পাখির পছন্দ কোনটা? খাঁচায় বন্দি থাকা, নাকি মুক্ত হওয়া? আমি নিশ্চিত, এই প্রশ্নের উত্তরে আপনারা প্রায় সবাই বলবেন যে, কে চাইবে খাঁচায় বন্দি হয়ে থাকতে? পাখি নিশ্চয়ই চাইবে মুক্ত আকাশে বন্ধনহীন হয়ে স্বাধীনভাবে উড়তে। বাস্তবে কিন্তু সবসময় এটা সত্যি হয় না। অনেক মানুষই তাদের পোষা পাখিকে খাঁচা থেকে একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য মুক্ত করে দেয়। পাখি খাঁচার বাইরে একটু ঘোরাফেরা করে আবার খাঁচার মধ্যেই ফিরে আসে ঠিকঠাকভাবে। পাখা থাকার পরেও এই পাখিগুলো এমন করে কেন? কেন তারা উড়ে যায় না? পাখিরা যদি মানুষের ভাষা বুঝতো, আর তাদের যদি এই প্রশ্ন করা হতো, তারা এর উত্তরে বলতো, “কেইজ ইজ মাই চয়েস।”
খাঁচার পাখি যে উত্তর দিয়েছে, সেটা কিন্তু উড়িয়ে দেওয়ার মতো না। খাঁচা তার চয়েস বলেই সে খাঁচাতে থাকছে। নইলে খাঁচা থেকে বের করার সাথে সাথেই তো তার উড়ে যাওয়ার কথা ছিল। এখানে আমার বা আপনার বলার কিছু নেই। বলার জায়গাটা ভিন্ন সময়ের প্রেক্ষাপটে। এই খাঁচা চয়েস করা পাখিগুলো কিন্তু শুরুতে খাঁচায় ঢুকতে চাইতো না। এদেরকে বন্দি করার প্রথম দিকে খাঁচার বাইরে নেওয়ার সাহস তাদের মালিকদের হতো না। দীর্ঘদিন বন্দি থাকতে থাকতে এক সময় এরা খাঁচাকে ভালোবেসে ফেলে। খাঁচা তাদের নিরাপত্তা দেয়, খাদ্য দেয়, পানি দেয়। কখনো কখনো খেলনাও দেয় খেলাধুলো করার জন্য। খাঁচার ভিতরটা তার কাছে স্বস্তিদায়ক এক শান্তিভূমি মনে হয়। খাঁচার বাইরের পৃথিবীটা বরং এক শঙ্কাময় জগৎ। চারিদিকে বিপদের হাতছানি। নিজের খাবার নিজে জোগাড় করার পরিশ্রমও রয়েছে নিত্যদিন। রোদে ঝলসানোর ভয় আছে সেখানে, আছে বৃষ্টিতে ভেজার অনাসৃষ্টি। সেই সাথে আছে ঝড়ো হাওয়ার হুটহাট উৎপাত। কে যায় ওই অনিরাপদ ভূমিতে? এর চেয়ে খাঁচাই বরং অনেক ভালো। মাই চয়েস!!
