‘অসাধারণ’ শব্দটা উল্টাপাল্টা জায়গায় ব্যবহার হতে হতে এখন অনেক জায়গায় প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে। তবু এবারের এশিয়া কাপে শ্রীলঙ্কা যেভাবে চ্যাম্পিয়ন হলো, তাকে অসাধারণ এক রূপকথা বলতে হবে!
আশ্চর্য! আশ্চর্য তো! ক্রিকেট বিশ্বে যারা উদ্বাস্তুর মতো ঘুরে বেড়ান, সেই আফগানরা গ্রুপ পর্বে যেভাবে বিধ্বস্ত করেছিল লঙ্কানদের, তারপর দুবাইয়ে শ্রীলঙ্কা কাপ উঁচিয়ে ধরবে, কজন ভাবতে পেরেছিলেন! সেই স্কোরকার্ডে চোখ বুলালে, মনে হবে এই দলটা কীভাবে সুপার ফোরে পৌঁছাল! ১৯ দশমিক ৪ ওভারে ১০৫ রানে অলআউট! ১০ দশমিক ১ বল খেলে ৮ উইকেটে ম্যাচটা জিতেছিল আফগানরা। সেই শ্রীলঙ্কা শেষ পর্যন্ত চ্যাম্পিয়ন! অবিশ্বাস্য!
আবার ফাইনালে পাকিস্তানের বিপক্ষে তাদের ইনিংস যেভাবে শুরু হয়েছিল, তাতে মরুর বুকে পাকিস্তানের গতিঝড়ে উড়ে যাওয়ার কথা ছিল লঙ্কানদের কাপ-জয়ের স্বপ্ন। কমেন্ট্রি বক্সে বসে ওয়াসিম-ওয়াকার দেখছিলেন নাসিম শাহ-রইস রউফের গতি ঝড়! ঘণ্টায় ১৫০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে বল করছিলেন, তার সঙ্গে উইকেট! ইনিংসের নবম ওভার শেষ হওয়ার আগেই ৫৮ রানে ৫ উইকেট নেই। শাস্ত্রি-মাঞ্জরেকাররা বলতে শুরু করলেন লো-স্কোরিং ফাইনাল হতে যাচ্ছে। ১৪০ কিংবা ১৫০ রান হলে কতটা জমবে ফাইনাল?
অন্যরা যা-ই বলুন, ভিন্ন চিন্তা কাজ করছিল দুই লঙ্কান ব্যাটারের মনে। হাসারাঙ্গা আর রাজাপক্ষে। ষষ্ঠ উইকেটে ৩৮ বলে ৫৮ রানের দারুণ এক পার্টনারশিপ গড়লেন। এরপর সপ্তম উইকেটে আরও একটা পঞ্চাশোর্ধ্ব পার্টনারশিপ গড়লেন রাজাপক্ষে। এবং স্কোরটাকে নিয়ে গেলেন ১৭০-এ। কোনো এক বিখ্যাত রাজাপক্ষে পরিবারের জন্য শ্রীলঙ্কা অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া! তাদের রাষ্ট্রীয় লুটতরাজের প্রতিবাদে জনবিক্ষোভে উত্তাল হয়েছিল আরব সাগরের মাঝের এই দ্বীপরাষ্ট্রটি।
রোবরার রাতে সেই আরব সাগরপারে মরুর বুকে স্বপ্নের শহর দুবাইয়ে তরুণ এক রাজাপক্ষে লুটে নিলেন পাকিস্তানের স্বপ্নকে! কাপ জেতা হলো না পাকিস্তানের। আর্থিক টানাপোড়েনের কারণে যারা নিজের দেশে এশিয়া কাপ আয়োজন করতে পারেনি, সেই শ্রীলঙ্কাই চ্যাম্পিয়ন। প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে এবং লঙ্কানদের শুরুর কথা ভাবলে, সত্যিই অকল্পনীয়!
