সৌন্দর্য বর্ধনে নিজের রুচি-অভিরুচিকে প্রাধান্য দিয়ে নারী-পুরুষ উভয়ই পোশাক পরে। তবে পোশাক পরার ক্ষেত্রে পুরুষের রয়েছে অবারিত স্বাধীনতা। আর নারীদের ক্ষেত্রে সীমাহীন বিধিনিষেধ। পুরুষতন্ত্রের কষাঘাতে নারীদের জীবনে নিজ মত-পথের গুরুত্ব দেওয়াও যেন দায়। পান থেকে চুন খসলেই পুরুষতন্ত্রের কটূক্তির শিকার নারীকেই হতে হয়। সমাজব্যবস্থা এমনভাবে গড়ে উঠেছে, যে আজও আমরা মধ্যযুগীয় বর্বর চিন্তাধারা থেকে বের হয়ে আসতে পারছি না। নারীর জীবনযাপন, পোশাক-পরিচ্ছদের ওপর শৃঙ্খল পরিয়ে তাকে ঘরকুনো করে রাখার পক্ষেই যেন অধিকাংশের মত।
পুরুষের ক্ষেত্রে না রয়েছে জীবনযাপন নিয়ে প্রশ্ন, না রয়েছে পোশাক-পরিচ্ছদ নিয়ে কটূকথা। কিন্তু নারীরা পথে বেরুলেই পোশাক নিয়ে বাজে মন্তব্য শোনেননি, এমন নারীর সংখ্যা মনে হয় না আছে! সে হোক শাড়ি, জিন্স, টপস বা সালোয়ার-কামিজ। কারণ রুচি তো প্রত্যেক মানুষের কখনোই সমান নয়। তাই যিনি একটু বেশি আধুনিকতার ছোঁয়া পুষ্ট তার কাছে শাড়িটাও ব্যাকডেটেড হয়ে ওঠে, আবার যিনি বা যারা মধ্যযুগীয় চেতনা থেকে বের হতে পারেনি তার কাছে নারীর জিন্স-টপসেই সমস্যা। তাহলে নারীরা কোথায় যাবেন!
নিজের পছন্দ-রুচিকে গুরুত্ব দেবেন, না অন্যরা কী ভাববে, তা নিয়ে বসে থাকবেন! বয়সের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেও অনেকে পোশাক নির্ধারণ ও নির্বাচন করেন। তবে ব্যক্তি তার স্বাচ্ছন্দ্য অনুযায়ী, যেটাই পরিধান করুন না কেন, তা নিয়ে কথা বলার কারও কোনোই অধিকার নেই। স্বাধীন দেশে মানুষ স্বাধীন। তাই নিজের মত-পথের গুরুত্ব তিনি দেবেন, এটাই স্বাভাবিক। সেখানে বাজে মন্তব্য বা অশালীন আচরণ করা কোনোটাই কাম্য নয়। নারীর ক্ষেত্রে কতটা শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা হয়, তা সমাজের দিকে লক্ষ করলেই স্পষ্ট হয়। নারীর ক্ষেত্রে পোশাকের বিভাজনও করা হয়ে থাকে বিভিন্নভাবে। সধবা নারীরা যে পোশাক পরেন, বিধবা নারী, আবার তা পরিধান করতে পারবেন না! কী আজব সমাজের নিয়ম, কী আজব প্রথা!
নারীর জীবন কোনোদিনই সহজ ছিল না। সবসময়ই যুদ্ধ করেই তাকে টিকে থাকতে হয়। পরিবার-সমাজ নারীর জন্য শুধু শৃঙ্খলই তৈরি করেছে আজ অবধি। কিন্তু তলিয়ে দেখলে বোঝা কোথায় নারীর স্বাধীনতাটা মসৃণ হয়েছে! মনে হয় কোথাওই না! স্বামীর মৃত্যুর পর নারীকেই সহমরণে যেত হতো একসময়। আবার সহমরণ প্রথা ওঠার পর বিধবা নারীদের নিয়ে নানারকম প্রশ্ন তোলা হয়! একসময় বিধবাবিবাহ চালু হয়। মধ্যযুগ পার হলেও নারীর শৃঙ্খল ভাঙেনি। সবাই চাপিয়ে খুশি থাকে। পরিবার-সমাজ তাদের খুশি-সম্মান বজায় রাখতে ব্যক্তির আত্মাকে বিসর্জন দিতে বাধ্য করে অনেক সময়। সধবা নারীর ক্ষেত্রে যেমন পোশাক পরিধানে হাজারো ভালো-মন্দ কথা বিদ্যমান, ঠিক তেমনি একজন বিধবা নারী তার ক্ষেত্রেও কথার কমতি নেই।
পোশাক তো বাইরের আবরণ। তাহলে বাইরের আবরণকে নিয়ে কেনই বা এত হাঙ্গামা। সধবা নারী কিছু নির্দিষ্ট পোশাক পরবেন, বিধবা নারী কিছু নির্দিষ্ট পোশাক পরবেন। এই নিয়ম কে বানিয়েছে। বাইরের আবরণ দিয়ে নারীকে কেন অবরুদ্ধ করার ধান্দা সমাজের হোতাদের। কেনই বা নারীকে নিজ ইচ্ছেমতো বাস করতে দেওয়া হয় না আজও। একজন বিধবা নারী যিনি তার খুব কাছের এবং বিশ্বাসযোগ্য, ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে নিজেকে পৃথিবীর রুক্ষতার সঙ্গে টিকিয়ে রাখতে সচেষ্ট হন, তখন সেই নারীর পোশাক নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়। তিনি শুধু সাদা থান পরে ঘরে বসে না থেকে কোনো আর দশটা সাধারণ মানুষের মতো জীবন পালন করেন, এ নিয়ে প্রশ্ন! কিন্তু আমরা কি একটি বারও ভেবে দেখেছি, যার জীবনে সব হারিয়েছে সেই নারী নিজেকে ভালো রাখার ব্যবস্থা করুন। কেন তাকে সাদা থান দিয়ে, কালার বিহীন শাড়ি পরে, নাকফুল খুলে, কান ফুল ছেড়ে অর্ধমৃত থাকতে হবে! তবে কি সহমরণই শ্রেষ্ঠ ছিল?
প্রতিদিন তিলে তিলে মরার চেয়ে একদিনে সবশেষ। নারীদের কবে আমরা মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করবো? কবে নারীদের জীবনকে পরিচালনা করার জন্য সঠিকভাবে মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াবো! এই মধ্যযুগীয়-বর্বর, পচা-গলা সমাজ আর কতদিন আমাদের রক্ত চুষে খাবে? কতদিন আমরা ব্রিটিশ শাসনের ওই শাসনতান্ত্রিক চেতনা নিয়ে চলবো। কেউ তো কারও দাস নয়। আমরা প্রত্যেকেই মানুষ। স্রষ্টা জ্ঞান - বুদ্ধি-বিবেক দিয়েছেন। ফলে নিজেদের গোঁড়ামি ভেঙে আসুন মানুষকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করতে শিখি। শির উচ্চ করে বলি, আমরা মানুষ। আমরা নারী-পুরুষ ব্যতিরেকে আমরা মানুষ প্রথমে।
নারীর পোশাকের দিকে আঙুল তোলার আগে আঙুলটা নিজের দিকে তুলুন। বুঝতে সক্ষম হন। মানুষ স্বাধীন তাই ব্যক্তি তার স্বাচ্ছন্দ্যকে প্রাধান্য দেবেন এটাই স্বাভাবিক। আমি, আপনি কেউ নই, তার স্বাধীন তায় হস্তক্ষেপ করার। তাকে কটু কথা বলার। মনুষ্যত্বের- বিবেকের চর্চা করলে আশা করা যায়, একদিন সব অপশক্তি ধ্বংস হবে।
লেখক: শিক্ষক, নর্দার্ন বিশ্ববিদ্যালয়