‘বেয়াড়া’ সাকিবে বিপদে বিসিবি

মানজুর মোরশেদ প্রকাশিত: আগস্ট ১১, ২০২২, ০৬:০৫ পিএম

বাংলা ভাষায় একটি শব্দ আছে ‘বেয়াড়া’। এই বিশেষণটির অর্থ ‘যে জেদ করে’! এই শব্দটির চমৎকার আরেকটি সমার্থক শব্দ আছে ‘বিগড়ানো’। তো বেয়াড়া বলেন, আর বিগড়ানো বলেন- সাকিব আল হাসানের সাথে দারুণ মেলে এই শব্দযুগল, যদি তা বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পয়েন্ট অব ভিউ থেকে দেখেন আর কি! বিসিবি-সাকিব সম্পর্ক যেন সাপে-নেউলে! তাল-লয়-সুর অনেক আগেই কেটে গেছে, এই দু’য়ের অর্কেস্ট্রা এখন বড়ই বেসুরো, অন্তত ক্রিকেটীয় দৃষ্টিকোণ থেকে। সাকিব যে পথে চলেন, যেভাবে চলতে চান, তা নিয়ে বিতর্ক বেশুমার; তিনি বড়সড় ছাড়ও পান। দলে এর একটা বাজে প্রভাব রয়েছে, শৃঙ্খলা নামক শব্দটির প্রয়োগ ও ব্যাখ্যা তাই টিম ম্যানেজমেন্টকে নিজেদের প্রয়োজনেই একটু এদিক-ওদিক করে নিতে হয়! কিন্তু এভাবে কতদিন, এর শেষ কোথায়? সাকিবের অবসরে?

সম্প্রতি তাঁর বেট উইনার নিউজের সাথে চুক্তিকে যুদ্ধ ঘোষণার মত বিষয় মনে হচ্ছে! তিনি যখন এশিয়া কাপ ও বিশ্বকাপ টি-টোয়েন্টিতে অধিনায়কত্ব পেতে চলেছেন- এমন একটি প্রস্তুতি প্রায় নিয়েই ফেলেছিল বিসিবি, ঠিক তখনই আরেকবার বিগড়ালেন সাকিব, বিপাকে ফেললেন এদেশের ক্রিকেট মহলকে। জুয়া সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সাথে কোনভাবেই চুক্তি মেনে নেবেন না বিসিবি প্রধান নাজমুল হাসান পাপন। আবার সাকিব প্রয়োজনে অধিনায়কত্ব থেকে দূরে থাকতে চান, কিন্তু ১০ কোটি টাকার চুক্তিকে দূরে ঠেলে নয়- এ এক অদ্ভুত সংকট বিসিবি’র জন্য। আরও একবার সাকিব তাদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলার ব্যবস্থা করেছেন যে!

সাকিব শাসন-বারণ মানেন না, সেটি বোঝা গেছে তাঁর তারকা খ্যাতির শুরুর দিনগুলোতে। এরপর তিনি পত্রপল্লবে বিকশিত হয়েছেন, বাংলাদেশের ক্রিকেটও হয়েছে খানিকটা; তবে সাকিবের গ্রাফটা বেশ উঁচুতে হয়েছে- এটা না বোঝার মত নির্বোধ তো আর নন তিনি! আর তাইতো নিয়ম ভেঙ্গেছেন যত্রতত্র, কপালে জুটেছে ‘ব্যাডবয়’ তকমা। ২০১০ সালে এক ম্যাচের মধ্যে বাউন্ডারি লাইনে ছুঁটে গিয়ে এক দর্শককে বাজে গালি দিয়েছিলেন- সেই বোধহয় প্রথম। এরপর তাঁর মধ্যমা আঙ্গুলের অশালীন ইঙ্গিত থেকে শুরু করে দর্শকের কলার চেপে ধরা, পেটানো; বোর্ডের অনাপত্তিপত্র না নিয়ে আরেক দেশের ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে খেলতে যাওয়ার মত স্পর্ধা দেখানো- সবই করেছেন! দু’দফা আর্ন্তজাতিক ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধও হয়েছেন- ঐ ঘাড়ের রগটা সোজা না হওয়ায়। দু’দফা-ই  তিনি বিসিবি’কে হেলাফেলা করেছেন, একবার টেস্ট –ওয়ানডে থেকে অবসরের হুমকি দিয়ে, আরেকবার জুয়াড়ীর প্রস্তাব পেয়েও তা বিসিবি’কে না জানানোয়।

ভুল করেছেন, আবার ক্ষমাও পেয়েছেন। কখনও আ হ ম মোস্তফা কামাল, কখনও নাজমুল হাসান পাপন সব ভুলে তাকে বুকে টেনে নিয়েছেন, শুধুমাত্র তাঁর ম্যাচউইনিং প্রতিভার কারণে। এরকম আরেকটি ক্রিকেটার তো বাংলাদেশে আর নেই, কবে আবার হবে সেটি ধারণা করাও কঠিন। আর এই সুযোগটিই প্রতিক্ষণে নিচ্ছেন সাকিব, সেটি ঘরোয়া লিগ হোক আর আর্ন্তজাতিক ম্যাচ- সবখানেই তিনি ব্যতিক্রম। অনুশীলন না করে চলে যাচ্ছেন বিজ্ঞাপনের কাজ করতে, চলে যাচ্ছেন নিজের ব্যবসায়িক কাজে, এমনকি অধিনায়ক হিসেবে ফাইনালের আগেরদিন প্রেসমিট কিংবা ট্রফির সাথে ছবি তোলার সময় হয়ে যান নিখোঁজ। বড়ই বিচিত্র এক চরিত্র তিনি। ক্রিকেট মহলে তাঁর এই ‘বিগড়ানো’ স্বভাবে এখন আর কেউ অবাক হন না! আর হবেনই বা কেন? এতো নিত্যদিনের কাজ হয়ে গেছে।

সাকিব অনেক দিয়েছেন দেশকে, সে ব্যক্তিগত পারফরমেন্সে। হয়েছেন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার, পৃথিবী চিনেছে বাংলাদেশকে। কিন্তু তাঁর মানে ও প্রতিভায় তিনি দেশকে কী দিয়েছেন- এই প্রশ্ন যদি করেন তবে উত্তর যা পাবেন তাতে কষ্ট বাড়বে বৈ কমবে না! তিনি অর্জুনা রানাতুঙ্গা হতে পারেননি! কে না জানে সেসময় শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটের দুর্নীতির কথা, কে না জানে ছোট্ট দ্বীপ দেশটি তামিল সমস্যার কারণে সে সময় পুরো ভূখণ্ডে ক্রিকেট চর্চা করতে পারত না! শ্রীলঙ্কা বোর্ডের একসময়ের প্রভাবশালী কর্মকর্তা নিশান্তা রানাতুঙ্গা একবার বলেছিলেন- দেশের অর্ধেক অংশে ক্রিকেট চর্চা করে তাঁরা বিশ্বকাপ পেয়েছেন, তাঁর কৃতিত্ব ঐ রানাতুঙ্গার। নেতৃত্বগুণে ও ছাড় দেওয়ার মানসিকতায় তিনি এমন একটি দল তৈরি করতে পেরেছিলেন- যারা ১৯৯৭ সালে ওয়ানডে বিশ্বকাপ জিতেছিল। আনতে পারেন ইমরান খান নিয়াজির নামও। দোষের ভাগ তাঁর চরিত্রেও কম ছিল না! কিন্তু তিনি নেতা হতে পেরেছিলেন- সে ঐ নায়কোচিত চেহারার কারণে নয়, নেতৃত্বের সহজাত গুণ ও শেখার অদম্য বাসনা থেকে। ১৯৯২ বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক আজ পাকিস্তানের রাজনীতির সব থেকে বড় ফ্যাক্টরও! শোনা যায় সাকিবও নাকি রাজনীতি করতে চান, সেটি করতে হলে- সাফল্য পেতে হলেও কিন্তু ‘আমি’ নয়, ‘আমরা’ নিয়ে ভাবতে হয়! সাকিব কি পারবেন? 

বেটউইনার ইস্যুতে সাকিব অধিনায়কত্ব ছাড় দিতে প্রস্তুত, তবে ১০ কোটি টাকা নয়- এমন খবরও গণমাধ্যমে এসেছে। এটা হতাশার। আসলে সাকিবের কাছে এ জাতির প্রত্যাশা ছিল অনেক! দিনশেষে হয়ত তাঁর কমই মিলবে- সেটা এখন বোঝাই যাচ্ছে। নেতা হতে গেলে ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হয়, সাকিব বোধহয় সেটি নেন না! ইমরান খান কিন্তু নিতেন। ইংল্যান্ডের ব্রাডফোর্ড ইউনিভার্সিটির সমাবর্তনে ইমরান তরুণদের বলেছিলেন- তিনি ভুল থেকে শিক্ষা নেন, ভুলকে ঠিক করেন, আর তারপর সামনে এগিয়ে যান। এই যে শুদ্ধিকরণ সেটি কি আছে সাকিবের ডিকশনারিতে? না থাকলে এখনও সময় আছে- কারণ সাকিব এদেশের সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন, তিনি অনেক তরুণ-কিশোরের রোল মডেল। তাঁর আচার-ব্যবহার, কাজ-কারবারকে আদর্শ ধরে মাঠ ও মাঠের বাইরে, গোচরে-অগোচরে কেউ বিপথে গেলে একদিন নিশ্চয় তারও খারাপ লাগবে?

 

লেখক: বিশেষ প্রতিনিধি, যমুনা টেলিভিশন