যেকোনো দেশের সামগ্রিক চালিকাশক্তি নির্ভর করে অর্থবছরের বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ওপর। তাই প্রতিটি দেশে নতুন অর্থবছরের শুরুতে সংসদে বাজেট পেশ ও পাস করা হয়। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। এরই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের ৯ জুন জাতীয় সংসদে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তিনি জানিয়েছেন, গতবছরের বাজেটের তুলনায় এবার ৯ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। তবে, নারীদের ব্যবহৃত নিত্য পণ্যের দাম বাড়তে পারে।
প্রস্তাবিত বাজেট অনুযায়ী নারী উন্নয়নে গত বছরের তুলনায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩০ হাজার ৮৯৭ কোটি টাকা বেশি বরাদ্দ করা হয়েছে। যা ২ লাখ ২৯ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকার। আগামী অর্থবছরের মোট বাজেটে জেন্ডার সম্পৃক্ত বাজেটের শতকরা ৩৩.৮৪ ভাগ। যা জিডিপির ৫.১৬ শতাংশ।
বাজেট সবসময়ই জনগণের কল্যাণার্থে। কিন্তু নারীর জন্য আলাদা করে বাজেট কেন প্রয়োজন? কারণ একটাই। নারীর জন্য সঠিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতকরণ। জেন্ডারবৈষম্য কমিয়ে আনতে নারীর জন্য যে বাজেট ঘোষণা হয়, তা সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করা হলে সমাজের উন্নয়ন অবশ্যই হবে।
চলতি অর্থবছরের তুলনায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন শিক্ষাখাতে টাকার অঙ্কে মোট বরাদ্দ বেড়েছে। নতুন বাজেটে ৯ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা বেশি বরাদ্দ হয়েছে। এই দুই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। শিক্ষাখাতে মোট বরাদ্দ অনুযায়ী নারীর উন্নয়নে জেন্ডার বাজেট পেশ করা হয়েছে। নারী উন্নয়নে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে ৩১ হাজার কোটি টাকা বাড়ানো হয়েছে। নারীর উন্নয়নে বাজেট বরাদ্দের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কতটা বাস্তবায়িত হলো। শিক্ষাখাত নারীর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। একজন নারী শত বাধা বিপত্তি থাকা সত্ত্বেও ঘুরে দাঁড়াতে পারে যদি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থাকে। সেক্ষেত্রে বর্তমান বাজেটে নারী শিক্ষা সুনিশ্চিত করার সঠিক পন্থাগুলো অবলম্বন করলে নারীর জীবনযাত্রা বদলাবে। স্কুল-কলেজে নারী শিক্ষার্থী বাড়লেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নারীবান্ধব নয়। এ বিষয়ে বর্তমান বাজেটের আলোকে নারীদের শিক্ষার পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষায় নারীদের জন্য যে বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হবে, তার সুষ্ঠু এবং সুষম বাস্তবায়নের মাধ্যমেই সম্ভব প্রস্তাবিত বাজেটকে সফল করা।
স্বাস্থ্য সব সুখের মূল। তবে নারীর স্বাস্থ্য নারীর তথা পরিবারের চালিকা শক্তিও বটে। পরিবারে মূল ব্যক্তি যদি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী না হন, তবে পরিবারটায় ভেঙে পড়ে। সন্তান-সংসারের দেখভাল ও জাতিকে পরিপূর্ণ সেবা দিতে তাই নারীর সুস্থতা জরুরি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে স্বাস্থ্যখাতে মোট বরাদ্দ বেড়েছে ৪ হাজার ১৩২ কোটি টাকা। কিন্তু নারীর স্বাস্থ্যসেবা যদি পূর্ণরূপে নিশ্চিত করা না যায়, তবে স্বাস্থ্য ঝুঁকি থেকেই যাবে। যা বিগত বছরগুলোতে বিশেষভাবে চোখে পড়েছে। তাই