বেশ ক’বছর আগে স্থানীয় একটি পত্রিকা অফিসে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। সংশ্লিষ্টজনেরা কাজ করছিলেন। কাজের ফাঁকে ফাঁকে যথারীতি নানা বিষয়ে আলোচনা। এরই মধ্যে এক জুনিয়র তার দাপ্তরিক দায়িত্ব শেষে জানাল, এখন সে তার অনলাইন নিউজ পোর্টালে কিছু নিউজ দেবে। কথা প্রসঙ্গে জানাল, সে একাই তিন-তিনটি অনলাইন চালায়। সেগুলোর মালিকানাও তার। একসঙ্গে এতগুলো অনলাইনের কী দরকার, প্রশ্নে সে উত্তর খোলাসা না করে স্রেফ বলল, “দরকার আছে!” এই ‘দরকার আছে’ শব্দযুগলে যতটা ছিল রহস্য, তারচেয়ে বেশি ছিল অন্য কিছু। সততার অনুপস্থিতি টের পেয়েছিলাম, যদিও সেটা ছিল ব্যক্তিক এবং তাৎক্ষণিক ভাবনা। এরপর আরেকটু অবাক হয়েছিলাম, যখন জানলাম কেবল তার ছোট্ট এলাকাতেই অন্তত ২০-২৫টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল রয়েছে। ওগুলোতে জনবল বলতে নির্দিষ্ট ক’জন, মানুষজন লাগে না। সংবাদও সংগ্রহ করতে হয় না; সংবাদ নাকি আপনা থেকে চলে আসে। তথ্যগুলো জানাতে রহস্যময় হাসি ফুটেছিল তার ঠোঁটে।
সময়টা ছিল যত্রতত্র অনলাইন নিউজ পোর্টাল চালুর। এরপর অনেক দিন গত হয়েছে। কিছুদিন আগে জানলাম, সেই জুনিয়রের নিজস্ব নিউজ পোর্টালগুলো আর নেই, বন্ধ হয়ে গেছে। জোশে কিংবা ভিন্ন উদ্দেশ্যে চালু করা অনলাইনগুলো টিকতে পারেনি। একই বিষয়ে একাধিক অনলাইন চালুর পর তার উদ্দিষ্টজন হয়তো উদ্দেশ্য ধরতে পেরেছিল; কে জানে!
সেই জুনিয়রের কথা বাদ দিলাম। এমন কিংবা অন্য উদ্দেশ্যে সারাদেশে অসংখ্য অনলাইন নিউজ পোর্টাল চালু হয়েছে, বন্ধ হয়েছে অনেকগুলো এবং এখনও চালু থাকার সংখ্যাও অগণন। অনেক অনলাইন স্রেফ যথেচ্ছাচারের। কিছু উদ্দেশ্য অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, কিছু অপপ্রচারের, আর কিছু উদ্দেশ্য রগরগে শিরোনাম দিয়ে পাঠক আকৃষ্টের। এখানে বাণিজ্যের যোগ আছে, অস্বীকার করার উপায় নেই। এই বাণিজ্যে অঘোষিত জিম্মিকরণ প্রক্রিয়াও আছে নিঃসন্দেহে!
ঘরে-ঘরে অনলাইন, এমন একটা আওয়াজও উঠেছিল একসময়। ওই সময় আমরা যারা অনলাইন গণমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত, তারা বিব্রতকর পরিস্থিতিতেও পড়তাম। এত এত অনলাইনের ভিড়ে কে কতখানি যোগ্য, কার সততা কতখানি, এ নিয়েও অনেকের মধ্যে প্রশ্ন ছিল। বিব্রতকর সেই পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটেনি যদিও পুরোপুরি এখনও, তবে ইতোমধ্যে কিছু অনলাইন নিউজ পোর্টাল নিজেদের স্বাতন্ত্র্যের সাক্ষর রেখেছে। লেখক হিসেবে, সম্পাদক হিসেবে, সাংবাদিক হিসেবে এখন অনেকেই অনলাইন গণমাধ্যমের পরিচিতি দিতে পারছেন।
দেশে বর্তমানে ঠিক কতটি অনলাইন গণমাধ্যম রয়েছে সে তথ্য আনুষ্ঠানিকভাবে নেই। তবে বছর ছয়েক আগে সরকার যখন অনলাইন গণমাধ্যমের নিবন্ধনের প্রক্রিয়া শুরু করে এরপর ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে সংসদে সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক বলেছিলেন, “দেশে অনলাইন সংবাদপত্রের হালনাগাদের কোনো তালিকা সরকারের কাছে নেই। তবে দুই হাজার ১৮টি অনলাইন নিবন্ধনের আবেদন করেছে।” নিবন্ধনের সেই প্রক্রিয়া এখনও সম্পন্ন হয়নি সরকারের। তবে এরমধ্যে সরকার শতাধিক অনলাইনকে নিবন্ধনের অনুমতি দিয়েছে। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাকে দিয়ে চালানো হচ্ছে অনুসন্ধান। তারা যেমন ধীর গতিতে কাজ করছে, সরকারও তেমন ধীর গতিতে তাদের সিদ্ধান্ত দিচ্ছে। যদিও এই প্রক্রিয়া-সিদ্ধান্ত সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। অংশীজন হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে কিছু বিষয়ে আমারও যোগ থাকায় প্রক্রিয়া ও ধরন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছি আগেই। এর বাইরে আছে নিবন্ধনের অনুমতি পাওয়া অনেক অনলাইন নিউজ পোর্টাল যারা হালনাগাদ নয়, বলা যায় কালেভদ্রে সংবাদ পরিবেশন করে থাকে!
নিবন্ধিত এবং অনিবন্ধিত অনেক অনলাইন নিউজ পোর্টাল চালু আছে অন্তর্জালে। প্রক্রিয়া যখন চলমান তখন অনিবন্ধিতদের বন্ধ করাও যাবে না। তবে এই হাজার-হাজার অনলাইনের মধ্যে হাতেগোনা কিছু অনলাইন ছাড়া বেশির ভাগই কোনো সংবাদের নির্ভরযোগ্য সূত্র হতে পারছে না। অনলাইন গণমাধ্যমের চেনা চরিত্র ‘সবার আগে সংবাদ’ দিতে গিয়ে অনেকেই তালগোল পাকিয়ে ফেলছেন। ফলে অনেক অনলাইনকে মূল বিষয়কেই বাদ দিতে দেখা যায়। অনেকেই স্রেফ ‘ভাইরাল’ হতে গিয়ে এমন তথ্য ও শিরোনাম পরিবেশন করেন এবং এরপর অসত্য প্রমাণের পর মুছে দিতেও বাধ্য হন। এটা একদিকে যেমন পাঠকের সঙ্গে প্রতারণা, অন্যদিকে পেশাদারত্বের অবমাননা। এখানে তাই ‘সবার আগে সংবাদ’ শীর্ষক ধারণার বদলে ‘সবার আগে সঠিক সংবাদ’ স্লোগান ধরা উচিত। এতে করে প্রতিষ্ঠানের প্রতি পাঠকের যেমন আস্থা বাড়বে, তেমনি অনলাইন সাংবাদিকতার প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা বাড়বে।
ডিজিটাল বাংলাদেশে স্রেফ অনলাইন গণমাধ্যমভিত্তিক প্রতিষ্ঠানই গড়ে ওঠেনি, অনলাইনের জয়জয়কারের এই সময়ে প্রতিটি মুদ্রিত সংবাদপত্র তাদের অনলাইন ভার্সন চালুর পাশাপাশি প্রতিযোগিতামূলকভাবে সংবাদ পরিবেশন করছে। পাশাপাশি তাদের মুদ্রিত সংবাদপত্রের সংবাদের ধরনও বদলে নিয়েছে। অনলাইনের কারণে পাঠক যখন তাৎক্ষণিক সংবাদ পেয়েই যাচ্ছে যখন, তখন তারা মুদ্রিত সংবাদপত্রে সংবাদের পরের অংশ অথবা ভেতরের খবর নিয়ে আসার চেষ্টা করছে। এতে পাঠক উপকৃত হচ্ছেন নিশ্চিতভাবেই।
দেশে হাজার-হাজার অনলাইন নিউজ পোর্টালের অস্তিত্ব থাকলেও সঠিক ও বিশ্বাসযোগ্য তথ্যের জন্যে প্রকৃত ও সচেতন পাঠককে খুব কমসংখ্যক নিউজ পোর্টালের ওপর আস্থা রাখছেন। দায়িত্বশীলতা ও পেশাদারত্ব বজায় রেখে সেই নিউজ পোর্টালগুলো সংবাদ পরিবেশন করছে ঠিক, তবে এর বিপরীতে আছে অগণন নিউজ পোর্টাল যাদের কাজই হচ্ছে রগরগে-মুখরোচক শিরোনামের সঙ্গে গুজব ছড়ানো। সচেতন নন এমন পাঠকের সংখ্যা বেশি হওয়ায় স্রেফ শিরোনামেই বিভ্রান্ত হন বেশির ভাগ। ফলে উস্কানির কাজ করে সেগুলো।
মানুষের হাতে-হাতে মোবাইল, মোবাইলে-মোবাইলে ইন্টারনেট; এমন অবস্থায় গুজব-নির্ভর সংবাদ ওয়েবসাইট নিয়ে কাজ করা উচিত। পাশাপাশি সরকারের নিবন্ধন প্রক্রিয়া স্বচ্ছ করা উচিত। অনুসন্ধানে দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভিন্ন সংস্থার লোকজনেরা স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় প্রকৃত অনলাইন নিউজ পোর্টাল নিয়ে কাজ করছেন কি না সেটা নিশ্চিত করা দরকার।
এই শতকের গোড়ার দিকে সাংবাদিক আলমগীর হোসেনের হাত ধরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের যে যাত্রা তার পথ ধরে এখন অনেক অনলাইন গণমাধ্যম দেশে। দিন দিন নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান যেমন আসছে ঘটা করে, তেমনি নীরবে অনেকেই হারিয়ে যাচ্ছে। যারা টিকে আছে তাদের সৎ সাংবাদিকতার পরিবেশ নিশ্চিতের দরকার। সেন্সরশিপ-সেলফ সেন্সরশিপসহ সরকারি-বেসরকারি-করপোরেট প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য যে সকল বিধিনিষেধ আছে সেগুলো সততার সঙ্গে মোকাবেলা করা দরকার।
সংবাদ প্রকাশ-এর শুরু দিন থেকে আমি নানা বিষয় নিয়ে কলাম লিখে আসছি। নিউজ পোর্টালটি সত্যনিষ্ঠ, বস্তুনিষ্ঠ ও পরিচ্ছন্ন খবর পরিবেশন করে আসছে প্রথম দিন থেকেই। এর যেকোনো টেক্সট বা ভিডিও কনটেন্ট পর্যালোচনা করলেই তা সহজে অনুমান করা যায়। কারণ এর পেছনে কাজ করছে একদল সৎ ও কর্মঠ তরুণ মেধাবী কর্মী। তাদের পেশাদায়িত্ব অন্যদের জন্য উদাহরণ হতে পারে। এভাবে সততার সঙ্গে এগিয়ে গেলে ‘সংবাদ প্রকাশ’ একদিন গণমানুষের সত্যিকারের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর হয়ে উঠবে। এই পোর্টালটি যথেচ্ছাচারের নয়, দায়িত্বশীলতার অনলাইন। গণমাধ্যমটি যে টিকে থাকতে এসেছে, তা আমার দীর্ঘ লেখালেখির অভিজ্ঞতার আলোকে দৃঢ়ভাবে বলতে পারি। সংবাদ প্রকাশ-এর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে শুভেচ্ছা। সৎ সাংবাদিকতার জন্যে অভিনন্দন।