হৃদয়ের ডাক শুনেই কি মুশফিকের বিদায় বলা

অঘোর মন্ডল প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৫, ২০২২, ০৯:৫২ এএম

আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে তার ক্রিকেট সত্ত্বার ’ডেথ সার্টিফিকেট’টা তিনি নিজেই দিলেন। একটা ফেসবুক বার্তায়। এরপর তার বেশ কিছু সতীর্থের ফেসবুক ওয়ালে ওয়ালে তাকে ঘিরে আবেগ ঘন প্রতিক্রিয়া। মুশফিক ষোল বছরের আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারকে ‘বিদায়’ বলে দিলেন। তিন অক্ষরের শব্দটা ঘিরে কিছু প্রতিক্রিয়া হবে না তা কি হয়!

সব ক্রীড়াবিদ জানেন একদিন তাকে সরে দাঁড়াতে হয়। শরীর–মন বিদ্রোহ করে। ১০২টা টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলা মুশফিকও কি তার ব্যতিক্রম? তবে তিনি একটা জায়গায় ব্যতিক্রম। বিদায় বলার সময় গভীরতম আবেগ এবং ভেতরের রক্তক্ষরণ জনসমক্ষে আনলেন না। মুশফিক বাংলাদেশ ক্রিকেটে ছোট-খাটো একটা মানুষ। কিন্তু বড় ক্রিকেটার। যদিও তার ক্যারিয়ার এখন অস্তগামী। টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল মুশফিকের ২০০৬ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে জয় দিয়ে। শেষ হলো এশিয়া কাপে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হার দিয়ে। শেষ ম্যাচটা জিতলেও বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন ঝুলে থাকতো তার ক্যারিয়ারে। ব্যাটিং-কিপিং কোনোটাতেই নিজের নামের প্রতি সুবিচার করতে পারছিলেন না তিনি। জায়গা তাকে ছেড়ে দিতেই হতো। নিজেই তাই সরে দাঁড়ালেন। তাতে মুশফিক অনুরাগীদের আর বলা হলো না—যাও গো এবার যাবার আগে রাঙিয়ে দিয়ে যাও...।

না—একটু ভুল বলা হচ্ছে! আন্তর্জাতিক টি-টোয়োন্টিতে মুশফিকের ক্রিকেট সত্ত্বার প্রয়াণ ঘটলো। কিন্তু তার ওয়ানডে এবং টেস্ট ক্যারিয়ার এখনও অনিশ্চয়তার মেঘে ঢাকা পড়ে যায়নি। সেখান থেকে যদি আগেভাগে ঘোষণা দিয়ে মাঠ থেকে বিদায় নেন, তাহলে ক্রিকেট রোমান্টিকরা রবীন্দ্রনাথের সুরে কোরাস গাইতেই পারেন, যাও গো এ বার যাওয়ার আগে, রাঙিয়ে দিয়ে যাও….।

মুশফিকের বিদায়ের ঘোষণায় আবেগের মেদ ছিল না। কিন্তু পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় কোথায় যেন অন্ধ আবেগ ছুঁয়ে গেছে তাকে! তা না হলে সাবেক অধিনায়ক, সতীর্থ, মাহমুদউল্লাহর স্ট্যাটাসের জবাবে কেন লিখবেন, ‘শুধু আপনিই সব সময় পাশে ছিলেন’। পরোক্ষভাবে যা বোঝালেন, তাতে হতাশ হতেই পারেন তার দীর্ঘদিনের বাকি সতীর্থরা। খেলাধুলার জগতে সেলিব্রেটি হওয়ার অন্যতম শর্ত হচ্ছে ’মাঠে যাই ঘটুক তা মানুষের সামনে আনা যাবে না’।

এই জায়গায় ঠিক নিজেকে সেলিব্রেটিদের সরণিতে নিতে পারেননি মুশফিক। সেলিব্রিটিরা অন্যদের উদ্দীপ্ত করেন। কিন্তু তিনি মাঝেমধ্যে এমন কিছু বলেছেন যা তার অন্ধভক্তকেও আহত করেছে। হতাশ করেছে। ষোল বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সার্কিটে মুশফিক। এখনও সেই রাজপাট পুরোপুরি ছেড়ে আসেননি। তবে অবসরের পরে মুশফিক শুধু বড় ক্রিকেটার হয়ে বাঁচবেন না আদর্শ হয়ে বাঁচবেন, সেই প্রশ্নের উত্তরটাও অবসরের আগে তারই দিয়ে যাওয়া উচিত। ক্রিকেটার হিসেবে তিনি মোটেও দীন নন। যথেষ্ট বিত্তশালী। দেশের অধিনায়কত্ব করেছেন। দেশকে জিতিয়েছেন। মানুষের শ্রদ্ধা-ভালোবাসা পেয়েছেন। কিন্তু সামান্য সমালোচনার আঁচ গায়ে লাগলেই কেন যেন তিনি  ভাষার মার্জিতরূপ হারিয়েছেন। ভুল স্ট্রোক খেলেছেন! ’সুইপ’ শট তিনি খেলবেন না নাকি ছেঁটে ফেলবেন, সেটা মুশফিকই ভাল জানেন। তবে মনোভাবে পরিবর্তন না আনতে পারলে অবসরের পরও শুধু বড় ক্রিকেটার হিসেবেই বেঁচে থাকবেন। আদর্শ হিসেবে বাঁচতে হলে, ভক্ত-সমর্থক-মিডিয়ার অত্যাচার একটু সহ্য করতেই হবে।

টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট থেকে মুশফিক অবসরের ঘোষণা দেওয়ার পর, এখনও তার প্রথম এবং শেষ ম্যাচের অধিনায়কের কোনো প্রতিক্রিয়া চোখে পড়েনি। প্রথম জনের নাম শাহরিয়ার নাফিস। খুলনায় তার অধিনায়কত্বে টি-টোয়েন্টি অভিষেক হয়েছিল মুশফিকের। আর শেষ ম্যাচ খেললেন সাকিব আল হাসানের অধিনায়কত্বে। আবার মুশফিকের বিদায়ী বার্তায় তার প্রথম অধিনায়কের কোনো কথাই নেই। হয়তো বিদায়ের বিষণ্ণতা-বিপন্নটায় শুরুটাই ভুলে গেছেন মুশফিক!

বাংলাদেশ ক্রিকেটে মুশফিকুর রহিম বড় তারকা নন। তবে বড় ক্রিকেটার। পরিসংখ্যান যাই বলুক, আপনি যা দিয়েছেন তা কম নয়। একইভাবে আপনি যা পেয়েছেন সেটাই বা কম কীসে! স্পোর্টসম্যানের অভিধানে হতাশা বলে কোনো শব্দ নেই। মাঠে তারা সেরাটাই দেন। কোনো দিন সেটা দলের জন্য যথেষ্ট হয়। কোনোদিন হয় না। আপনি টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের চাহিদা অনুযায়ী দেশকে  আর দেওয়ার মত কিছু দেখছেন না নিজের ভেতর। তাই বিদায় বলে দিলেন। এই সিদ্ধান্ত নিশ্চয়ই হৃদয়ের ডাক শুনে। আপনার সিদ্ধান্তকে তাই স্বাগত।