ক্রিকেট বাণিজ্যে-বিপণনে-বাতাবরণে দুবাই শহরে অদ্ভুত এক অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ আছে! তবে তার নিজস্ব একটা ভাষাও আছে। সর্বস্ব বাজি রেখে ঝাঁপাও। ভাগ্যলক্ষ্মীর স্পেশাল কোটা এখানে বীরদের জন্য থাকে। এই সর্বস্ব বাজি রেখে ঝাঁপাতে টেকনিক্যাল প্রস্তুতি, মানসিক প্রস্তুতি, অ্যাথলেটিসিজম অনেক কিছু দরকার। আধুনিক ক্রিকেটে আরও বেশি দরকার হয় একজন বিদগ্ধ কোচের। সেই কোচের নাগরিকত্ব যা-ই হোক, সেটা কোনো বিষয় নয়। দরকার পেশাদারত্ব। যিনি বিশ্বাস করেন, ট্রান্সফার অব ইনফরমেশনে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতে এশিয়া কাপ সত্যিই বাংলাদেশের জন্য অন্য রকম এক অ্যাডভেঞ্চার! হেড কোচ ছাড়া একটা দল গেল এশিয়া কাপ খেলতে! আর সেই দলটা দেশের ফিরতি ফ্লাইট ধরতে খুব বেশি সময় নিল না। যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানও সুপার ফোরে খেলছে। সবার আগে নিজেরা সেই জায়গাটা করে নিল। আবার সবার আগে দেশের ফ্লাইট ধরল বাংলাদেশ!
হেড কোচ ছাড়া বাংলাদেশ টি-টোয়েন্টি খেলতে যাচ্ছে। মনে হয়েছিল; বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড বোধ হয় দৃষ্টিভঙ্গিতে অনেক পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ক্রিকেটের সাফল্যের দিগন্ত প্রসারিত করতে বিসিবি সভাপতি নিজেই দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে যাচ্ছেন দলটাকে! এই মানুষটা আর আপস-টাপস করবেন না। কোনো ভয় পাবেন না। কাকে ভয় পাবেন! কিসের ভয়! কারণ, তিনি তো ক্রিকেট পরিচালনা করছেন একাই। কারণ, তিনি জানেন তিনি নিরাপদ। একই সঙ্গে তার পাশে থাকা দু’চারজন লোকও জানেন তারাও নিরাপদ। এখানে কোনো জবাবদিহি নেই। কাউকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে না। তাই আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কার কাছে হার, এটা স্বাভাবিক। হতেই পারে। এর জন্য কাউকে কোনো জবাব দিতে হবে না!
এ দেশের কিছু মানুষের ফেসবুকের ওয়ালে হয়তো দিন কয়েক কিছু রাগ-ক্ষোভ-হতাশা-দুঃখে শোকগাথা ভেসে বেড়াবে। তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে। এই বিপর্যয়-টিপর্যয় দুই দিন পরে সব ওয়াল থেকে হারিয়ে যাবে। এগুলো হচ্ছে, আবেগতাড়িত বাঙালির ক্রিকেটপ্রেম।