অকল্পনীয়! অবিশ্বাস্য! অসাধারণ! যেভাবেই বর্ণনা করা হোক না, এশিয়া কাপের ফাইনালে শ্রীলঙ্কার জয়কে, শুধু ‘অভূতপূর্ব’ বলা যাবে না। কারণ, এ রকমভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে লঙ্কানরা বহু ম্যাচ জিতেছে এশিয়া কাপে। পাকিস্তানের দ্বিগুণবার চ্যাম্পিয়ন তারা। ছয়-ছয়বার এশিয়া কাপজয়ী। তবে তাদের এবারের শিরোপা জয়, অন্য মাত্রা পাবে নানা কারণে। নিজের দেশে খেলতে না পারা। প্রথম ম্যাচে বিধ্বস্ত হওয়া। ফাইনালে খাদের কিনার থেকে ঘুরে দাঁড়ানো! এই ত্রিকোণের ভেতর থেকে লঙ্কানদের ক্রিকেটীয় চরিত্রের একটা দিক আবিষ্কৃত। অসম্ভব শক্তিশালী তাদের নার্ভ। নাসিম শাহ, হারিস রউফদের দুর্দান্ত স্পেলও ভাঙতে পারল না রাজাপক্ষের প্রতিরোধের দেয়াল!
আবার বল হাতে খুব বাজে শুরু করেছিলেন লঙ্কানরা। দিলশান মাধুসাঙ্কা ১১ বলের প্রথম ওভারে যেভাবে ওয়াইড-নো-আর ফ্রি হিট দিতে শুরু করলেন, তাতে দু’হাত প্রসারিত করা আর ডান হাতের তর্জনী উঁচিয়ে সিগন্যাল দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে পড়ার কথা বাংলাদেশের আম্পায়ার মাসুদুর রহমান মুকুলের। কিন্তু তিনিও দেখালেন তার নার্ভ শক্ত। ফাইনালের মতো বড় ম্যাচ পরিচালনা করার জন্য তিনি কতটা দক্ষ। কিন্তু তার চেয়ে বড় দক্ষতার পরিচয় দিলেন লঙ্কান ফিল্ডার আর বোলাররা। প্রথম ওভারের পর থেকে তাদের স্নায়ুদৌর্বল্য কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না! দারুণ কিছু ক্যাচ নিলেন। বাউন্ডারি সেভ করলেন। তাদের দৌড় লাফঝাঁপ দেখে মনে হয়েছে, ‘অপারেশন দুবাই’-এ নেমেছেন তারা। লঙ্কানদের অপারেশন দুবাইয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য পাকিস্তানিদের কাছে অস্ত্র বলতে ছিল শুধু আত্মতৃপ্তি! না হলে তারা যেভাবে ক্যাচ ফেলেছেন, বাউন্ডারিকে ওভার বাউন্ডারি বানিয়ে দিয়েছেন, না হলে লঙ্কানদের ইনিংস কি ১৭০ পর্যন্ত পৌঁছায়! ওই রান তাড়া করতে গিয়ে রীতিমতো টেনশনাক্রান্ত পাকিস্তান ব্যাটিং লাইন!
ফাইনাল মানে স্নায়ুর ঠোকাঠুকি। সেই স্নায়ুর ধারণক্ষমতা লঙ্কানদের বেশি ছিল পাকিস্তানের চেয়ে। স্নায়ুযুদ্ধে জিতে এশিয়া কাপ লঙ্কানদের। তবে শ্রীলঙ্কা ধন্যবাদ দিতে পারে আফগানিস্তান আর বাংলাদেশকে। প্রথম ম্যাচে ওভাবে হারিয়ে আফগানরাই তাতিয়ে দিয়েছে লঙ্কানদের। আর বাংলাদেশ! তাদের বিপক্ষে ম্যাচে লঙ্কানরা শিখেছিল স্নায়ু ঠিক রেখে কীভাবে ম্যাচ শেষ করতে হয়! প্রথম ম্যাচ আর ফাইনালের স্কোরকার্ড পাশাপাশি রেখে, কী বলবেন শ্রীলঙ্কার এবারের এশিয়া কাপ জয়কে?
লেখক: সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলাম লেখক