নারীর সুরক্ষায় সেবাদানের বিষয়ে সরকারি হাসপাতালগুলো যেন দায়িত্ব পালনে তৎপর থাকে, সেই লক্ষ্যে কর্মসূচি প্রণয়ন, বরাদ্দ ও তা বাস্তবায়ন করতে হবে। একইসঙ্গে চাহিদা অনুযায়ী নারী চিকিৎসকের পরিমাণ বাড়াতে হবে। এছাড়া প্রসূতি মা ও মেয়ে শিশুদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বিশেষ ভূমিকা রাখার জন্য মেডিক্যাল টিম গঠন করতে হবে। যদি নারীর জন্য সঠিক ও সুনিশ্চিত সেবা নিশ্চিত করা যায়, তবেই বাজেটের সঠিক বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।
করোনাকালে নারী-পুরুষ উভয়েই চাকরিচ্যুত হয়েছে। অনেকেই শহরের বাস উঠিয়ে গ্রামে যেতে বাধ্য হয়েছে। এ সব নারী করোনাকালে ও পরবর্তী সময়ে ক্ষুদ্র ব্যবসার মাধ্যমে নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নে তৎপর হয়েছে। নারীদের এই উদ্যমী শক্তিকে সরকারের পক্ষ থেকে অনুপ্রাণিত করে বাজেটের একটি অংশ তাদের জন্য বরাদ্দ করতে পারলে নারীর উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়।
নারীর জন্য জেন্ডার বাজেট যতটুকু বরাদ্দ হয়, সব খাতে তার সুষ্ঠু বণ্টন হলে নারী জাতি আগামী দিনে দেশ গঠনে আরও বেশি ভূমিকা রাখতে পারবে। ক্ষুদ্র, কুটির শিল্প, হ্যাচারি, পশু-পাখি পালন, খামারি, ছাগল পালন এসব বিষয়ে গ্রামীণ নারীদের পাশে বাজেট অনুযায়ী যদি সঠিকভাবে বরাদ্দ হয়, তবে দেশের জিডিপি বৃদ্ধিতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়বে।
নারীদের জন্য শিক্ষা যেমন নিশ্চিত করতে হবে, তেমনি তার উচ্চশিক্ষা নিশ্চিতেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। বাজেট অনুযায়ী একটি অংশ নারীর উচ্চশিক্ষায় ব্যয় করা এখন সময়ের দাবি। নারীর শিক্ষা সন্তান-পরিবার পরিজনকে সঠিক পথ দেখাতে সক্ষম। তাই নারীকে পিছিয়ে রাখলে চলবে না বরং দরিদ্র-নিপীড়িত নারীদের জন্য শিক্ষা ও বৃত্তির সমন্বয় করতে হবে। এখনো প্রাথমিক, মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে তবে সব নারীর জন্য বৃত্তি নিশ্চিত করা গেলে সেটা নারীদের শিক্ষা থেকে ঝরে যাওয়া রুখতে সক্ষম হবে। এজন্য স্কুল কমিটির পাশাপাশি স্থানীয় প্রতিনিধি এবং বিশেষ মনিটরিং টিম রাখতে হবে, যেন নারী-শিশুরা বঞ্চিত না হয়। তবেই শিক্ষার আলো ঘরে ঘরে জ্ঞানের আলো জ্বালাবে। দেশের কল্যাণেও কাজ দেবে। কারণ, নারীর উন্নতি মানে, জাতির উন্নতি। তাই উন্নত জাতি গড়ে তুলতে চাইলে নারী উন্নয়নে সরকারকে মনোযোগী হতে হবে। আর এরই অংশ হিসেবে সবার আগে বাজেটকে নারীবান্ধব করে তুলতে হবে।
বর্তমান সরকার নারীর উন্নয়নকে মাথায় রেখে আলাদা বাজেট বরাদ্দ রেখে আসছে গত কয়েক বছর ধরেই। কিন্তু নারীর জন্য বরাদ্দ রাখলেও তার কতটুকু বাস্তবায়িত হচ্ছে, সেটাই মূল কথা। বর্তমানে নারীরা শহর ও গ্রামকেন্দ্রিক হলেও ইন্টারনেটের যুগে সবাই সবার সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। শহর-গ্রামমুখী হিসেবে আলাদা না করে বরং নারীদের প্রযুক্তিগত জ্ঞান কিভাবে আরও বাড়ানো যায়, সে বিষয়ে সরকারি পদক্ষেপের পূর্ণ বাস্তবায়ন জরুরি।
যদিও বিগত বছরগুলোতে সরকারি পদক্ষেপে নারীদের কারিগরি ও কম্পিউটার প্রশিক্ষণের ওপর জোর তাগিদ লক্ষ করা যাচ্ছে। এমনকি গ্রামগুলোতে নারীদের সক্ষম করে তুলতে সেলাই মেশিনসহ নানা সামগ্রী দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে একটি কথা এখন সরকারি বাজেট অনুযায়ী লক্ষ রাখতে টাকার বরাদ্দ অনুযায়ী দরিদ্র, অসহায় কেউ যেন এ আওতার বাইরে না যায়। কেউ পাবে কেউ পাবে না, এমন হলে সামাজিক বিশৃঙ্খলা বাড়বে। সরকারি পদক্ষেপের প্রতি সাধারণ জনগণের আস্থা-বিশ্বাস উঠে যাবে। তাই নারীকে স্বাবলম্বী ও যোগ্য-দক্ষ করে তুলতে বরাদ্দের সুষ্ঠু-সুষম বণ্টনও জরুরি।