তবে একটা কথা বলতেই হচ্ছে, একটা টিমকে কীভাবে বিচার করা উচিত? শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে একটা ম্যাচের হার দেখে? অবশ্যই না। সেভাবে বাংলাদেশ দলকেও কেউ মাপতে যাবেন না। তবে হ্যাঁ, টানা দুই-তিন মাস ধরে এই দলটার যা ফর্ম, তাতে দলটা নিয়ে ক্রিকেটীয় বিশ্লেষণ দাবি রাখে। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি, ওয়ানডেতে হেরে এসেছে। এরপর এশিয়া কাপে মুখ থুবড়ে পড়ল! কিন্তু আমজনতার কাছে সবচেয়ে গুরুত্ব পাচ্ছে, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচটা! কারণ, এই ম্যাচটা জিতলেই এশিয়া কাপের সুপার ফোরে জায়গা পেত বাংলাদেশ। সবাই অতীত ব্যর্থতা ভুলে যেতেন। কেউ বুক ফুলিয়ে বলতেন, দেখলেন, মিরাজকে দিয়ে ওপেন করিয়ে কত বড় স্কোর গড়লাম। ইবাদতকে টেস্ট বোলার থেকে টি-টোয়েন্টি বোলারও বানিয়ে ফেললাম! এশিয়া কাপে আমাদের কঠিনতম ম্যাচে প্রবলতম চাপ সামলে আমরা কীভাবে পরের রাউন্ডে পৌঁছে গেলাম! এটাই হচ্ছে দলের মধ্যে সংস্কার!’ আবার কেউ কেউ বলতেন’ লড়াকু এক সংস্কারককে আমরা পেয়ে গেছি। যিনি আমাদের ক্রিকেটের ব্র্যান্ডটা বোঝেন।’
আসলে রক্তপাতহীন-নির্বীয যুদ্ধে ক্রিকেট কেন, পৃথিবীর কোনো সংস্কারই আসেনি। তাই এই লড়াকুরা দলের এই বিপর্যয়েও বিপন্নবোধ করবেন না! কারণ; তারা জানেন, তাদের কাছে কেউ কখনো কোনো জবাব চাইবেন না। এমনকি দলের এই ব্যর্থতায় ক্রিকেটারদের পাশে কজনকে পাওয়া যাবে, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে।
একটা দলের কঠিন ম্যাচে স্পিনাররা নো-বল করছেন! ওয়াইড বল করছেন। বিশ ওভারের ম্যাচে এক ডজন বল বেশি করতে হলো। ম্যাচটা শ্রীলঙ্কার হাতে তুলে দিতে আর কী লাগে! সে আপনার স্কোর বোর্ডে যতই ১৮৩ রান জমা থাকুক না কেন!
ম্যাচের আগে শ্রীলঙ্কানরা বললেন, বাংলাদেশ দলে সাকিব আর মোস্তাফিজ দুজন বিশ্বমানের বোলার আছেন। সাকিব সেটা শোনার পর মনে হয়েছে, নিজের মান-সম্মান ঠিক রাখতে লঙ্কানরা যখন চাপে, ঠিক তখন নিজের চার ওভার করে ফেললেন! মোস্তাফিজ তো প্রথম ওভারেই ভ্যানিশ। নিজেকে হারিয়ে খুঁজতে শুরু করলেন! ২০ ওভার বল করে লঙ্কানদের ১৮৩ রানের নিচে আটকে রাখতে হবে, এই অঙ্কটাই মেলানোর কোনো চেষ্টা ছিল বলে মনে হয়নি অধিনায়ককে দেখে! আর কোচ! এই দলে তো কোনো কোচই নেই! রাসেল ডমিঙ্গোকে বাদ দিয়ে এশিয়া কাপের প্রারম্ভিক অভিযানে ব্যর্থ বাংলাদেশ টিম ম্যানেজমেন্ট। দক্ষিণ আফ্রিকায় বসে মুচকি মুচকি হাসতেই পারেন মিস্টার রাসেল। আর স্বপ্নের শহর দুবাই থেকে বিষণ্ন-শোকস্তব্ধ, যন্ত্রণাকাতর অনুভূতি নিয়ে ঢাকার ফ্লাইট ধরবেন বাংলাদেশ ক্রিকেটাররা।
তবে বিশ্বকাপের আগে সংযুক্ত আরব আমিরাতে আতঙ্কের সাইরেন শুনে এলো গোটা বাংলাদেশ দল। এশিয়া কাপের এই দুঃসহ স্মৃতিগুলো ক্রিকেটারদের মন থেকে দূর করার জন্য একজন লোক দরকার। তাকে হেড কোচ বা পরামর্শক যে নামেই ডাকুন না কেন!
লেখক :সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলাম লেখক