চা শ্রমিকদের একাংশের ধর্মঘট প্রত্যাহার হয়েছে ১২ দিন পর, অন্য একটি অংশ ধর্মঘট চালিয়ে যাচ্ছে। চা শ্রমিকদের আন্দোলন কি সফল হয়েছে? মালিকরা কি তাদের দাবি মেনে নিয়েছেন? দৃশ্যত মনে হতে পারে, চা শ্রমিকদের আন্দোলন সফল হয়েছে, তাদের মজুরি বেড়েছে। সে কারণেই তারা ধর্মঘট প্রত্যাহার করেছেন। কিন্তু আসলেই কি তাদের আন্দোলন সফল হয়েছে? আসলে তারা ধর্মঘট প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছেন। দিনের পর দিন ধর্মঘট করলে তারা খাবেন কী? আন্দোলন করার দরকার নেই। তাদের জীবনে তো এমনিতেই অনশন। তাদের জীবন চলে এক বেলা না খেয়ে। তারপরও তারা জীবন টেনে নিতে পারেন না। মরিয়া হয়েই তারা আন্দোলনে নেমেছিলেন। কিন্তু তারা কামান চেয়ে ছুরি পেয়েছেন। এখন এই ছুরি দিয়েই তাদের জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।
চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ছিল ১২০ টাকা। তাদের দাবি ছিল ৩০০ টাকা করার। বাড়িয়ে করা হয়েছে ১৪৫ টাকা। তাতেই কোনোরকমে মুখরক্ষা হয়েছে, ধর্মঘট প্রত্যাহার হয়েছে। আমার ধারণা মজুরি একদম না বাড়ালেও এমনিতেই দুদিন পর তারা কাজে যোগ দিতেন।
দেশের ২৪১টি চা বাগানে স্থায়ী শ্রমিক আছে ১ লাখ, অস্থায়ী ৫০ হাজার। তাদের ওপর নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা প্রায় আট লাখ। ধর্মঘট চালিয়ে গেলে এই ৮ লাখ মানুষ খাবে কী?
চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি বাড়িয়ে ১৪৫ টাকা করা হয়েছে। একজন শ্রমিক যদি সপ্তাহে ৬ দিন কাজ করেন, তাহলে মাসে তার আয় দাঁড়ায় ৩ হাজার ৭৭০ টাকা। কমপক্ষে চারজনের একটি পরিবারকে এই আকালের দিনে ৩ হাজার ৭৭০ টাকা দিয়ে সারা মাস চলতে হয়। এবার একটু ভাবুন, আপনার নিজের সংসারের হিসাবের সাথে মিলিয়ে নিন। জিনিসপত্রের দাম কিন্তু ঢাকায় যা শ্রীমঙ্গলেও তাই। চা শ্রমিকদের জন্য আলাদা কোনো বাজার নেই। এই যে ১২০ টাকা ১৪৫ টাকা মজুরির হিসাব হচ্ছে; এটা কিন্তু ন্যূনতম মজুরি না, এটাই প্রায় সর্বোচ্চ। আগের হিসেবে একজন শ্রমিক ২০ কেজি পাতা তুলতে পারলেই দিনে ১২০ টাকা মজুরি পেতেন। কম হলে কাটা যেতো কেজিপ্রতি ৬ টাকা। আর ২০ কেজির বেশি তুলতে পারলে বাড়তি প্রতি কেজির জন্য পান ২ টাকা। ঠিক পড়েছেন, কমলে কেজি প্রতি ৬ টাকা কাটা, বাড়লে কেজি প্রতি ২ টাকা বেশি। দিনে ২০ কেজি পাতা তুলতে আক্ষরিক অর্থেই একজন শ্রমিককে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়। তাও সবাই, বিশেষ করে বয়স্করা পারেন না। অসুখ বিসুখ হলে সেদিনের হাজিরা বন্ধ, মানে আয় বন্ধ, মানে চুলা বন্ধ।
