দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বাজেট উপস্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এবারের বাজেটের আকার ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার। মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকার প্রথম বাজেট দিয়ে শুরু হয়েছিল দেশের বাজেটের ইতিহাস। হেনরি কিসিঞ্জারের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র অবমূল্যায়ন ঘুচিয়ে এখন বাংলাদেশ নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিয়ে যাচ্ছে বিশ্বে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়ে ঊর্ধ্বমুখিনতাসহ বৈশ্বিক নানা সূচক বাংলাদেশ বিশ্বে প্রশংসার স্থান দখল করে আছে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম এক অর্থনৈতিক শক্তি হওয়ার পথে এগোচ্ছে দেশ, তাই পাকিস্তানের সুশীল সমাজকেও টেলিভিশনে এসে তাদের দেশকে বাংলাদেশের মতো করার আকুতি করতেও শোনা যায়।
দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি বিশ্ববাসীর চোখে পড়ছে। এই অগ্রগতির তথ্য কাগজে-কলমে আমরা জানছিও। এই সময়ে ধনিক শ্রেণি আরও ধনী হচ্ছে, গরিব হচ্ছে আরও গরিব—এমন অভিযোগ শোনা যায়। তবে সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা এসব মানতে নারাজ। দেশ ইউরোপ-আমেরিকা-সিঙ্গাপুর হয়ে যাচ্ছে, দেশের শ্রমিকেরা এক দিন কাজ করে ১০-১২ কেজি চাল নিয়ে ঘরে ফিরতে পারছে, এমনও বুলি শোনা যায়। দেশে ভিক্ষুক নেই, ত্রাণ দেওয়ার মতো দুস্থ মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় না, এ ধরনের বক্তব্যও শুনছি নিত্য। যদিও এটা বাস্তবতাবিবর্জিত, তবু এ-ও সত্য না খেয়ে মারা যাওয়া মানুষ এখন নেই। উপার্জনক্ষম উপার্জন হারালে মানবিক মানুষেরা এগিয়ে আসছে, সরকার সাধ্যমতো চেষ্টা করছে।
প্রতিবার বাজেট উপস্থাপনের আগে-পরে অনেকগুলো জিনিসের দাম বেড়ে যায়। বাজেটে কিছু পণ্যে করারোপ এবং কিছু পণ্যে কর কমানো অথবা মওকুফের কারণে অনেক পণ্যের দাম কমার সম্ভাবনা থাকে। এই হিসেবে বাজেটে কোন কোন পণ্যের দাম বাড়ল আর কী কী পণ্যে দাম কমল, এ নিয়ে একধরনের আলোচনা থাকে। তবে এবারই সম্ভবত প্রথম বাজেটের করারোপে কোন কোন পণ্যে দাম বাড়ছে, এ নিয়ে আলাদা করে আলোচনা হচ্ছে না। কারণ, নিত্যপণ্য এমন এক জায়গায় পৌঁছেছে যে স্রেফ বাজেটের কারণে পণ্যের দাম বাড়ানো নিয়ে মানুষের ভাবনাচিন্তার সুযোগ কমে গেছে। সারা বছরই বাড়তে-বাড়তে নিত্যপণ্যের দাম এমন জায়গায় যে এ নিয়ে আগ্রহ কমে গেছে।
চাল-ডাল-পেঁয়াজ-সয়াবিন-চিনির দাম নিয়ে সারা বছর আলোচনা থাকে। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। এই নিত্যপণ্যগুলোর দাম ঊর্ধ্বমুখী আগে থেকে। অনেক পণ্য ভোক্তাসাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। বাজার ব্যবস্থাপনার সরকারের ব্যর্থতা সারা বছরই ছিল। ব্যর্থতা ঢাকতে সরকার প্রথমে করোনা পরিস্থিতির দোহাই দিয়েছিল, এরপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দোহাই; এসবের সঙ্গে ছিল মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির আষাঢ়ে গল্প। সরকারের এই আষাঢ়ে গল্পে মজুতদাররা দায়মুক্তি পাওয়ার মতো অবস্থায় চলে গেছে। ফলে হেন কোনো পণ্য নেই, যার দাম বাড়েনি গত কয়েক বছর। তবে বাজার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে উঠলে ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরসহ সরকারি কিছু দপ্তরের ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান ও জরিমানা আদায় চোখে পড়েছে। তবে এই অভিযানগুলো যতটা না কার্যকর, তার চেয়ে বেশি প্রতীকী বলে মনে হয়, কারণ এ ধরনের ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্ষেত্র বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ছিল শহরাঞ্চল, ফলে এর সুফল পৌঁছায়নি প্রান্তিক পর্যায়ে।