দেশের জিডিপি বৃদ্ধিতে নারী-পুরুষ উভয়ই এখন প্রায় সমান ভূমিকা পালন করছে। তাই নারীকে দক্ষ করতে কাজ করতে হবে। প্রত্যেকটি সেক্টরে নারীকে সহযোগিতা করার মতো যথেষ্ট জনবল নিয়োগ দিতে হবে। বাংলাদেশের নারীরা যেন শ্রমবাজারে আরও বিশেষভাবে নিজেদের যোগ্য প্রমাণ করতে পারে, এ বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি রাখতে হবে। নারীদের কল্যাণে পৃথকভাবে যে জেন্ডার বাজেট বরাদ্দ করা হয়েছে, তার সঠিক বাস্তবায়নেই নারীর কল্যাণ নিশ্চিত করা সম্ভব।
পেশাগত ঝুঁকি এড়াতেও বর্তমান বাজেটের অর্থ কাজে লাগাতে হবে। নারীর নিরাপত্তার স্বার্থে সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে মনিটরিং টিম রাখতে হবে। যেন নারীরা স্বাচ্ছন্দ্যে নিজেদের সেরা কাজটা দিতে পারে। পেশাগত ঝুঁকি বিভিন্নভাবেই হতে পারে। কখনো সেটা নিরাপত্তাহীতার কারণে, কখনো আপদকালীন সময়ে। নারীর এ ধরনের সময়ে যদি তার পাশে সরকারি বরাদ্দ নিশ্চিত থাকে, তবে নারীর মানসিক শক্তি ও স্থিতি; দুটোই দিতে সক্ষম হবে। তাই নারীর মানসিক স্থিতি বাড়াতে বরাদ্দ যেন যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা হয়।
নারীর ক্ষমতায়নে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে নারীকে শক্তিশালী করে তোলা প্রয়োজন। সেদিক থেকে নারীর প্রতি পদক্ষেপগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন করতে হবে। বর্তমানে সরকার নারীর ক্ষমতায়নে বিশেষভাবেই কাজ করে যাচ্ছে। নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ এখন রোল মডেল বললেও অত্যুক্তি হবে না।। তবুও কর্মজীবী নারীর সংখ্যা যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, সে অনুযায়ী যদিও বরাদ্দের অর্থ সুষ্ঠু বণ্টন না হয়, তাহলে উন্নয়নের গতি বাধাগ্রস্ত হবে। উপকূলীয়, চরাঞ্চল ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নারীদের জন্য বরাদ্দ অর্থের সুষম বণ্টন করতে হবে।
এছাড়া, কর্মজীবী নারীরা দেশের উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখছেন। তাদের আরও একটি পরিচয় হলো তারা মা। ফলে কর্মব্যস্ততার কারণে সন্তানদের সঠিকভাবে পরিচর্যা করতে পারেন না অনেক নারী। নারীদের এই সমস্যা থেকে উত্তরণের স্বার্থে শহরাঞ্চলে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ডে কেয়ার সেন্টার চালু করতে হবে। সেই ডে কেয়ার সেন্টারে প্রয়োজনীয় ভর্তুকি-প্রণোদনা দিতে হবে। এজন্য বাজেটে বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন।
সামাজিকভাবে নারীরা আগে সঠিক মর্যাদা পায়নি। তবে বর্তমানে নারী উন্নয়নে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপগুলো প্রশংসার দাবি রাখে। এরপর আইনি জটিলতা না পুরুষ, না নারী; কারও জন্য সুবিধার হয়নি। দরিদ্র নারী, শিশুদের আইনি জটিলতা এড়িয়ে যেতে সরকারি তহবিল গঠন করে নারীদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে হবে। তাহলে নারীরা যৌতুক, সাংসারিক নিপীড়ন থেকে সহজেই মুক্তি পেতে সক্ষম হবে।
সার্বিক বিবেচনায়, নারীর উন্নয়নে বাজেটের সুষ্ঠু ও সুষম বণ্টন প্রয়োজন। নতুন অর্থবছরের বাজেটে নারীর উন্নয়ন আরও তরান্বিত হবে, এই আশাবাদ ব্যক্ত করছি।
লেখক : গবেষক ও শিক্ষক, নর্দার্ন বিশ্ববিদ্যালয়