চা শ্রমিকরা খুবই ভাগ্যবান, তাদের বাসা ভাড়া দিতে হয় না। তারা রেশন পান, তাদের শিক্ষা ও চিকিৎসা ফ্রি। আপনাদের মনে হতে পারে, সবই তো ফ্রি, তাহলে তো তারা অনেক ভালো আছেন। চলুন তাদের ভালো থাকার ব্যবস্থাটা একটু ঘরে আসি। চা বাগানের জায়গায় বানানো লেবার লাইনে তারা থাকেন। শতবছর ধরে থাকলেও এই ভূমিতে তাদের কোনো অধিকার নেই। এই মুফতে পাওয়া আবাসন ব্যবস্থার কথা একটু শুনুন, ৮ বাই ১২ হাতের ঘরে বরাদ্দ একটি পরিবারের জন্য। পরিবারের সদস্য চার থেকে ১০ জন। একবার ঘর ভাঙলে মেরামত করতে অনেক সময় লাগে। তখন বর্ষায় পানি পড়ে, শীতে আসে কনকনে হাওয়া। একজন শ্রমিক প্রতি সপ্তাহে ২ টাকা কেজি দরে তিন কেজি আটা পান রেশন হিসেবে। এই রেশন সকালের নাস্তাতেই ফুরিয়ে যায়। অনেকে বাড়তি রোজগারের আশায় চা বাগানের খালি জায়গায় সবজি চাষ করেন। যারা সেটা করেন, তারা আবার রেশন পান না। সকালের নাস্তা তো রেশনের আটায় হয়ে যায়। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দৈনিক মজুরিতে আরেক বেলা খাওয়ার ব্যবস্থা হয়। আমরা যেমন শখ করে ডায়েট করি, চা শ্রমিকরা বাধ্য হয়ে ডায়েট করেন। সাকুল্যে দুই বেলা খাবারই জোটে তাদের। তাদের নিত্যদিনের মেন্যু কী জানেন? চা পাতা ভর্তা। বাগানের চা পাতা দিয়ে বানানো ভর্তাই তাদের ভরসা। মাছ-মাংসের চেহারা দেখেন বছরে এক-দুইবার কোনো উৎসবে। তারাও কিন্তু আমার আপনার মত মানুষ। চা শ্রমিকদের চিকিৎসাও ফ্রি। তবে স্বাস্থ্য ক্যাম্পে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকে সব রোগের জন্য মেলে প্যারাসিটামল দুই বেলা। আর শিক্ষা? সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আর এনজিওর স্কুলে ক্লাশ ফাইভ পর্যন্ত পড়াশোনা হয়। এরপর লেগে যায় চা বাগানে পাতা তুলতে।
শ্রমিকের ছেলে শ্রমিক হবে, তার অত পড়াশোনা দরকার কি। পুরো চক্রটি এমনভাবে সাজানো, যেন শ্রমিকরা কখনো এই চক্র ভাঙতে না পারে, বেশি পড়াশোনা করে যেন তাদের চোখ খুলে না যায়। তারপরও দুয়েকজন এই চক্র ভেঙে বেরিয়ে পড়েন। তেমনই একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সন্তোষ রবি দাস। মৌলভীবাজার জেলার শমসেরনগরে ফাঁড়ি কানিহাটি চা-বাগানের শ্রমিক পরিবারের সন্তান সন্তোষ চা শ্রমিকদের ধর্মঘট চলাকালে ফেসবুকে তার মায়ের সংগ্রামের কথা লিখেছেন, কানিহাটি থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার লড়াইয়ের কথা লিখেছেন। সন্তোষ তার স্ট্যাটাস শেষ করেছেন, “আজকাল মায়ের শরীর আর আগের মতো সায় দেয় না। বলেন, ‘তোর চাকরি হইলে বাগানের কাজ ছেড়ে দেব।‘ আমি এখন সেই দিনের প্রতীক্ষায় আছি....!” তার ফেসবুক স্ট্যাটাস কাঁদিয়েছে অনেককে। কিন্তু ভাবিয়েছে কয়জনকে?
১২ দিনের ধর্মঘটে তারা দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে ১৪৫ টাকায় তুলতে পেরেছেন। মাসে সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৭৭০ টাকা। চা বাগানের মালিকদের এক বিকেলের চায়ের বিল। এই টাকায় একটি পরিবার একমাস টিকে থাকতে পারবে তো। মালিকরা বলবেন, অবশ্যই পারবে। শত বছর ধরে তো এভাবেই ঠকে ঠকে তারা টিকে আছেন। তাদের পরিশ্রমে আমাদের রপ্তানি আয় বাড়ে, রিজার্ভ বাড়ে। আমরা যে চায়ে চুমুক দিয়ে সতেজ হই, আমরা জানতেও পারি না, সেই চায়ে মিশে আছে কত শ্রমিকের ঘাম, কান্না, বঞ্চনার ইতিহাস; কত সন্তোষের মায়ের লড়াইয়ের গল্প।