বাজেটের আকার যত বড়ই হোক না কেন, বাজেটে যত স্বপ্নই দেখানো হোক না কেন, বাজেট মানুষের কাছে অলুক্ষণে বিভীষণ মনে হবে যতক্ষণ পর্যন্ত নিত্যব্যবহার্য পণ্য তাদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আসে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়, বৈশ্বিক নানা সূচকে দেশের অগ্রগতি-অধোগতির কোনো তথ্যই মানুষের কাছে জরুরি নয়; ওটা বুদ্ধিবৃত্তিক ও কাগুজে আলোচনা। মানুষ দেখে, মানুষ আলোচনা করে তারা দুই বেলা খেতে পারছে কি না। ওখানেই সবিশেষ আগ্রহ। দেশের প্রথম বাজেট থেকে সবশেষ বাজেট কত টাকার, কী স্বপ্ন সরকারের, এসব গুরুত্বহীন; তাদের মূল দৃষ্টি মূলত খেয়েপরে বেঁচে থাকার। এ নিশ্চয়তা দিতে পারছে কি না সরকার, এটাই ধর্তব্যের তাদের কাছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাজার ব্যবস্থাপনায় সরকার যে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে, আসছে অর্থবছরে সেটা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে মানুষের যাওয়ার জায়গা থাকবে না। বাজার ব্যবস্থা স্থিতিশীল রাখতে সরকারের উদ্যোগ, সার্বক্ষণিক তদারকি এবং নিত্যপণ্য ভোক্তাসাধারণের ক্রয়ক্ষমতায় মধ্যে নিয়ে আসাই হবে সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ। করোনার অভিঘাত, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির গল্প নিতান্ত একঘেয়ে হয়ে গেছে। মানুষের চাওয়া স্বস্তি, এই স্বস্তি এনে দিতে পারে খেয়েপরে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তাটাই।
উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ—এই প্রচারণা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে যখন মানুষ স্বাভাবিক উপার্জন দিয়ে ভালোভাবে চলতে না পারার অবস্থায় চলে যায়। এ অবস্থা চলছে এখন। এ থেকে উত্তরণ দরকার। নানা ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সরকারের অনেক অর্জন আছে, সাফল্য আছে, স্বপ্ন আছে, পরিকল্পনা আছে, উদ্যোগও আছে। সবকিছু ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি বাজারব্যবস্থা নিয়ে মানুষের অস্বস্তি অব্যাহত থাকে। মানুষ উন্নয়ন চায়, অগ্রগতি চায়; তবে তার আগে চায় খেয়েপরে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা। নিত্যপণ্যের চলমান ঊর্ধ্বগতি এ নিশ্চয়তার পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সরকারের দায়িত্ব হবে এটা দূর করা। তা না হলে অনেক স্বপ্নের বিশাল এই বাজেট মূল্যহীন হয়ে পড়বে মানুষের কাছে।
দেশ ও দেশের মানুষের উন্নয়নের লক্ষ্য নিয়ে যে বাজেট, সে বাজেটে যদি দেশের মানুষের কল্যাণই না আনতে পারে, তবে রাজনৈতিক সরকারের সাফল্য কোথায়? বাজেট যেখানে একটা পুরো অর্থবছরের সামগ্রিক পরিকল্পনা, সেখানে সাধারণ মানুষের কাছে বাজারেই কেবল সীমাবদ্ধ থাকছে। এটা সরকার থেকে সাধারণ নাগরিক, সব পর্যায়েরই হতাশার গল্প!
লেখক : সাংবাদিক