত্র করে সেই ভিডিও অনলাইনে ভাইরাল করারও হুমকি দেন। রীভার এই হুমকিতে প্রমাণ হয় তারা যে হলের ছাত্রীদের জিম্মি করে থাকেন, চাঁদাবাজি করে থাকেন, এবং চাঁদাবাজি ও জিম্মিত্ব টিকিয়ে রাখতে বিবস্ত্র করতেও পারেন।
সাম্প্রতিক যে লঙ্কাকাণ্ড, সেখানেও আছে অনৈতিক কাজে বাধ্য করার মতো অভিযোগ। অভিযোগকারী এক নেত্রীকে মারধরের পর তার অশ্লীল ভিডিও ধারণের অভিযোগ এসেছে। ইডেন ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সামিয়া আক্তার বৈশাখী বলেছেন, ‘সুন্দরী মেয়েদের রুমে ডেকে নিয়ে জোর করে আপত্তিকর ছবি তুলে রাখা হয়। পরবর্তী সময়ে সেগুলো ব্যবহার করে জোরপূর্বক অনৈতিক কাজ করতে তাদের বাধ্য করা হয়।’ অভিযোগটি গুরুতর বলার অপেক্ষা রাখে না। ছাত্রলীগ নেত্রীর এই অভিযোগের পর ইডেন মহিলা কলেজের ছাত্রীদের পাশাপাশি অভিভাবকদেরও উদ্বিগ্ন করেছে। শিক্ষাঙ্গনে যেখানে শিক্ষার জন্য যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা, সেখানে ছাত্রলীগ নেত্রীদের এমন কর্মকাণ্ডে সেখানে কি শিক্ষার পরিবেশ থাকছে? সেখানে ন্যূনতম স্বাধীনতা থাকছে শিক্ষার্থীদের?
বিবদমান দুই পক্ষের এক পক্ষের এমন অভিযোগকে অভিযোগ হিসেবেই দেখা যেত, যদি না ইডেন ছাত্রলীগ সভাপতি রীভার আগের হুমকির অডিও ফাঁস না হতো। তার সেই অডিও বলছে এখন যে অভিযোগ এসেছে, সেটা আর যা-ই হোক সর্বাংশে অসত্য নয়। এখানে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে পারত, কলেজ প্রশাসন গুরুত্ব দিতে পারত, ছাত্রলীগের অভিভাবক সংগঠন বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে পারত; কিন্তু সেটা হয়নি। এত বড় অভিযোগ এবং ঐতিহ্যবাহী একটা শিক্ষাঙ্গনের শিক্ষার পরিবেশ নিয়ে যে অভিযোগ, সেটাকে কেউ গুরুত্ব দেয়নি। ফলে পুরো দেশের কাছে ইডেন মহিলা কলেজের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। নারীশিক্ষার বিশেষায়িত এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কলঙ্কিত হয়েছে।
এমনিতেই দেশের একটা শ্রেণির লোকজন নারীশিক্ষা ও নারী অগ্রগতির বাধা হয়ে আছে। প্রগতির সবকিছুতেই আপত্তি যাদের, সেই নারীবিদ্বেষী শক্তির কাছে ইডেন কলেজ ছাত্রলীগ নেত্রীদের এমন কর্মকাণ্ড জ্বালানি জোগান হয়েছে। ছাত্ররাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন, আদর্শের অভাব এবং পদ পেয়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠার এই পরিণতি কেবল ছাত্রলীগকেই কেবল নয়, বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির ঐতিহ্যকেই কলঙ্কিত করেছে।
ইডেন কলেজ, অন্য যেকোনো শাখা ছাত্রলীগের কমিটি কাউন্সিলের মাধ্যমে হয় না, সারা দেশের ছাত্রলীগের কমিটিগুলোর জন্ম হয় প্রেস রিলিজে; কেন্দ্রীয় কমিটিও একইভাবে। ঐতিহ্যবাহী এই সংগঠনের মধ্যে একদিকে নেই যেমন গণতন্ত্রের চর্চা, অন্যদিকে আছে পদ-বাণিজ্যের অভিযোগ। এসব অভিযোগ সংগঠন-পর্যায়েই কেবল সীমাবদ্ধ নয়, সবাই জানে; আওয়ামী লীগও জানে। নেই জবাবদিহি। জবাবদিহির প্রয়োজনও মনে করে না কেউ। কেউ কারও কাছে দায়বদ্ধও নয়। বেপরোয়া সব পর্যায়ে। এতে করে ইডেন মহিলা কলেজের মতো একটা ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ নারীশিক্ষায় সম্পৃক্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গায়ে কলঙ্ক তিলক পরানোর সব আয়োজন সম্পন্ন হলেও কেউ কথা বলছে না। না ইডেন কলেজ, না অন্য যেকোনো কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, না সরকার, না আওয়ামী লীগ।
ছাত্রলীগ ডুবিয়েছে ইডেন কলেজকে, ছাত্রলীগ ডুবিয়েছে নারীশিক্ষায় সম্পৃক্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে, ছাত্রলীগ ডুবিয়েছে ছাত্রলীগের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে, ছাত্রলীগ ডোবাচ্ছে আওয়ামী লীগকে। টের পেলেও কেউ কিছু বলছে না, কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এতে নারী অগ্রযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে, বাইরে রেখে সন্তানদের লেখাপড়ায় আগ্রহ হারাবে অভিভাবক। এই ক্ষতি বিশাল হতে পারে, এই ক্ষতি ভয়ানক হতে পারে আমাদের সামগ্রিক অগ্রযাত্রায়।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক