জনশুমারি ২০২২ : প্রসঙ্গ কথা

ড. মো. আইনুল ইসলাম প্রকাশিত: আগস্ট ১, ২০২২, ০৬:১৬ পিএম

২৭ জুলাই, বুধবার, রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলনকেন্দ্রে প্রকাশ করা হলো ‘জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২’-এর প্রাথমিক প্রতিবেদন। স্বাধীন বাংলাদেশে এটি ষষ্ঠ জনশুমারি। বাংলাদেশে প্রথম আদমশুমারি অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৪ সালে। তারপর দ্বিতীয়টি হয় ১৯৮১ সালে, তৃতীয়টি ১৯৯১ সালে, চতুর্থটি ২০০১ সালে এবং পঞ্চমটি ২০১১ সালে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) গত ১৫ জুন থেকে সারা দেশে এই জনশুমারি পরিচালনা করে। শেষ করার কথা ছিল ২১ জুন, কিন্তু উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বন্যার কারণে সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও নেত্রকোনায় শুমারির কার্যক্রম ২৮ জুন পর্যন্ত বর্ধিত করতে হয়। বিবিএসের এই প্রতিবেদন চূড়ান্ত নয়, প্রাথমিক, কিন্তু তথ্যবহুল। আগামী তিন মাসের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) কর্তৃক শুমারি-পরবর্তী যাচাই জরিপের (পিইসি) কাজটি সম্পাদন করার পর তা চূড়ান্তভাবে প্রকাশ করা হবে। ধারণা করা হচ্ছে, তাতে এবারের ডিজিটাল পদ্ধতিতে গণনা করা হলেও যাচাই শেষে প্রকাশিত জনসংখ্যা ২ থেকে আড়াই শতাংশ বাড়তে পারে। কেননা, গত ৫টি শুমারিতে শুমারি-পরবর্তী যাচাই জরিপে জনসংখ্যা বেড়েছিল গড়ে ৪ শতাংশ। এই শুমারিকার্য সমাধা করতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা।

একটি দেশের জন্য জনশুমারি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দেশের খাদ্যসহ বিভিন্ন পণ্যের চাহিদা নির্ধারণ, উন্নয়ন প্রকল্প পরিকল্পনা, প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা, জেলা-উপজেলা-ইউনিয়নভিত্তিক উন্নয়ন-কাঠামো পরিকল্পনা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়া-পদ্ধতি, কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে শুমারিতে প্রকাশিত তথ্যের ওপর নির্ভর করতে হয়। এমনকি এর রাজনৈতিক গুরুত্বও অনেক। কেননা, এই শুমারিতে উঠে আসবে জনগোষ্ঠীর কত অংশ ভোটার, নির্বাচনে জনগোষ্ঠীর কোন অংশের কেমন প্রভাব থাকবে এবং সেই প্রভাবকে নিজেদের অনুকূলে আনতে রাজনৈতিক দলগুলো নীতি ও কৌশল অবলম্বন করে থাকে। তাই রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাষ্ট্রিক সব বিবেচনাতেই এই কাজটি দক্ষ ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন করার দাবি রাখে। তথ্য সংগ্রহ, তথ্য সংকলন ও তথ্য প্রকাশই তিনটি কাজ অত্যন্ত সুচারুভাবে সম্পাদন করতে হয়। এই সত্যকে মেনে নিলে বলতেই হয় যে শুমারির জন্য যে সময়টাকে বেছে নেওয়া হয়েছে, তা যথার্থ নয়। এ সময়ে বর্ষাকাল চলছে। বর্ষাকালে বিভিন্ন অঞ্চল প্লাবিত হয় এবং এবারেও হয়েছে। এর ফলে তথ্য-সংগ্রাহকদের কাজ বাধাগ্রস্ত হয়। প্রতিটি খানার (household) সুনিপুণ তথ্য নিশ্চিত করা যায় না। শীতের মৌসুম হচ্ছে জনশুমারির উৎকৃষ্ট সময়। বিবিএস এই সময়টাকে পরিহার করতে পারলে ফলাফল আরও ভালো পাওয়া যেত বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

সদ্য সমাপ্ত জনশুমারির সার্বিক পর্যালোচনা করতে গেলে প্রথমেই আপনি হোঁচট খাবেন। তথ্যবিভ্রান্তি আপনার মধ্যে বিস্ময় সৃষ্টি করবে। প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে আমাদের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬ জন। এরপরই লিঙ্গ অনুসারে পরিসংখ্যান দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে যে বর্তমানে নারীর সংখ্যা ৮ কোটি ৩৩ লাখ ৪৭ হাজার ২০৬ জন; পুরুষের সংখ্যা ৮ কোটি ১৭ লাখ ১২ হাজার ৮২৪ জন; আর হিজড়ার (যাদের আমরা তৃতীয় লিঙ্গ বলি) সংখ্যা ১২ হাজার ৬২৯ জন। আমরা যদি লিঙ্গওয়ারি যোগফল করি তাহলে সংখ্যাটা দাঁড়ায় ১৬ কোটি ৫০ লাখ ৭২ হাজার ৬৫৯জন যা প্রকাশিত মোট জনসংখ্যার চেয়ে ৮৫ হাজার ৯৫৭ জন কম। তাহলে প্রশ্ন আসে এই অতিরিক্ত প্রায় ৮৬ হাজার জনসংখ্যা কোন লিঙ্গের?

ফুট নোট:

জনশুমারির তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো নারীর সংখ্যা পুরুষকে ছাড়িয়ে গেছে। পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা প্রায় ১৬ লাখ ৩৪ হাজার জন বেশি। অর্থাৎ প্রতি ১০০ জন নারীর বিপরীতে পুরুষের সংখ্যা ৯৮ জন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিকভাবেই নারীর আয়ুষ্কাল পুরুষের চাইতে বেশি। তা ছাড়া কেউ কেউ মনে করেন, বিদেশে কর্মরতদের মধ্যে নারীর চাইতে পুরুষের সংখ্যা বেশি। গণনার ত্রুটির কারণে অনেক পুরুষের নাম বাদ পড়তে পারে।তাই নারীর সংখ্যা বেড়েছে। তারপরও তথ্যের সত্যতা আছে বলেই মনে করি। আধুনিক শিক্ষা গ্রহণ ও দানের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের প্রতি আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এখনো বৈষম্যমূলক। দৃষ্টিভঙ্গির এই বৈষম্য দূর করতে পারলে আগামীতে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ আরও বৃদ্ধি পাবে। সে ক্ষেত্রে কর্মস্থলগুলোর পরিবেশ অধিকতর নারীবান্ধব করার দাবি রাখে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ২০১৪ সালে এ দেশের বস্তিবাসীদের নিয়ে একটি শুমারি করে। তাতে দেখা গিযেছিল বস্তিতে বসবাসকারীদের সংখ্যা ২২ লাখ। নতুন শুমারিতে সেই সংখ্য ৪ লাখ কমে ১৮ লাখে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ভাসমান মানুষের সংখ্যা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। ২০১১ সালের শুমারিতে ভাসমান মানুষের সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছিল ১ লাখ ৪৭ হাজার ৬৭৪ জন। নতুন শুমারিতে সেই সংখ্যা কমে দাঁড়িযেছে মাত্র ২২ হাজার ১৮৫ জনে। ধারণা করা হচ্ছে, এই দুই শুমারির যেকোনো একটি ত্রুটিপূর্ণ তথ্য দিচ্ছে, যদিও একই সংস্থা শুমারি দুটির কাজ সম্পন্ন করেছে। একান্নবর্তী পরিবারগুলো ক্রমাগতভাবেই ভেঙে যাচ্ছে। নতুন শুমারিতে পরিবার বা খানার সংখ্যা বলা হয়েছে ৪ কোটি ১০ লাখের কিছু বেশি। ২০১১ সালের শুমারিতে খানার সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ২১ লাখ ৭৩ হাজার। শুমারিতে দেখা যাচ্ছে যে, পরিবারের সংখ্যা বাড়লেও পরিবারের আকার ছোট হয়ে যাচ্ছে। ২০১১ সালের শুমারিতে পরিবারগুলোতে গড় সদস্য সংখ্যা ছিল ৪ দশমিক ৫ জন। এবারে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪ জনে। নির্ভরশীলতার ক্ষেত্রে বলা যায়, এখনো গ্রামের মানুষের নির্ভরশীলতার হার শহরের চাইতে বেশি। সামগ্রিক নির্ভরশীলতা কমে ৫৩ শতাংশে নেমে এসেছে। এখন প্রতি ১০০ জন মানুষের ওপর ৫৩ জন মানুষ নির্ভর করছে। বাবা-মা উভয়ের উপার্জনের প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে এমনটি হচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দেশে বসবাসকারী জনসংখ্যার মধ্যে গ্রামের অংশ এখনো বেশি। তবে গ্রামে বসবাসকারীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কমেছে। আগের শুমারিতে গ্রামে বসবাসকারীর সংখ্যা ছিল ১১ কোটি ৪৭ লাখ, বর্তমান শুমারিতে সেই সংখ্যা ১১ কোটি ৩০ লাখ। সেই তুলনায় শহরে বসবাসকারীর সংখ্যা বেড়েছে। ২০১১ সালের শুমারিতে শহরে বসবাসকারীর সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৫০ লাখ। বর্তমান শুমারিতে দেখা যাচ্ছে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ কোটি ২০ লাখে। করোনাকালে আমরা একটি চিত্র দেখেছি, যেখানে মানুষ কাজ হারিয়ে শহর থেকে গ্রামমুখী হয়েছিল। সেই অবস্থার উন্নতি হয়েছে বলে শুমারির ফলাফলে মনে হয়। মানুষের শহরমুখী হওয়ার প্রবণতা আগের মতোই আছে।

সমগ্র জনগোষ্ঠীর আকার বেড়েছে প্রায় ২ কোটি ১২ লাখ। তার মধ্যে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সদস্য সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৬৪ হাজার। ২০১১ সালের শুমারিতে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সদস্য সংখ্যা ছিল ১৫ লাখ ৮৬ হাজার, এবার তা হয়েছে ১৬ লাখ ৫০ হাজার। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশে সাক্ষরতার হারও বেড়েছে। প্রায় এক দশক আগের শুমারিতে দেশের ৭ বছর বা তার বেশি জনসংখ্যার ৫২ শতাংশ সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন ছিল। এবারের শুমারিতে সাক্ষরতার হার প্রকাশ পেয়েছে ৭৫ শতাংশ। এর মধ্যে পুরুষের সাক্ষরতার হার প্রায় ৭৭ শতাংশ এবং নারীদের বেলায় তা ৭৩ শতাংশ। সাক্ষরতা বৃদ্ধির হার সন্তোষজনক হলেও প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার প্রবণতা কমেনি। সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।

শুমারির ফলাফলে দেখা যাচ্ছে দেশে বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান এবং হিন্দুধর্মাবলম্বীদের অনুপাত কমে যাচ্ছে। ২০১১ সালে বৌদ্ধধর্মাবলম্বী মানুষের সংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার শূন্য দশমিক ৬২ শতাংশ। এবারে তা কমে হয়েছে শূন্য দশমিক ৬১ শতাংশ। খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীদের বেলায় তা শূন্য দশমিক ৩১ শতাংশ থেকে কমে শূন্য দশমিক ৩০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ২০১১ সালের শুমারি অনুযায়ী দেশে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার ৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ। ২০২২ সালের শুমারিতে দেখা যাচ্ছে সেই হার ৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ। কমে যাওয়ার এই প্রবণতা নতুন নয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে দেশে প্রথম শুমারি হয়। সে সময়ে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ। দ্বিতীয় শুমারি হয় ১৯৮১ সালে। সেই সময়ে অনুপাত কমে দাঁড়ায় ১২ দশমিক ১ শতাংশে। ১৯৯১ সালের তৃতীয় শুমারিতে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের অনুপাত কমে দাঁড়ায় ১০ দশমিক ৫ শতাংশে। ২০০১ সালে এই হার ছিল ৯ দশমিক ২ শতাংশ। এই কমে যাওয়ার প্রবণতা নিয়ে অনেক ধরনের মতামত প্রকাশিত হচ্ছে। তবে ২০১১ সালের জরিপের প্রতিবেদনে দুটি কারণের কথা উল্লেখ করা হযেছিল: এক. হিন্দুধর্মাবলম্বীদের আউট মাইগ্রেশন হচ্ছে, অর্থাৎ যেকোনো কারণেই হোক অন্যত্র বসতি স্থাপনে স্বস্তি বোধ করছে; দুই. মুসলমানদের তুলনায় হিন্দুধর্মাবলম্বীদের পারিবারিক প্রজনন হার কম; তারা কম সন্তান জন্মদানে আগ্রহী।

আগেই বলেছি যে, জনশুমারি একটি বিশাল কর্মযজ্ঞ, যা প্রতিবছর করা যায় না। গড়পড়তা প্রতি এক দশকে একবার এই শুমারিকর্মটি সমাধা করা হয়। এই জরিপের ওপর ভিত্তি করেই আগামী ১০ বছরের বাংলাদেশ বিনির্মাণের পরিকল্পনা করা হবে। তাই এর তথ্যবিভ্রান্তি দূর করা জরুরি। আমরা আশা করব জনশুমারি-পরবর্তী যাচাইয়ের (পিইসি) কাজটি যেন আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে করা হয়। তাহলে বিচ্যুতির পরিমাণ সন্তোষজনক পর্যায়ে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে, যা নীতিনির্ধারকদের নীতিনির্ধারণে সহায়ক ও কার্যকর হবে।


লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বভিাগ, জবি ও সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি