‘বিশ্রাম’ শব্দটা খুব ভদ্র গোছের। সেই শব্দটারই যথার্থ প্রয়োগ করা হয়েছে জিম্বাবুয়ে সিরিজে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে দলের বাইরে রাখার সময়। টেলিভিশন রিপোর্টারদের সাউন্ড বাইটে স্পষ্ট কানে বাজে— মাহমুদউল্লাহকে রেস্ট দেয়া হয়েছে। ওর সাথে আলোচনা করেই।’ আনুষ্ঠানিকতার মোড়কে যাই বলা হোক, আসলে টি-টোয়েন্টি দলের অধিনায়কত্ব হারিয়ে মাহমুদউল্লাহ দল থেকেই বাদ পড়েছেন।
নিজের ব্যাটে রান নেই। দলের সাফল্য নেই। তাহলে তাকে দলে রাখবেন কীভাবে! কিন্তু তারপরও মাহমুদউল্লাহ দলে থাকতে চাইছিলেন! না হলে নির্বাচক, বোর্ডকর্তাদের সঙ্গে মিটিংয়ের দরকার ছিল কি তার? গত জিম্বাবুয়ে সফরেই যিনি টেস্টে সেঞ্চুরি করেই ‘অবসরে’র ঘোষণা দিয়েছিলেন, তিনি কেন টি-টোয়েন্টিতে পারফর্ম করতে না পারার পরও অধিনায়কত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিতে পারলেন না। বা দিলেন না! এই মাহমুদউল্লাহ অধিনায়ক নন। কয়েক ধাপ নেমে শুধু ক্রিকেটার হয়ে থাকতে চাইছিলেন! ১১৮ টি-টিয়োন্টি খেলা মাহমুদউল্লাহর প্রতি রাগ-ক্ষোভ-অনুরাগ-বিরাগ- আবেগের বশে এ কথাগুলো লেখা নয়। বরং একজন ক্রিকেটার যখন নিজের অবস্থান থেকে নিচের দিকে নেমে যাচ্ছেন, বুঝতে পারার পরও নড়েচড়ে বসেন না, তখন যে কোন ক্রিকেট লিখিয়ে কথাগুলো বলবেন। তবে যদি কেউ ক্রিকেট বাদ দিয়ে, ক্রিকেটারকে ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ-অপছন্দের তালিকায় রাখেন, তাহলে ভিন্ন কথা।
অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ ও ক্রিকেটার মাহমুদউল্লাহ বেশ কিছুদিন সংকটের মধ্যে দিয়েই যাচ্ছিলেন। সেই সময় তার ব্যাট কিংবা মানসিকতা কোন কিছুই ডানা মেলে তাকে আড়াল করতে পারেনি। এরকম একটা অবস্থায় তিনি নিজেই দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়াতে পারতেন। সেটা করলে, সমালোচকরাই ধুলোয় লুটোতো! হয়তো তারপরও আপনি দলে জায়গা হারাতেন। কিন্তু তাতে কী হতো! আপনার জন্য কী জাতীয় দলের দরোজা চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যেতো! মনে হয় না। কারণ, আপনি অসম্ভব প্রতিভাবান না হলেও, প্রচণ্ড পরিশ্রমী। গভীর খাদের কাছে দাঁড়িয়েও অসম্ভবকে ছোঁয়ার চেষ্টা করা মানুষ আপনি। অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড-ইংল্যান্ডে কী সব দুর্দান্ত ইনিংস খেলছেন মাহমুদউল্লাহ দলের গভীর সংকটে। তাকে নিয়ে অন্যদের চিন্তাকেও তিনি নাড়িয়ে দিয়েছেন পারফরম্যান্স দিয়ে। কিন্তু টি-টিয়োন্টি ক্রিকেটে এখন একজন ক্রিকেটারের কাছে যা দাবি করে, ছত্রিশে দাঁড়িয়ে সেটা মাহমুদউল্লাহর দেয়ার সামর্থ্য আছে কি না তাও বিবেচ্য। তবে তিনি যে চেষ্টাটা করেন, তা মনপ্রাণ দিয়ে করেন। কিন্তু দলকে যে তিনি টানতে পারছিলেন না তা করুণভাবে বেরিয়ে পড়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজে। সেটা বুঝতে তার কেন এত সময় লাগাল!
মানুষ হিসেবে মাহমুদউল্লাহ একটু অর্ন্তমুখী। তারপরও তার কাছের দুয়েকজন কাছের মানুষের কাছ থেকে কী আভাস পাননি কী হতে যাচ্ছে! তার অধিনায়কত্বের মৃত্যু নিশ্চিত, গণমাধ্যমে এমন খবরের পরও কেন আকড়ে পড়েছিলেন মাহমুদউল্লাহ? নাকি সারিয়ে না দিলে সরবো না এমন একটা পণ করেছিলেন? ছত্রিশ বছর বয়সে এসেও যার আত্মগর্ব করার মত যথেষ্ট কিছু আছে, তিনি কেন বোর্ডের ‘বিশ্রাম’ নামক এই অপমানজনক পরিস্থিতির মধ্যে পড়লেন! নাকি অধিনায়ক থাকার প্রলোভন তার কাছে ক্রিকেট গর্বের চেয়ে আকর্ষক মনে হয়েছিল। আসলে এটা হচ্ছে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার অক্ষমতা।
আপনাকে আরও অক্ষম আর অসহায় বানিয়ে দল থেকে সরিয়ে দেয়া হলো। আপনি নিজে প্রেসকে যে কথাগুলো বলতে পারতেন, সেটা বললেন বোর্ডকর্তারা। আপনি নিজে বলতে পারতেন, ‘অধিনায়কত্ব করার সময় চেষ্টা করেছি দলকে সাফল্য এনে দিতে। কখনও পেরেছি। কখনও পারিনি। কিন্তু দলের সবার কাছে আমি কৃতজ্ঞ আমাকে সাহায্য-সহযোগিতা করার জন্য। অধিনায়ক হিসেবে নয়। শুধু একজন খেলোয়াড় হিসেবে এখনও আমি দলকে কিছু দিতে চাই। আমি বিশ্বাস করি সেই সামর্থ্য এখনও নিঃশেষ হয়ে যায়নি আমার।’
আসলে বাংলাদেশ ক্রিকেট এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে অধিনায়ক বদল। বাংলাদেশ এখন এমন একজন নেতা চায়, যে কয়টা ম্যাচ জেতাবে তা নয়, বিবেচনা করবে, কে পেশাদারি চিন্তায় দলটাকে দীক্ষিত করবে। সে কারণে হয়তো দলে নতুন রক্তের সঞ্চালন। তারুণ্যের হাতে নেতৃত্ব। তবে এসবের জন্য দরকার এমন একজন যার চিন্তাশক্তির ঔজ্জ্বল্য আছে। দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা আছে। নতুন অধিনায়ক নুরুল হাসান সোহান তার ক্রিকেটীয়বোধ, আর যোগ্যতা-দক্ষতা দিয়ে কোন পথে নিয়ে যান বাংলাদশে দলকে সেটা দেখার অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ ক্রিকেটে নতুন চিন্তার প্রয়োগে বাধা অনেক। এখানে অধিনায়কের হাত-পা অনেকাংশে বাঁধা। এখানে রিমোট কন্ট্রোলিং ক্যাপ্টেন্সি। তবুও সোহানের জন্য শুভেচ্ছা।
লেখক: সিনিয়র জার্নালিস্ট