আপনি সৌভাগ্যবান। এবার কেউ আপনাকে নিয়ে লেখেননি, ‘সংবাদ সম্মেলনে আপনি হাসতে হাসতে সব উত্তর দিলেন কেন! আপনি এশিয়া কাপ নিয়ে তাহলে অত সিরিয়াস নন?’
আপনি কেন বললেন, ‘অনেকবার নতুন করে শুরুর কথা বলা হয়েছে! সব শুরুর একটা শেষ থাকবে না? তাই আর নতুন করে শুরুর কথা নয়।’
আপনি কেন বললেন, ‘এশিয়া কাপ নিয়ে বড় কোনো স্বপ্ন না দেখাই ভালো!’
তাহলে কি আপনি স্বপ্নহীন সারথি হয়ে বাংলাদেশ দল নিয়ে আরব আমিরাত যাত্রা করলেন! না। তাকে ঘিরেই তো বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নের উজান বেয়ে বহুবার তিনি নায়ক হতে হতে ট্র্যাজিক নায়ক। কারও কারও কাছে খলনায়ক। মনের গহিনে জমে থাকা স্বপ্ন ভঙ্গের কথাগুলো হাসি দিয়ে উড়িয়ে দিতে চেয়েছেন।
ওই হাসি দিয়েই সাকিব আল হাসান পৌরুষের অন্য রকম এক নির্মাণ করতে চেয়েছেন। কারণ, তিনি হয়তো জানেন পুরুষমানুষকে প্রকাশ্যে আবেগতাড়িত হতে নেই। কাঁদতে নেই। নির্জনে চোখের জল ফেলতে গেলেও তাকে বোধ হয় ভাবতে হয়—একটু কম পুরুষ হয়ে গেলাম না তো! পঁয়ত্রিশ বছরের সাকিব সেই বিষাক্ত পৌরুষের বিনির্মাণ কীভাবে হয়, তা তিনি জানেন। তাই লোকসমক্ষে হাসি দিয়েই অনেক কিছু উড়িয়ে দিয়ে গেলেন। সঙ্গে এটাও বুঝিয়ে দিলেন নিরাসক্তি মানেই আগের হারের শোক ভুলে থাকা নয়। হাসি মানে নিরাবেগও নয়। বাংলাদেশ ক্রিকেট নিয়ে তারও আবেগ আছে। সেটা পরিণত বয়সে এসে খুব মাপা। পরিমিত। তাই তিনি বলতে পারেন, ‘এশিয়া কাপ চ্যাম্পিয়ন হলাম। কিন্তু পরের টুর্নামেন্টগুলো বাজেভাবে হারলাম। সেটা মোটেও সুখকর নয়। তৃপ্তিদায়ক বা স্বস্তিদায়ক হতে পারে না। তার চেয়ে অনেক বেশি ভালো লাগবে; যদি দেখি আমরা একের পর এক টুর্নামেন্টে ভালো করছি। আগামী বিশ্বকাপে সেরা চার দলের মধ্যে থাকছি। তার পরের বিশ্বকাপে শিরোপার দাবিদার হিসেবে অংশ নিচ্ছি।’ তবে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে হারের যে সংক্রমণ বাংলাদেশ দলে ঘটেছে, সেখান থেকে একজন সাকিব আল হাসান বা কারও পক্ষেই দলকে বের করে আনা কঠিন।
সাকিব আল হাসান নিজেও জানেন, একক ইঞ্জিনের মতো দলকে বহুদূর টেনে নেওয়া যায়। তবে সেটা মাঝেমধ্যে। দিনের পর দিন সম্ভব নয়। তাই পাশে সাপ্লিমেন্টারি প্রতিভাগুলোর প্রয়োজন পড়ে। আর দিন শেষে ক্রিকেটও টিম গেম। যেখানে অভিজ্ঞতাও বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ায় কখনো কখনো। তাই মুশফিক আর মাহমুদউল্লাহকে দলে নিয়েছেন তিনি। অধিনায়কের আস্থার প্রতিদান দেওয়ার দায়িত্ব ওই দুই অভিজ্ঞ ক্রিকেটারের। মুশফিক তার কিপিং গ্লাভস ফিরে পেলেন সাকিবের সৌজন্যেই। আর মুখে যে যা-ই বলুন না কেন, রাসেল ডমিঙ্গো কোচ হিসেবে দলে জায়গা হারালেন, অভিজ্ঞদের দল থেকে ছেঁটে ফেলার যে প্রেসক্রিপশন তিনি বোর্ডকে দিয়েছিলেন, তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে! অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হলেও, নিউজ ল্যাব রিপোর্ট তাই বলে। তাই ফুটনোট হিসেবে, লিখে দেওয়া যায়: এশিয়া কাপে যাওয়ার আগে কিন্তু অধিনায়ক সাকিব আল হাসান একটা ম্যাচ জিতেই গেলেন।
তবে সাকিব আল হাসান, আপনি বাংলাদেশ ক্রিকেটে শুধু অধিনায়ক নন। নায়ক নন। কখনো কখনো মহানায়ক। আর সাফল্য নায়ককেও চেনে না। মহানায়ককে চেনে। সেটা খেলার মাঠে হোক আর অন্যখানে হোক। আমাদের চারপাশের ভোগবাদী সমাজ আর কনজিউমারিস্ট দুনিয়া তেমনই শেখায়। সেই দুনিয়া তুঙ্গ সাফল্য ছাড়া কিছু চেনে না। সাকিব আপনিও সেই দুনিয়ারই বাসিন্দা। তাই যারা মুগ্ধ হয়ে আপনার প্রেস কনফারেন্সের কথা শুনালম, তারাই পেশাগত কারণে আর ‘লাইক’ কুড়াতে হাওয়ায় ভাসিয়ে দেবেন আপনার হাসিমুখের কথাগুলো! অপেক্ষা শুধু ব্যর্থতার। এশিয়া কাপে ব্যর্থ হলে যখন কাটাছেঁড়া শুরু হবে, তখন কিন্তু কেউ বলবেন না, ‘টিম ডিরেক্টর আছেন। কনসালট্যান্ট আছেন। বোর্ড পরিচালকরা আছেন। দায়টা আমাদের সবার।’ তখন কিন্তু জনতার আদালত থেকে বিসিবির বারান্দার বিচারালয় সব জায়গায় আপনাকেই দাঁড়াতে হবে।
আর বাংলাদেশের আপাতত যে সমস্যা দিনে দিনে প্রকট হচ্ছে, সেই সমস্যার সামনে আপনাকেও দাঁড়াতে হবে। এখানে বিশেষজ্ঞের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ক্রিকেট নয়। ক্রিকেটার আর ক্রিকেট-কর্তাদের নিয়েই আলোচনা বেশি হচ্ছে! এরা আপনাদের লড়াইয়ের গরিমা মানেন না। চেষ্টার মর্যাদা দেন না। পরিশ্রমের দাম দেন না। আশাভঙ্গের বেদনা বোঝেন না। এরা শুধু সাফল্য চান। সাফল্যের কাব্য নয়। মহাকাব্য চান। এরা মহাকাব্যের মহানায়ক বেছে নেন তুঙ্গ-সাফল্যের নিরিখে।
লেখক: সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলামিস্ট