কী বলবেন ওটাকে! ফেসবুক স্ট্যাটাস নাকি শুধু একটা ফুটবলীয় বিবৃতি? যেখানে এমন কিছু শব্দ আর বাক্য পাশাপাশি বসানো, যা খুব সহজ। সরল। সাধারণ। এবং একেবারে আটপৌরে! কিন্তু ওগুলো পড়লে স্বপ্নজয়ের ইচ্ছাগুলো ডানা মেলে। আবেগ হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়। চোখ ঝাপসা হয়ে যায়। দেশের মানুষের মনকে নাড়া দিয়ে যায়!
বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের সদস্য সানজিদা খাতুনের স্ট্যাটাসটা কাল সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালের আগে দিনভর মানুষের ওয়ালে ওয়ালে ভেসে বেড়িয়েছে। সন্ধ্যায় নেপালের মাটিতে নেপালকে হারিয়ে যখন চ্যাম্পিয়ন হলেন সানজিদা-সাবিনা-কৃষ্ণারা, তখন মানুষের ফেসবুক ওয়ালে অভিনন্দনের বন্যা! একটু ভুল হচ্ছে মনে হয়। বন্যা না রীতিমতো সুনামি! হিমালয়ের পাদদেশে নেপালি-কন্যাদের হারিয়ে সাফের শিরোপা জিতলেন যারা, সাফল্যের বরফগলা পানিতে তারা সিক্ত হবেন, এটা স্বাভাবিক। ওটুকু ওদের প্রাপ্য। বাঙালি সেটুকু দিতে কার্পণ্য করেনি।
ব্যর্থতার উজান ঠেলতে ঠেলতে যারা সাফল্য এনে দিলেন, তাদের জন্য অভিনন্দন। সেই বাণীগুলোকে কেন যেন পানসে মনে হচ্ছে! কারণ, মনের মধ্যে গেঁথে আছে সানজিদা খাতুনের পোস্টের সেই কথাগুলো! পাহাড়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে কী সাহসী উচ্চারণ। যেখানে আত্মবিশ্বাসের সামান্য ঘাটতি ছিল না। যেখানে প্রতিশ্রুতির কমতি ছিল না। সামাজিক আর রাষ্ট্রীয় উপেক্ষা ও অবজ্ঞার একটা প্রচ্ছন্ন জবাব দেওয়ার ইচ্ছার কথাটা তাচ্ছিলের ভরে কী অসাধারণভাবে তুলে ধরেছেন। সেই সঙ্গে যাদের কারণে তারা কাঠমান্ডুর দশরথ রঙ্গশালায় ফাইনালের মঞ্চে, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশেও কার্পণ্য ছিল না। তাই সানজিদা খাতুন লিখতে পেরেছিলেন, “যারা আমাদের এই স্বপ্নকে আলিঙ্গন করতে উৎসুক হয়ে আছেন, সেই সকল স্বপ্নসারথীদের জন্য এটা আমরা জিততে চাই।…”
তারা জিতেছেন। কথা রেখেছেন। স্বপ্নসারথিদের উল্লাস সামাজিক মাধ্যমে ধরা পড়েছে। নিরঙ্কুশ সমর্থনের প্রতিদান দিতে চেয়েছেন। ৩-১ গোলে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছেন। প্রতিদানের প্রতিশ্রুতি পূরণ করেছেন—“ছাদখোলা চ্যাম্পিয়ন বাসে ট্রফি নিয়ে না দাঁড়ালেও চলবে, সমাজের টিপ্পনীকে একপাশে রেখে যে মানুষগুলো আমাদের সবুজ ঘাস ছোঁয়াতে সাহায্য করেছেন, তাদের জন্য এটা জিততে চাই।”
যে সমাজ নারীকে চার দেয়ালে বন্দি রাখতে চায়, সেই সমাজের মুখে যা ঘষে দেওয়ার সেটাই দিয়েছেন সানজিদারা। পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজে কিছু মানুষ এখনো আছেন, যারা নারীকে মানুষ হিসেবে দেখেন। তাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দেন। সেটা সাহায্যের নয়, বরং হাত ধরাধরি করে পাশাপাশি হাঁটার জন্য। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন।