খাঁচা যদি কারো চয়েস হয়, সেক্ষেত্রে আমাদের কিছু বলার নেই। প্রতিটা পাখিরই অধিকার আছে তার নিজের পছন্দকে বেছে নেওয়ার। এই বক্তব্য যেহেতু আমরা দিচ্ছি, কাজেই একই সঙ্গে আবার আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে অন্য পাখিদেরও। অনেক পাখিই বলবে, খাঁচা ইজ নট মাই চয়েস। এ ক্ষেত্রে তাদের পছন্দের অধিকারও আমাদের দিতে হবে। খাঁচা পছন্দ নয় বলে তাদের ধরে ধরে খাঁচায় পুরতে পারি না আমরা কিংবা পারি না তাদের পিটিয়ে হত্যা করতে। সেটা করা হলে আর পছন্দের অধিকার থাকে না। একটা পছন্দ আধিপত্য বিস্তার করে অন্য একটা পছন্দের উপরে।
হিজাববিরোধী আন্দোলনে মিনিবাসের উপরে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন ইরানি অভিনেত্রী মালিহেহ নিকজুমান্দ
পাখি থেকে মানুষে ফিরি। ১৯৭৯ সালে শাহকে উৎখাত করে ইরানে বিপ্লব সংঘটিত হয়। সেটাকে অনেকেই ইসলামি বিপ্লব হিসেবেও অভিহিত করেন। কারণ ওই বিপ্লবের পরে ধর্মাশ্রয়ী গোষ্ঠী ইরানের ক্ষমতা দখল করেছিল। এদের নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি ওই বছরই মেয়েদের ওপরে হিজাব চাপিয়ে দেন। ইরানে অনেক মেয়েই হয়তো নিজেদের ইচ্ছাতেই হিজাব পরতো। আবার একটা বড় অংশ মেয়েই হিজাব পরতো না। এই হিজাব না-পরারা সরকারের এই জবরদস্তিমূলক সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি। তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিল তারা।
এদের মধ্যে একজন হচ্ছেন মালিহেহ নিকজুমান্দ। উনি ইরানের একজন বিখ্যাত অভিনেত্রী। ১৯৭৯ সালে তাঁর বয়স ছিল ছেচল্লিশ বছর। এই অভিনেত্রী আরও অসংখ্য ইরানি নারীদের সাথে হিজাববিরোধী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাঁর দুটো ছবি এখনও সেই সময়ের সাক্ষী হিসেবে নানা পত্র-পত্রিকাতে ছাপা হয়। এর একটা ছবিতে দেখা যায়, তিনি দুই মোল্লার সাথে আঙুল উঁচিয়ে বাকবিতণ্ডা করছেন। আরেক ছবিতে দেখা যাচ্ছে, তিনি মিনিবাসের উপরে দাঁড়িয়ে হিজাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। তাঁর এই তীব্র প্রতিবাদ, ‘হিজাব ইজ নট মাই চয়েস’, এই বক্তব্য কি কাজে লেগেছিল? না, লাগেনি। মেয়েদের সেই বক্তব্যকে, প্রতিবাদকে দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছিল রাষ্ট্রীয় শক্তিতে বলিয়ান হয়ে মোল্লারা। তিনি যেহেতু ইরানেই থেকেছেন, তাঁকে হিজাব পরতেই হয়েছে।
হিজাববিরোধী আন্দোলনে দুই মোল্লার সঙ্গে আঙুল উঁচিয়ে বাকবিতণ্ডা করছেন ইরানি অভিনেত্রী মালিহেহ নিকজুমান্দ
আমি এখানে তাঁর সেই প্রতিবাদ করা দুটো ছবি আপনাদের জন্য দিলাম। একই সাথে তাঁর হিজাব পরা একটা ছবিও দিচ্ছি। এই অভিনেত্রী ২০১৬ সালে মারা গেছেন। আমি জানি না, তাঁকে যদি মৃত্যুর আগ দিয়ে হিজাবের পছন্দের বিষয়ে প্রশ্ন করা হতো, তিনি কী উত্তর দিতেন? তিনি কি বন্দি পাখির মতো খাঁচাকে ভালোবেসে ফেলেছিলেন? নাকি রিও ছবির সেই প্রতিবাদী নারী পাখি জুয়েলের মতো খাঁচা ভাঙার জন্য আজীবন মাথা ঠুকে গিয়েছেন খাঁচার তারে?
বৃদ্ধ বয়সে হিজাব পরিহিত ইরানি অভিনেত্রী মালিহেহ নিকজুমান্দ
আমরা জানি না তাঁর হিজাবময় জীবনের পছন্দ কী ছিল। তিনি কি হিজাবকে ভালোবেসে ফেলেছিলেন? নাকি, বাধ্য হয়ে পরার জন্য এটাকে ঘৃণা করেছেন তিনি সারাজীবন ধরে, অভিশাপ দিয়েছেন ধর্মরক্ষাকারী মোল্লাদের তার জীবনটাতে অনাহুতভাবে তাদের সিদ্ধান্ত জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার জন্য?
খাঁচা ইজ মাই চয়েস এই ভয়েস যতটা আমরা উদারভাবে শুনি, বা মেনে নিই, খাঁচা ইজ নট মাই চয়েস-এর ক্ষেত্রে সেই উদারতা অনেকেই দেখাতে পারে না। ধর্ম, সমাজ, মোল্লা আর ধর্মরক্ষাকারী পুলিশ, সবাই মিলে সেটাকে গলা টিপে ধরে তখন।
লেখক : প্রগতিশীল চিন্তাবিদ, সমাজ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক