ক্রিকেটীয় দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা, নাকি চরিত্রের জোরে বাংলাদেশের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জিতল জিম্বাবুয়ে? ব্যাখ্যাটা অনেকভাবে হতে পার। এবং হচ্ছে। তবে প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিলে ওসবের কোনোটাই নয়! কেন? জিম্বাবুয়ের জয় মানে বাংলাদেশের হার। এই হারের পেছনে যে কারণই থাকুক না কেন, সেগুলো খুঁজতে যাওয়ার আগে, একটা শব্দোদ্ধারে নামতে হবে। ‘বেসিক্যালি’!
দেশজ ক্রিকেটের প্রধান কর্তার মুখে আমরা প্রায়ই শুনি ‘বেসিক্যালি টি-টোয়েন্টিতে আমরা এখনো ভালো দল হয়ে উঠতে পারিনি!’
‘বেসিক্যালি’ শব্দটা এত উল্টাপাল্টা জায়গায় ব্যবহার হয়েছে, এখন বোধ হয় শব্দটাই প্রাসঙ্গিতা হারিয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেটে! তবু বাংলাদেশের সিরিজ হারের কারণ খুঁজতে ওই ‘বেসিক্যালি’ শব্দটাকে ধরে এগোলে কাজটা সহজ হয়ে যায়।
আপনি যখন নিজেই স্বীকার করে নিচ্ছেন, টি-টোয়েন্টিতে আমরা ভালো দল নই, তাহলে তাদের কাছে জয় আশা করবেন কীভাবে! ক্রিকেটীয় দক্ষতা-যোগ্যতা যতই থাকুক আপনার, চরিত্রে জোর নেই। মনে জোর না থাকলে জয়ের আশায় বুক বাঁধবেন কেন!
যুবশক্তিকে প্রাধান্য দিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেটে নবদিগন্তের সূচনা দেখতে চেয়েছিলেন বোর্ডকর্তা ও নির্বাচকরা। দেশ ছাড়ার আগে যে স্টেটমেন্ট পেশ করা হলো, সেখানে পরোক্ষভাবে বলা হলো: “টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশ ক্রিকেটে এখন থেকে যুবশক্তিকেই প্রাধান্য দেওয়া হবে। সেটা আগামীর কথা বিবেচনা করে।” কিন্তু চিন্তার সেই দিগন্তরেখা আরও দূরর্বতী দেখাল হারারেতে সিরিজ হেরে!
তার চেয়েও হাস্যকর মনে হলো ‘বিশ্রাম’ দেওয়া একজন বয়স্ক ক্রিকেটারকে আবার স্কোয়াডে ডাকা। শেষ ম্যাচে একাদশে রাখা! টিম ম্যানেজমেন্টের এই সিদ্ধান্ত দেখার পর মনে পড়ে গেল ভারতের সাবেক এক অলরাউন্ডারকে। যিনি অবসরোত্তর জীবনে একবার বাংলাদেশ দলের কোচ হয়ে এসেছিলেন। তাকে ভারতীয় দল থেকে বাদ দেওয়ার পর লালা অমরনাথের ছেলে মহিন্দর অমরনাথ নির্বাচকদের উদ্দেশে বলেছিলেন: বাঞ্চ অব জোকার্স! মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে বিশ্রামের নামে দল থেকে বাদ দেওয়ার পর আবার তাকে শেষ ম্যাচে খেলানোর সিদ্ধান্ত যারা নিলেন, তাদের জোকার ছাড়া অন্য কী বলা যায়!
জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে এই প্রথম বাংলাদেশ টি-টোয়েন্টি সিরিজ হারল। কৃতিত্বটা জিম্বাবুয়েকে দিতে হবে। ওরা বাংলাদেশকে হারাল। কারণ, জেতার জন্য যথেষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে বাংলাদেশ যায়নি। তারা ধরেই নিয়েছিল, জিতে যাবে। যে চিন্তা চরম অক্রিকেটীয়। অপেশাদারি ধ্যানধারণাজাত! জীবনে বিপন্নতা মানুষ সামাল দেয় যুক্তি-ভাবনা-মনন সব মিলিয়ে। কিন্তু বাংলাদেশ শুধু আশা-অপেক্ষা-আর প্রার্থনাই করল! সিরিজ জয়ের মতো ক্রিকেটটা খেলল কোথায়?
ক্রিকেটে ট্যালেন্ট দরকার। কিন্তু ট্যালেন্ট সবকিছু নয়। অসম্ভব প্রতিভাবানকেও ম্যাচ জেতাতে শক্তিশালী মন দরকার। সেটা দেখা গেল কি এই সিরিজে! পেশাদার ক্রিকেটে মনের জোরটা অনেক বেশি দরকার। কিন্তু টি-টোয়েন্টি সিরিজ এলেই আমরা টিম ম্যানেজমেন্টকে কোরাস গাইতে শুনি: “আমাদের পাওয়ার হিটার দরকার। ও রকম কোনো হিটার আমাদের নেই।” এসব গৎবাঁধা কথা শুনতে শুনতে ক্রিকেটপ্রেমীরা ক্লান্ত। এসব বলে যারা হারার আগে হেরে বসে থাকেন, তাদের হারাতে খুব কষ্ট করতে হয়নি জিম্বাবুয়েকে।
পাওয়ার হিটারের অভাব মানছি। কিন্তু বিকল্প কোনো চিন্তা কি করেছেন! বাংলাদেশ দলের ব্যাটিং কোচ জেমি সিডন্সের স্বদেশি এক অস্ট্রেলিয়ান এই বিকল্প চিন্তা করেছিলেন ওয়ানডে ক্রিকেট নিয়ে। ভদ্রলোকের নাম ববি সিম্পসন। অস্ট্রেলিয়ান দলের কোচ হিসেবে তিনি ব্যাটারদের একটা বার্তাই দিয়েছিলেন। বলে বলে বাউন্ডারি, ওভার-বাউন্ডারি দরকার নেই। তিনশ বলে সিঙ্গেল নেওয়ার চিন্তা করো। আর সিঙ্গেলকে ডাবলসে রূপ দিতে রানিং বিটুইন দ্য উইকেটে আরও ফাস্ট হতে হবে। স্বাভাবিকভাবে স্কোরবোর্ডে বড় পুঁজি উঠে যাবে। আশির দশকে সেই চিন্তায় একটা দুর্বল দল নিয়েও অস্ট্রেলিয়া বিশ্বকাপ জিতেছিল।
টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের পাওয়ার হিটার নেই মানলাম। কিন্তু সিঙ্গেলকে ডাবল করার চিন্তা করলে ২০০ রানের স্কোর করা কি খুব কঠিন এই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে? আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে চিন্তামনস্ক লোক বেশি দরকার টিমের সঙ্গে। বড় বড় নাম নয়।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট অনেক গতিশীল-তীক্ষ্ণ-প্রান্তবন্ত। ক্রিকেটারদের কাছে তার চাহিদাও বেশি। অসম্ভব শারীরিক ও অ্যাথলেটিক পরীক্ষা নেয় প্রতিমুহূর্তে এই ফরম্যাট। সেই জায়গাও ব্যর্থ বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা। ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিং কোনো জায়গাতেই হিসাবি, পেশাদার, শৌর্যের খোঁজ মিলল না।
মনোবিদরা একটা কথা প্রায়ই বলেন: মন যে স্বপ্ন দেখে এবং যাতে বিশ্বাস করে মন তা ছুঁতে পারে। বাংলাদেশ টি-টোয়েন্টি জিততে পারে সেটা নিজেরাই কি বিশ্বাস করেন! যদি করতেন তাহলে বোর্ডের শীর্ষ বলতে পারতেন না: “বেসিক্যালি, আমরা টি-টোয়েন্টিতে ভালো টিম নই!” জয়ের জন্য মনের দরজা-জানালা যদি ‘ভালো টিম নই’ বলে বন্ধই রাখেন, তার চেয়ে খেলাটাই বন্ধ রাখা ভালো নয় কি?
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক