জ্ঞানী-সংস্কৃতিমনারা বলেন বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। কথাটা শুনতে ভালো লাগে। স্বস্তি পাওয়া যায়। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। এই দেশে পান থেকে চুন খসলেই শুরু হয় সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বিষবাষ্প ছড়ানো। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ‘ধর্মানুভূতি’তে আঘাত হানার অভিযোগ ওঠে। সেই অভিযোগে উপাসনালয়ে আগুন দেওয়াসহ ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটে। এমনকি মানুষকে পিটিয়ে ও পুড়িয়ে মারার ঘটনাও বাদ যায় না।
জাতপাতের বিবেচনায় দেশে ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে সম্প্রীতির চেয়ে অসহিষ্ণুতা বেশি। আরও বেশি পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষ-ঘৃণা-ক্রোধ প্রকাশের ঘটনাও। প্রত্যেকেই নিজের ধর্মকে সেরা দাবি করে। হীন-নীচ-তুচ্ছ মনে করে অন্য ধর্মাবলম্বীদের। ফলে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, সমীহ ও সহিষ্ণুতার কিছুই আর অবশিষ্ট থাকে না।
আমাদের শিক্ষা-দীক্ষার পরিমাণ যত বাড়ছে, মনে হচ্ছে ততই মানুষ বিজ্ঞানবিমুখ হয়ে পড়ছে। ততই মানুষ ধর্মানুভূতিসর্বস্ব হয়ে উঠছে। এসব অনুভূতিসম্পন্নরা তাদের ধর্মগুরু কিংবা ধর্মীয় নেতাকে সব ধরনের দোষগুণের ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে গিয়ে তাদের ওপর দেবত্ব আরোপ করেন। তাদের কাছ থেকে সব মানবিক বৈশিষ্ট্য কেড়ে নিয়ে এক মহাজাগতিক কাল্পনিক মানসবিশ্ব সৃজন করেন। ওই কাল্পনিক মানসলোক সম্পর্কে কোনো যুক্তিবাদী কিংবা কোনো বাস্তববাদী মানুষ সামান্য প্রশ্ন তুললেই ক্ষেপে ওঠেন ‘অনুভূতিবাদীরা’।
এই অনুভূতিবাদীরা কেবল ধর্মীয় ভিন্নতার কারণেই পরস্পরের প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে, এমন নয়। একই ধর্মাবলম্বী হয়েও ভিন্নমত পোষণ করলেই বিপদ। প্রতিটি ধর্মেই রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন মত। এক মতের লোক অন্য মত সহ্য করে না। একমতের মুসলমানই অন্য মতের মুসলমানকে কাফের আখ্যা দিতেও কুণ্ঠিত হয় না। আবার এক মতের হিন্দুও অন্য মতের হিন্দুকে ধর্মচ্যুত বলতেও দ্বিধা করে না। অথচ ঈশ্বরবাদী প্রতিটি ধর্মের মূল বাণী একই। তারা প্রত্যেকেই স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাস করে। প্রত্যেকেই মনে করে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডসহ মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন একজন স্রষ্টা। কেবল তাদের কতিপয় শব্দের প্রকাশ-ব্যবহারে ভিন্নতা রয়েছে। যেমন মুসলমানদের কাছে যা আল্লাহ, তা-ই খ্রিষ্টানদের কাছে গড, হিন্দুদের কাছে ভগবান, বৌদ্ধদের কাছে প্রভু। মূলে কোনো সমস্যা বা বিরোধ নেই। বিরোধ এর ব্যাখ্যায়-বিশ্লেষণে। গ্রহণে-বর্জনে। দ্বন্দ্ব তাদের রুচি-মর্জি-মেজাজ-শিক্ষা-জ্ঞান-প্রজ্ঞায়।
ধর্মীয় বিষয়কে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতা-উসকানির পেছেনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। মোটা দাগে এগুলো হলো, ধর্মকে অনেকে ব্যক্তিগত আচরণীয় বিষয় থেকে প্রাতিষ্ঠানিক-রাষ্ট্রীয় পালনীয় বিষয়ে পরিণত করার চেষ্টা করেন।
ফলে বিষয়টি ব্যক্তিগত পর্যায়ে না থেকে সামষ্টিক রূপ লাভ করে। তখন গোষ্ঠীস্বার্থ প্রধান হয়ে ওঠে। স্বার্থের কারণে দ্বন্দ্বও প্রকট হয়ে ওঠে। গোষ্ঠীগত চর্চার কুফল হিসেবে ব্যক্তি নিজের ধর্মকে ঠিক ও অন্য ধর্মকে ভ্রান্ত মনে করে। এই ভ্রান্ত ও ঠিক মনে করা নিয়েই শুরু হয় সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ। ফলে তারা মানব পরিচয়ের চেয়ে ধর্মীয় পরিচয়কে বড় করে দেখে।
মানুষের ধর্মানুভূতিতে সবচেয়ে বেশি আঘাত দিয়ে কথা বলেন ‘তথাকথিত মুসলিম বক্তা’। বিভিন্ন ওয়াজের অনুষ্ঠানে তারা ইসলামও একেশ্বরবাদের মহিমা বর্ণনা করতে গিয়ে প্রতিমাপূজারিদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তাদের তাচ্ছিল্য করে উপস্থাপন করেন। এমনকি একদা কাবাঘরে থাকা ৩৬০টি মূর্তি ভাঙার কাহিনিও তারা বেশ গর্বের সঙ্গে বর্ণনা করেন। এই বর্ণনার সময় তারা একবারও ভেবে দেখেন না, যে কর্মের জন্য তারা নিজেদের বীরত্ব প্রকাশ করছেন, সেই কর্মই প্রতিমাপূজারিদের অনুভূতিতে গভীরভাবে আঘাত করছে। কিন্তু যাদের মনে আঘাত দেওয়া হচ্ছে, তারা সংখ্যালঘু বলে এসব বক্তব্যের প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছে না। অথবা তারা মুসলমানদের চেয়ে বেশি সহিষ্ণু বলে প্রতিবাদ করছে না। বিপরীতে মুসলমানরা তাদের কোনো ধর্মীয় নেতা প্রসঙ্গে কেউ সামান্য আপত্তি বা অভিযোগ তুললেই তারা ধর্মানুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ এসে রক্তারক্তির মতো ঘটনার জন্মদিতেও দ্বিধা করে না।
ভিন্ন ধর্ম ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের কটাক্ষকারীদের মধ্যে ভারতীয় বক্তা জাকির নায়েকসহ এমন অনেকের সন্ধান পাওয়া যাবে, যারা মানুষকে মানবতার পথের দাওয়াত দেন না। মানুষকে মঙ্গলচিন্তায় উদ্বুদ্ধ করেন না। নিজে যা জানেন, তাকেই ধ্রুবজ্ঞান দাবি করে স্রষ্টার কিংবা নিজ নিজ ধর্মীয় অবতারের নামে চালিয়ে দেন। দর্শন-ধর্মতত্ত্ব কিংবা শিল্প-নন্দনতত্ত্বচর্চা নিয়ে কোনো কথা বলেন না। উল্টো জিজ্ঞাসাতাড়িত মানুষকে সামাজিকভাবে বর্জনের হুমকি ও পারলৌকিক শাস্তির ভয় দেখিয়ে থামিয়ে দেন। আর সাধারণ মানুষ এসব হুমকি কিংবা শাস্তির ভয়ে না থামলে কতিপয় ধর্মীয় লেবাসধারী গুজব প্রচারে মেতে ওঠে। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ধর্মানুভূতিকে কাজে লাগিয়ে সমাজে গুজব রটিয়ে দেয় তারা। সেই গুজবের বলি হতে হয় কখনো ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কোনো নিরীহ ব্যক্তিকে, কখনো তাদের উপাসনালয়কে। আবার নিছক ভিন্নমত পোষণ করায় কিংবা ব্যক্তিগত স্বার্থের কারণে স্বধর্মের নিরীহ লোককেও এই স্বার্থান্ধ-ধর্মান্ধরা হত্যা করতেও ছাড়ে না।
উল্লিখিত মতে পক্ষে প্রমাণ চাইলে হাজির করা কঠিন হবে না। কয়েকটি ঘটনা এখানে তুলে ধরা হলো—২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ‘কোরআন অবমাননা করে ফেসবুকে ছবি পোস্ট’ করার অভিযোগ তুলে কক্সবাজারে রামুর ১২টি বৌদ্ধমন্দিরে আগুন দেওয়া হয়৷ এ সময় হামলা করা হয় বৌদ্ধদের বাড়িঘরেও।
২০১৬ সালের ২৯ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে ‘রসরাজ দাস নামের এক যুবক ফেসবুকে ধর্ম অবমাননাকর ছবি পোস্ট করেছে’—এমন অভিযোগ তুলে তাকে পিটিয়ে পুলিশে দেয় একদল যুবক। পরদিন এলাকায় মাইকিং করে নাসিরনগর উপজেলা সদরে আলাদা দুটি প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে অংশগ্রহণকারীরা নাসিরনগরে হিন্দুদের মন্দির ও বাড়িঘরে হামলা চালায়।
এত গেল অন্য ধর্মের লোকের সঙ্গে ধর্মান্ধ-গোঁড়াদের আচরণের বিবরণ। তারা মতের অমিল হলে স্বধর্মের আস্তিককেও যে ছাড়ে না, তারও নজির রয়েছে। ‘মুসলমান পরিচয়ধারী’ উন্মত্ত জনতা ২০২০ সালের ২৯ অক্টোবর লালমনিরহাটে শহিদুন্নবী জুয়েল নামের একজনকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগে পিটিয়ে হত্যা করে। কেবল হত্যা করেই থেমে থাকেনি তারা, জুয়েলের লাশ তারা আগুনেও পুড়িয়ে দেয়।
উল্লিখিত তিনটি ঘটনাই গুজব ছড়িয়ে ঘটানো হয়েছে। অর্থাৎ কতিপয় বেশধারী বাঙালি মুসলমান ন্যায়-নীতি-আদর্শ-ধর্মীয় মূল্যবোধের কোনো তোয়াক্কাই করে না। তারা নিজেদের মর্জিমতো গুজব ছড়িয়ে দেয়। আরেক দল অন্ধ অনুসারী সেই গুজবের হুজুগে মেতে ওঠে। তাদের এই উন্মত্ততার কবলে পড়ে প্রাণ যায় সব সময়ই নিরীহ-অসহায়দের।
এর পেছনে আরও একটি বড় কারণ হলো রাজনৈতিক। ভোটব্যাংক। সংখ্যাগুরুদের সাম্প্রদায়িক অপরাধের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক নেতারা প্রতিবাদ করেন না, তাদের চটাতে চান না। কারণ, তাদের ঘরেই রাজনৈতিক দলের সর্বাধিক ভোট রয়েছে। বিশাল জনগোষ্ঠীকে তাদের অপরাধের জন্য শাস্তি দিলে ভোটব্যাংকে ভাটা পড়বে। এর প্রভাব পড়বে নির্বাচনের ময়দানে। এ জন্য রাজনৈতিক দলগুলো সাম্প্রদায়িক উসকানি কিংবা বিদ্বেষের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়। উপরন্তু এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে তারা বিক্ষোভ সমাবেশ-মিছিল-জনসভাও করে বেড়ান। ফলে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক উসকানিদাতারা প্রশ্রয় পায়।
এই ধর্মান্ধতা থেকে দেশ-জাতিকে রক্ষা করতে হলে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। এই ধরনের অপকর্মের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে হবে। এরই অংশ হিসেবে প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষার পাঠ্যসূচি, সব জায়গায়ই এমন বিষয় যুক্ত করতে হবে, যেন প্রাথমিক স্তর থেকেই মানবতার প্রতি, ভিন্ন ধর্ম-মতাবলম্বীদের প্রতি শিশুমন সহিষ্ণু হয়ে ওঠে। পরিবার ও সমাজেও এই চর্চা অব্যাহত রাখতে হবে। একই সঙ্গে ধর্ম যে ব্যক্তিগত আচরণীয় বিষয়, রাষ্ট্রীয় বা প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার অনুষঙ্গ নয়, সেই শিক্ষা শৈশব থেকেই দিতে হবে। আর এ জন্য উদ্যোগ নিতে হবে এখনই। উপযুক্ত সময়ে উপযুক্ত উদ্যোগ না নিতে পারলে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ বন্ধ করা যাবে না। এই সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও উসকানি বন্ধে এখনই জনমত গড়ে তোলার পাশাপাশি সরকারিভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। না হলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ একদিন মহাশ্মশানে পর্যবসিতও হতে পারে।
আর একটা কথা। বেশির ভাগ সময়ই গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত ‘ধর্মানুভূতি’র খবরেই উগ্রপন্থীরা বেশি বিদ্বেষ ছড়ায়। ক্ষেপে ওঠে একজন আরেকজনের ওপর। তাই সাম্প্রদায়িক উসকানি বন্ধে সবচেয়ে বড় ভূমিকা নিতে হবে গণমাধ্যমকে। এই ধরনের খবর পাওয়া মাত্রই তা প্রকাশ না করে, তথ্য যাচাই করে নিতে হবে। আর মনে রাখতে হবে, সব ঘটনাই সংবাদমূল্য পেতে পারে না। বিশেষত যেই ঘটনা প্রকাশ পেলে দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের আশঙ্কা থাকবে, সেই সংবাদ প্রকাশে নিষ্ক্রিয় থাকাই হবে গণমাধ্যমের নৈতিক দায়িত্ব। দশ কপি পত্রিকা বেশি বিক্রির আশায়, এক হাজার হিট বেশির আশায় অনলাইন পোর্টাল, দশ হাজার দর্শক বেশি দেখার টিআরপির লোভ সামলাতে পারলেই এই ধরনের ঘটনা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা কমে আসবে। পাশাপাশি গণমাধ্যমগুলোকে এই সাম্প্রদায়িক উসকানির বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। তবেই দেশ থেকে চিরতরে বিলুপ্ত হতে পারে এমন ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও হানাহানি।
লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।