“আমাদের এই সাফল্য হয়তো আরও কিছু সাবিনা-কৃষ্ণা-মারিয়া পেতে সাহায্য করবে। অনুজদের বন্ধুর এই রাস্তাটুকু কিছুটা হলেও সহজ করে দিয়ে যেতে চাই।” নিজেদের উত্তরাধিকারদের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে কী অসাধারণ উচ্চারণ।
খালি পেটে সাফল্যের স্বপ্ন দেখা যায় না। কিন্তু এই সমাজ নারীদের ফুটবল মাঠে নামতে দিতে চায় না। সেই সমাজ থেকে এরা উঠে এসেছেন। নিজেদের সামর্থ্য আর দক্ষতার পরিচয় দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার নারী ফুটবলের শিরোপা জিতলেন, তারা কোথা থেকে উঠে এসেছেন। কীভাবে জীবনের সঙ্গে লড়াই করতে হয় তাদের। ফুটবলার হওয়ার স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখতে কত কিছুই না ত্যাগ করতে হয় তাদের। সেই হিসাব কজন রাখেন? সেই কথাগুলোও মাঠে নামার আগে বলতে ভুলে যাননি সানজিদা— “পাহাড়ের কাছাকাছি স্থানে বাড়ি আমার। পাহাড়ি ভাই-বোনদের লড়াকু মানসিকতা, গ্রামবাংলার দরিদ্র ও খেটে খাওয়া মানুষদের হার না মানা জীবনের প্রতি পরত খুব কাছাকাছি থেকে দেখা আমার।”
এই মেয়েগুলোর উঠে আসার গল্পগুলো এর চেয়ে ভালো বুনটে আর কীভাবে বলা যেত? অবশ্য তাদের এই গল্পের শুরু আছে। শেষ নেই। তাই তাকে আবার লিখতে হয়েছে, “যে দলের অনেকে এই পর্যন্ত এসেছে বাবাকে হারিয়ে, মায়ের সম্বল নিয়ে, বোনের অলংকার বিক্রি করে, অনেকে পরিবারের একমাত্র আয়ের অবলম্বন হয়ে।”
উন্নয়নশীল দেশের সরণিতে পা ফেলে আমরা ছুটছি উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছানোর স্বপ্ন নিয়ে। রঙিন সেই স্বপ্নের মাঝে কত মানুষের রংহারা ধূসর জীবনের গল্পকে আড়াল করে যাচ্ছি! সানজিদা সেই মানুষগুলোর কথাই কি বললেন না? এই সঙ্গে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে সাফল্যের জয়মন্ত্রটাও আগাম বলে দিয়েছিলেন তিনি, “ফুটবলের চরিত্রে মাঠে থাকব এমন নয়। এগারোজনের যোদ্ধাদল মাঠে লড়াই করবে।”—এবং করেছেন।
দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবল যুদ্ধে সাবিনা-সানজিদারা সফল। কিন্তু জীবনযুদ্ধে উত্তীর্ণ হতে আরও অনেক যুদ্ধ তাদের বাকি। সেই যুদ্ধে অন্যদের পাশে পাবেন কি তারা? ওরা ট্রফি হাতে তুলেছেন। কিন্তু ফাইনালের দিন যদি সানজিদার পোস্টটা চোখে না পড়ত, আমরা কজন জানতাম, সোনালি রঙের ঔজ্জ্বল্য ছড়ানো পোলিশ করা ট্রফির মতো ওদের জীবনের রং নয়। ওখানে দৌড় আছে। ধুলো আছে। ঘাম আছে। গায়ে কালিমা আছে। সমাজের রক্তচক্ষু আছে। সঙ্গে আছে জীবন থেকে যৌবন হারিয়ে যাওয়ার অবসাদ! কিন্তু সাফল্যের একটা শৃঙ্গ পেরিয়ে এসে এরাই আবার ছুটবে নতুন কোনো চ্যালেঞ্জের পেছনে। রাষ্ট্র, সরকার, সমাজ, স্পন্সর, গণমাধ্যম তাদের পাশে থাকবে! এই প্রতিশ্রুতিটা কি আমরা দিতে পারছি?